নাস্তিকেরা মুক্তিযুদ্ধ করেনি, মাওলানাদের কোন অবদান নেই- এসব ভেদাভেদ করে কী লাভ হচ্ছে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একদল বলছে নাস্তিকরা নাকি মুক্তিযুদ্ধ করেনি, এদেশে তাদের থাকার অধিকার নেই। আরেকদল বলছে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় কোন আলেম-ওলামা নেই, তাহলে তারা কেন এদেশে থাকবে? অথচ এই দেশটা যে হিন্দু-মুসলমান আস্তিক-নাস্তিক সবার, সেটাই মাথায় রাখছি না আমরা, ছুটছি শুধু ইস্যুর পেছনে...
কিছুদিন আগে এক গণ্ডমুর্খের লেখা একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস খুব ভাইরাল হয়েছিল, সেটার ভাষ্য ছিল এরকম- এদেশের সাত বীরশ্রেষ্ঠের তালিকায় কোন নাস্তিকের নাম নেই, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাস্তিক কেউ নেই, তাহলে নাস্তিকরা দিনরাত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বয়ান দেয় কেন? মুক্তিযুদ্ধ তো মুসলমানরা করেছে, হিন্দুরা করেছে, অন্য ধর্মের লোকজন করেছে- তাহলে মুক্তিযুদ্ধে কানাকড়ি অবদান না রেখেও নাস্তিকেরা কেন এদেশে বাস করছে?
মাথার মধ্যে গোবর নিয়ে ঘোরা কোনো এক অকালপক্কই এই লেখার জন্মদাতা। সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে যাইনি খুব একটা। কিন্ত আজকাল দেখতে পাচ্ছি একই সুরের আরেকটা লেখা ভাইরাল হচ্ছে- সেটার ভাষ্য আবার ঠিক বিপরীত। এবার আক্রমণ করা হচ্ছে ধর্মপ্রাণ লোকজনকে, যাদের আমরা মাওলানা বা হুজুর বলে ডাকি। বলা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে কোন আলেম-ওলামা নেই, বীর উত্তম, বীর প্রতীক বা বীর বিক্রমদের মধ্যেও মাওলানা টাইটেলধারী কেউ নেই, তাহলে কিসের ভিত্তিতে তারা এই দেশে বসবাস করছে?
আমি নিশ্চিত, যে লোকটা প্রথম লেখাটা লিখেছে, সে নিজেকে ধার্মিক বলে দাবী করে, দেশপ্রেমিক হিসেবেও দাবী করে। আবার দ্বিতীয় লেখাটা যার, সে নিজেকে নিশ্চয়ই প্রগতিশীল ভাবে, ভাবে ধর্মান্ধতার অন্ধকার থেকে সে মুক্ত। কিন্ত মনের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা পুষে রেখে না হয় ধর্মপালন, না হয় প্রগতিশীলতার চর্চা।
যারা ধর্ম মানে না, যারা নাস্তিকতার চর্চা করে, তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি- এই তথ্য কে আবিস্কার করেছে? মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার শপথ নিয়ে। এই বাংলাদেশে সব ধর্মের, সব মানুষের সমান অধিকার থাকবে, কেউ ধর্ম পালন করতে না চাইলে তাকেও সেই স্বাধীনতা দেয়া হবে- এটাই ধর্মনিরপেক্ষতা। এদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ সেই ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা শুনলেই আঁতকে ওঠে, মনে করে, এতে বুঝি ধর্ম গায়েব হয়ে গেল! অথচ তাদের মাথায় এটা ঢোকে না যে, মানুষ ধর্ম পালন করে, রাষ্ট্র কোন ধর্মের পক্ষপাতিত্ব করে না, এমনকি কোন ধর্মের অনুসারীরা সংখ্যাগুরু হলেও না।
আবার বিরুদ্ধমতে যারা থিওর কপচে যাচ্ছে যে, মুক্তিযুদ্ধে কোন মাওলানা, কোন আলেম-ওলামা অংশ নেয়নি- তাদের এই মনগড়া তথ্য কে দিয়েছে? অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হাসান মুরশেদ আমাদের শুনিয়েছেন মাওলানা অলিউর রহমানের গল্প। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করার পর যখন পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামপন্থীরা ছয় দফাকে ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যা দিচ্ছিলো, তখন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মাওলানা অলিউর রহমান বই লিখেছেন, ইসলামের দৃষ্টিতে ছয় দফা। আলেমদের নিয়ে তিনি ছয় দফার পক্ষে সমাবেশ করেছেন, সেখানে অতিথি হিসেবে নিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধুকে। সেই মানুষটাকে পাকিস্তানী সেনা আর তাদের দোসর রাজাকারেরা হত্যা করেছিল ১৪ই ডিসেম্বর।
মুক্তিযুদ্ধে মাওলানা অলিউর রহমানের অবদানকে অস্বীকার করতে পারবে কেউ? ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে খুঁজলে এমন হাজারো অলিউর রহমান পাবেন, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। এরপরও কীভাবে বলা সম্ভব যে মুক্তিযুদ্ধে আলেম ওলামাদের অবদান ছিল না? কেউ যদি রাজাকারের দাড়ি আর একজন ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমীকের দাড়িতে তফাৎ খুঁজে না পায়, সেটা তার জাজমেন্টাল মানসিকতার দোষ, ধর্মপ্রাণ মানুষটার দোষ তো নয়।
যে কোন ইস্যুতে আমরা দুইভাগে ভাগ হয়ে যাই, তারপর শুরু করি লড়াই, একদম অপ্রয়োজনীয় কিছু তর্ক সামনে আনি। ভাস্কর্য ইস্যুতে এত জলঘোলা হবার কথাই ছিল না, কিন্ত সুবিধাবাদী কিছু লোক ধর্মের ট্রাম্পকার্ড খেলে আপনাকে উত্তেজিত করে, আপনিও নেমে পড়েন অবাস্তব এক যুদ্ধে, বুঝতেও পারেন না যে, তাদের স্বার্থসিদ্ধির এই খেলায় আপনি একটা গুটি মাত্র।
আপনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের ওপর ক্ষেপে গিয়ে রাস্তায় নেমে যান, অথচ আপনার রাস্তায় নামার কথা ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে, আপনার প্রশ্ন করার কথা ছিল কানাডার বেগমপাড়া নিয়ে, সেই প্রশ্ন না করে আপনি ফেসবুকে হ্যাশট্যাগ বয়কটের ট্রেন্ড চালু করেন। আপনার আওয়াজ তোলা উচিত ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যে নিয়ে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে, বিনা বিচারে যারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেলে আটকে আছে, তাদের অপরাধ নিয়ে। অথচ আপনি আপনার সময়, শ্রম আর মেধা নষ্ট করেন ভাস্কর্য আর মূর্তির পেছনে, নাস্তিকেরা মুক্তিযুদ্ধ করেছে নাকি আলেম-ওলামারা করেছে সেই ইস্যুতে জলঘোলা করে! নিজেকে এভাবে যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো অন্যের হাতে তুলে দিতে বোধহয় এই উপমহাদেশের মানুষই পারে শুধু।
ধর্মে বলা হয়েছে, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। সেই ঈমান বজায় রাখুন, অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অহেতুক তর্কে লিপ্ত না হয়ে, ঘৃণা না ছড়িয়ে দরকারী ইস্যুতে ফোকাস করুন। দিনরাত সরকারকে গালি না দিয়ে সরকারের দিকে আঙুল তাক করুন, প্রশ্ন ছুঁড়ে দিন, যাতে তারা নিজেরাই জনগনের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়। এই দেশটা যতটা মুসলমানের, ততটাই হিন্দুর, ততটাই অবিশ্বাসীরও। ইস্যুর স্রোতে ভেসে যাওয়ার আগে একটু যাচাই করে নিন, কারো খেলার গুটি হিসেবে ব্যবহার হয়ে যাচ্ছেন কিনা...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন