ফেসবুক অ্যাভাটার ও আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

যেকোনো ট্রেন্ড শুরুর কিছু পরেই আমরা একদল মানুষকে দেখি, যাদের কথাবার্তায় মনে হয়, যারা ট্রেন্ড ফলো করে তারা খুবই নিম্ন স্তরের মানুষ এবং এই 'দিগগজ' ব্যক্তিরা ট্রেন্ড না ফলো করে খুব উঁচুস্তরে উঠে গিয়েছেন...
সম্প্রতি ফেসবুক এনেছে একটা নতুন ফিচার, যেখানে নিজের চেহারার মত করে একটা কার্টুন ক্যারেক্টার বানানো যাবে। 'ফেসবুক এ্যাভাটার' নামের এই কনসেপ্ট ফেসবুক নিয়েছে স্ন্যাপচ্যাটের অপশন থেকে। স্ন্যাপচ্যাটের 'বিটমোজি' আর আইফোনের 'মেমোজি'র মত করেই এসেছে ফেসবুকের এই অ্যাভাটার। এই কার্টুন ক্যারেক্টারের মজা হলো, ম্যাসেঞ্জারে, পোস্টের কমেন্টে বা প্রোফাইল পিকচার হিসেবে এই ক্যারেক্টার গুলোকে ব্যবহার করা যাবে। এবং থার্ড পার্টি এ্যাপ যেমন স্ন্যাপচ্যাট, টুইটার এবং ইন্সটাগ্রামেও এই ক্যারেক্টারগুলোকে 'ইমোজি' হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা, ব্রিটেন সহ বড় বড় দোষগুলোতে ফেসবুকের এই বিশেষ অপশন আগে এলেও বাংলাদেশে এসেছে দুই-তিন দিন হলো। নতুন জিনিসপত্র নিয়ে মানুষ একটু ঘাটাঘাটি করবেই, এটাই স্বাভাবিক। মানু্ষ করেছেও। গত দুপুর থেকেই ফেসবুকে দেখছি একেকটা মানুষের কার্টুন ভার্সন। সত্যি বলতে খারাপও লাগেনি অতটা। সারাদিন হাবিজাবি অনেক কিছুই শেয়ার করি আমরা৷ সেগুলোর পাশাপাশি নিজেদের কার্টুন ক্যারেক্টার তৈরী করার যে ট্রেন্ড, তা অতটা খারাপও লাগেনি। একটু অন্যরকম কিছু হয়েছে দেখে ভালোও লেগেছে।
মাঝেমধ্যেই এরকম ট্রেন্ড আসে ফেসবুকে। ফার্স্ট ইম্প্রেশন, বেস্ট মেমোরিজ এর মতন নস্টালজিয়ার ট্রেন্ড যেমন আছে, আবার #metoo মুভমেন্ট, #whereismyname মুভমেন্ট এর মতন গুরুত্বপূর্ণ মুভমেন্টগুলোর প্রচার ও প্রসার হয়েছে ফেসবুকেই। এগুলোতে কেউ চাইলে অংশগ্রহণ করতে পারে, না চাইলে নাও পারে। যার যার ইচ্ছে।
সমস্যা হয়ে গিয়েছে অন্য জায়গায়। যেকোনো ট্রেন্ড শুরুর কিছু পরেই আমরা একদল মানুষকে দেখি, যারা মাঠে নামে ট্রেন্ডগুলোকে এবং ট্রেন্ডগুলোর অনুসারী মানুষদের ফর্দাফাই করার জন্যে। তাদের কথাবার্তায় এটাই মনে হয়, যারা ট্রেন্ড ফলো করে তারা খুবই নিম্ন স্তরের মানুষ এবং এই 'দিগগজ' ব্যক্তিরা ট্রেন্ড না ফলো করে খুব উঁচুস্তরে উঠে গিয়েছেন। অথচ এরকমটা হওয়ার কথা ছিলো না। ফেসবুক সহ বাকি সোশ্যাল মিডিয়াগুলো এমন কোনো মহাগুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ না যে এখানে সারাদিন মার্ক্স, লেনিন, স্তালিন কপচাতে হবে বা কথায় কথায় 'নো দাইসেল্ফ' বলে বলে মুখের ফেনা তুলে ফেলতে হবে। অধিকাংশ মানুষই সোশ্যাল মিডিয়ায় আসে প্রেশার রিলিজ করার জন্যে। একটু স্বস্তির জন্যে। সেটাতেও এই 'জাজমেন্ট পুলিশ'রা বাধা দিচ্ছেন, যারা অ্যাভেটার শেয়ার করছেন তাদের 'নিম্ন রুচি' 'ইডিয়ট' ' সোশ্যাল ইডিয়ট' 'লো উইট' নানারকম ট্যাগ দিচ্ছেন। বিষয়টি হতাশাজনক। তীব্র বিরক্তিকরও।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার লক্ষ্য করলাম এরপর। এক দল লোক এই 'অ্যাভেটার' বানানোকে ধর্মের পরিপন্থী, হারাম, বেদাতি কাজকর্ম, হারাম, শিরক বলে ট্যাগ দিচ্ছেন। এগুলো শেয়ার করা মানে ধর্মানুভূতিতে আঘাত বলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বলছেন। ফেসবুকের একটা ছোট্ট ফিচার, সেটা শেয়ার করাও কেন ধর্মের উপর আঘাত হবে, বেদাতি, শিরক হবে! ধর্ম কী এতই ঠুনকো? ধর্মানুভুতি কী এতই পলকা!
লাইকি-টিকটকের ভিডিও নিয়ে এদেশে গ্রুপে গ্রুপে মারামারি হয়, ফেসবুকে পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, এক নেতার পোস্টে 'হাহা' রিএ্যাক্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে সেই নেতার অনুসারীরা চড়াও হয় আরেক নেতার উপর... আসলে হচ্ছে কী আশেপাশে? আমাদের মগজ কী আসলেই আমাদের সাথে আছে? নাকি, আমাদের ছেড়েছুড়ে তা চলে গিয়েছে? এত প্রতিক্রিয়াশীল কেন আমরা? এত সহজে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তেও পৌঁছে যাইও বা কেন আমরা?
মাঝেমধ্যে ফেসবুকের বিভিন্ন সব ফিচার বা বিষয়গুলো আসে একেকটা লিটমাস টেস্ট হিসেবে। কিছু 'এক্সট্রিমিস্ট' চেনার লিটমাস টেস্ট হিসেবে। যাদের লাইফ বলতে কিছুই হয়তো অবশিষ্ট নেই আর। মানুষের কাজের সমালোচনা করে আর নিজেদের 'উচ্চস্তরের মানুষ' ভেবেই এদের যত শান্তি আর তৃপ্তি।
স্রষ্টা এদের সুমতি দিক। এটাই চাই।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন