ফাহিমকে সবশেষ জীবিত অবস্থায় দেখা গেছে ভবনের সারভেইলেন্স ক্যামেরায়, লিফটে উঠছিলেন তিনি। লিফটে তার পাশে বড় একটা ব্যাগ হাতে এক লোক ছিল। পুলিশের ধারণা, সেই অজানা আততায়ীই ফাহিমের খুনী।
সকালটা শুরু হয়েছে দুটো ভিন্ন রকমের খবর দিয়ে। ভোরে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় র্যাবের হাতে ধরা পড়েছে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং প্রতারক মোঃ সাহেদ। এই খবরটা শুনে উৎফুল্ল হবার সাথে সাথেই সংবাদ এলো, নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে নিজের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে পাওয়া গেছে বাংলাদেশী উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ'র লাশ। ফাহিম ছিলেন রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং বিনিয়োগকারী। নিউইয়র্কের স্থানীয় গণমাধ্যম ডেইলি নিউজ জানিয়েছে, অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিউইয়র্ক পোস্ট এবং ডেইলি মেইলেও ফাহিমের খুনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
নিউইয়র্কের পুলিশ বিভাগ এনওইপিডি'র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ফাহিমের শরীরের হাত-পা, মাথা সবকিছু বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। পাশেই পড়ে ছিল একটি ইলেকট্রিক করাত, সেটি দিয়েই খুনের পর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কাটা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ফাহিমের বোন কয়েক দফায় ভাইকে মোবাইলে না পেয়ে তার ফ্ল্যাটে যান। ভেতর থেকে দরজা না খোলায় তিনি জরুরী সেবা ৯১১-এ ফোন দেন। এরপরই পুলিশ ফাহিমের ফ্ল্যাটে গিয়ে দরজা ভেঙে লাশ উদ্ধার করে।
তেত্রিশ বছর বয়েসী ফাহিম সালেহ'র জন্ম বাংলাদেশে, তার বাবা সালেহ উদ্দিন বড় হয়েছেন চট্টগ্রামে আর মা নোয়াখালীর মানুষ। ফাহিম পড়াশোনা করেছেন ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে আমেরিকার বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফাহিম থাকতেন নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে। গত বছর প্রায় সোয়া দুই মিলিয়ন ডলার মূল্যে বিলাসবহুল এই ফ্ল্যাটটি তিনি কিনেছিলেন।
পাঠাওয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হবার পাশাপাশি ফাহিম নাইজেরিয়া আর কলম্বিয়ায়ও এমন আরও দুটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ কোম্পানির মালিক। তিনি নাইজেরিয়ার লাগোসে একটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানির সিইও ছিলেন। সবশেষ তিনি পাঠাও-এ পর্যবেক্ষক উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন। করোনাভাইরাসের প্রকোপ কেটে গেলে বাংলাদেশে নতুন কোনো উদ্যোগ নিয়ে হাজির হওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার।
পুলিশ এখনও খুনের ঘটনার কোন মোটিভ বের করতে পারেনি। পুলিশের ধারণা, খুনি বিল্ডিংয়ের এলিভেটরে করে ফাহিম সালেহকে হত্যার জন্য প্রবেশ করেছে। মাস্ক ও গ্লাভস পরিহিত এক সন্দেহভাজনের ফুটেজ তারা উদ্ধার করেছে। গতকাল সোমবার বিকেলে ফাহিমকে সবশেষ জীবিত অবস্থায় দেখা গেছে ভবনের সারভেইলেন্স ক্যামেরায়, লিফটে উঠছিলেন তিনি। লিফটে তার পাশে বড় একটা ব্যাগ হাতে এক লোককে দেখা গেছে। মাস্ক এবং গ্লাভস পরিহিত ছিল সেই লোক।
পুলিশের ধারণা, সেই অজানা আততায়ীই ফাহিমের খুনী। পেছন থেকে আক্রমণ করে ফাহিমকে খুন বা অচেতন করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে তাদের মনে হয়েছে। ফাহিমের শরীরটা টুকরো টুকরো করে ব্যাগে ভরে গুম করে ফেলাই উদ্দেশ্য ছিল খুনীর, যে কোন কারণেই হোক, কাজটায় পুরোপুরি সফল হতে পারেনি সে। তাই ফাহিমের খণ্ড-বিখণ্ড দেহাবশেষগুলো রেখেই পালিয়েছে সে। অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, ঘরের ভেতরে ধস্তাধস্তির কোন চিহ্ন নেই, মেঝে থেকে মুছে ফেলা হয়েছে রক্তের দাগও। ফাহিমের শরীরের অংশগুলো ব্যাগে ভরে পার করে দিতে পারলে বোঝার উপায় ছিল না যে, এই ফ্ল্যাটে রক্তাক্ত কোন হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে!
ফাহিম সালেহ'র এই নৃশংস খুনের ঘটনাটা অজস্র প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এটাই- কেন খুন হতে হলো ফাহিম সালেহকে? ব্যবসা সংক্রান্ত কোন কারণে? টাকাপয়সাই কি খুনের কারণ? ফাহিমকে বলা হতো সেলফমেড মিলিওনিয়ার, নিজের যোগ্যতা আর মেধায় সাফল্যের দেখা পেয়েছিলেন এই তরুণ, ত্রিশ বছর বয়সে তিনি যে চূড়ায় উঠেছিলেন, সেটা অনেকের কাছেই স্বপ্নের মতো।
খুনীর কাজ দেখে পুলিশ বলেছে, নিঃসন্দেহে এটা কোন ভাড়া করা প্রফেশনাল কিলারের কাজ। ফাহিমকে খুন করার জন্য প্রফেশনাল কিলার ভাড়া করার দরকার পড়লো কার? আর ফাহিম মারা গেলে কে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়? নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের মতো জায়গায় এভাবে ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে কাউকে খুন করে লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলা হচ্ছে- এটা তো শহরটার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিরও একটা প্রমাণপত্র।
সময়ের সাথে সাথে হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে। কিন্ত তাতে ফাহিম ফিরে আসবেন না। মেধাবী এই তরুণ উদ্যোক্তার এভাবে অকালে হারিয়ে যাওয়াটা যে অপূরণীয় এক ক্ষতি- তাতে কোন সন্দেহই নেই।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন