নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, পুলিশ খুনের অভিযোগে যাকে গ্রেফতার করেছে, সে পেশাদার কেউ নয়, বরং ফাহিমের পরিচিত একজন!

কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। কথাটা সবসময় সত্যি না, তরুণ উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ'র খুনের ঘটনার তদন্ত যেদিকে যাচ্ছে, যেসব তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসছে, সেসব মাথায় নিয়ে বলা যায়, বিশ্বাস বস্তুটাই বরং আত্মঘাতী। ফাহিমকে যে বিশ্বাসের চড়া মূল্য দিয়েই নৃশংসভাবে খুন হতে হয়েছে নিজের ফ্ল্যাটে! 

রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাও'র সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং মেধাবী বাংলাদেশী উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ খুন হয়েছিলেন গত সোমবার। পরদিন ম্যানহাটনে নিজের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে পাওয়া গিয়েছিল ফাহিমের ছিন্নভিন্ন লাশ। খুনের পর ইলেক্ট্রিক করাত দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছিল তার দেহ, লাশ গুম করার উদ্দেশ্য ছিল খুনীর। কিন্ত ফাহিমকে ফোনে না পেয়ে মঙ্গলবার সকালে তার ফ্ল্যাটে চলে এসেছিলেন ফাহিমের বোন, খুনী তখন কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই ফায়ার এক্সিট দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তার পরের ঘটনা তো সবাই জানে, পুলিশের আগমন, লাশ উদ্ধার হওয়া, বিদ্যুতের বেগে খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া। 

পুলিশ এই কেসটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত শুরু করেছিল। ম্যানহাটনের মতো বিখ্যাত এলাকায় এরকম রোমহর্ষক খুনের ঘটনায় শিউরে উঠেছিল খোদ আমেরিকানরাই। গোয়েন্দারা শুরুতে ধারণা করেছিলেন, পেশাদার কোন ভাড়াটে খুনি এই কাজ করেছে। কিন্ত নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, পুলিশ খুনের অভিযোগে যাকে গ্রেফতার করেছে, সে পেশাদার কেউ নয়, বরং ফাহিমের পরিচিত একজন! 

ফাহিম সালেহ

টাইরিস ডেভন হসপিল নামের যে লোকটাকে পুলিশ খুনি সন্দেহে আটক করেছে, সে কিছুদিন আগেও ফাহিমের ব্যক্তিগত সহকারী ছিল। তদন্তকারীদের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ২১ বছর বয়সী হসপিল ফাহিমের কাছ থেকে মোটা অংকের ডলার চুরি করেছিলেন। বিষয়টি ফাহিম জেনে যাওয়ায় তাকে হত্যা করেন তার হসপিল। দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে পত্রিকাটি লিখেছে, গ্রেপ্তার টাইরিস ডেভন হসপিলের বিরুদ্ধে শুক্রবারই আদালতে অনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হতে পারে।

হসপিলের বয়স মাত্র একুশ বছর। ব্যক্তিগত সহকারী থাকা অবস্থায় সে ফাহিমের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচুর টাকা সরিয়ে ফেলেছিল। সেটা টের পেয়ে ফাহিম তাকে চাকরি থেকে বাদ দেন। ফাহিম তখন এই ব্যাপারে পুলিশের কাছে  অভিযোগ করেননি, বরং সেই টাকা ফেরত দেয়ার জন্য হসপিলকে সময় দিয়েছিলেন, পেমেন্ট প্ল্যানও দিয়েছিলেন, যাতে সে কিস্তিতে টাকাটা শোধ করে দিতে পারে।  

পুলিশ হসপিলের ক্রেডিট কার্ডের হিস্ট্রি চেক করে দেখেছে, সে কয়েকদিন আগে একটা ইলেক্ট্রিক করাত আর ঘর পরিষ্কার করার সামগ্রী কিনেছিল, তাছাড়া সে ঘটনার আগে পরে অনেকবার ম্যানহাটনের ওই এলাকায় গিয়েছিল। ফাহিম খুন হয়েছেন সোমবারে, তার লাশ আবিষ্কার হয়েছে মঙ্গলবারে। পুলিশের ধারণা, খুনী প্রায় এক দিন লাশের আশেপাশেই ছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল লাশ গুম করে ফেলা। কিন্তু পরদিন ফাহিমের বোন এসে বেল বাজানোয় সে ফায়ার এক্সিট দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

ম্যানহাটনের এই অ্যাপার্টমেন্টে খুন হয়েছেন ফাহিম

ফাহিমের এই নৃশংস হত্যাকান্ডের পেছনে শুরুতে মাফিয়া কানেকশন আছে বলে অনেকে ধারণা করেছিল। কারণ খুনের ধরণটার সঙ্গে মাফিয়াদের খুনোখুনির স্টাইলের মিল আছে। ফাহিম নাইজেরিয়ায় গোকাডা নামের একটা রাইডিং প্ল্যাটফর্ম চালাচ্ছিলেন, নাইজেরিয়ান মাফিয়াদের উৎপাতে সেদেশের সরকার সেটা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল, ফাহিম পরে সেটাকে পার্সেল সার্ভিসে পরিণত করেছেন। কাজেই ফাহিমের মৃত্যুর সঙ্গে সেটার সংযোগ আছে বলেই মনে করেছিলেন অনেকে। 

তেত্রিশ বছর বয়েসী ফাহিম সালেহ'র জন্ম বাংলাদেশে, তার বাবা সালেহ উদ্দিন বড় হয়েছেন চট্টগ্রামে আর মা নোয়াখালীর মানুষ। ফাহিম পড়াশোনা করেছেন ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে আমেরিকার বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাঠাওয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হবার পাশাপাশি ফাহিম নাইজেরিয়া আর কলম্বিয়ায়ও এমন আরও দুটি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ কোম্পানির মালিক। অল্প বয়সেই নিজের যোগ্যতায় মিলিওনিয়ার হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার এভাবে খুন হওয়াটা যে বাংলাদেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি, তাতে কোন সন্দেহ নেই।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা