ওরা হয়তো আসলেই ভাবে আমরা ‘বস্তি’। এখন এর দায় আসলে কার? নেটফ্লিক্সের? থর ভাইয়ার? রুশো ভাইয়ার? নাকি আমাদের লোকাল ভাইয়াদের?

আশরাফুল সুমন: মেক্সিকো সম্পর্কে জানতে হলে কীভাবে জানবেন? একটা হলিউড মুভি দেখবেন না মেক্সিকো লিখে গুগল সার্চ করে জেনে নেবেন? বা যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্থানের বর্তমান অবস্থা? ফিকশন মুভি দেখে কেউই কোনো দেশ সম্পর্কে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করে না। প্রকৃত ধারণা ফিকশনে থাকে না, এই সত্যটা না বোঝার মতো অবুঝ কেউই না। আর কীভাবে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যায় সেটাও সবাই জানে।

মেক্সিকোতে ড্রাগ কার্টেলরা কতটা ভয়াবহ আকারে আছে, সেটা জানার জন্য হলিউড মুভি দেখতে হয় না। ওখানে যে পুরো শহরের নিচে ড্রাগ ডিলাররা সুড়ঙ্গের পর সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রেখেছে সেটা জানার জন্যেও হলিউড মুভি দেখতে হয় না। তথ্যপ্রযুক্তি এখন আমাদেরকে ঘরে বসেই এসবের খবর রাখার সুযোগ করে দিয়েছে। ইন্টারনেটকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আর এই ইন্টারনেটের কল্যাণেই আমরা এখন জানি বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাঁচটা ড্রাগ কার্টেলের কেন্দ্র মেক্সিকোতেই। এই তো ৫ এপ্রিল ড্রাগ কার্টেলদের নিজস্ব যুদ্ধে ১৯ জন লোক মারা গেছে। এই মুহূর্তেই যদি এমন কোনো মুভি রিলিজ হয় যাতে দেখায় যে মেক্সিকোতে আসলে কোনো ড্রাগ কার্টেলই নেই, বরং সবাই চলে গেছে চায়নাতে, আমরা কি এতই নির্বোধ যে বিশ্বাস করে নেবো মেক্সিকোর ড্রাগ সমস্যা চলে গেছে?

আবার ধরেন আমেরিকা। হলিউড মুভিতে আমেরিকাকে অনেক ভালো হিসেবে দেখায় না? ঐ হিসেবে তো আমেরিকা আমাদের কাছে ফেরেশতাদের অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার কথা! আমরা তাহলে কেন আমেরিকাকে খারাপভাবে দেখি? হলিউড কি পেরেছে আমাদের মাথায় ‘আমেরিকা ভালো’ এই তথ্য ঢুকিয়ে দিতে?

অতীতে যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বাজে ছিলো, ইন্টারনেট সুবিধা ছিলোই না, তখন টিভির পর্দায় মানুষ যা দেখতো তা-ই বিশ্বাস করার প্রবণতা ছিলো। এখন টিভিতে দেখিয়ে কাউকে মিসরিপ্রেজেন্ট করা সম্ভব নয়, অন্তত একজন বোধসম্পন্ন লোকের কাছে তো নয়ই। এমনকি বিদেশি সংবাদমাধ্যমের খবর পর্যন্ত আমরা হুট করে বিশ্বাস করি না। তাদের খবর দেখলে আমরা সাথে সাথে বিশ্বাস না করে আগে আরো কিছু সোর্স দেখি, যে ব্যক্তি সম্পর্কে খবরটা দিয়েছে বা যে ঘটনা সম্পর্কে দিয়েছে তা আসলে কতটা সত্যি তা বোঝার চেষ্টা করি। সেখানে একটা ফিকশন মুভি ঠিক কীভাবে কাউকে ভালো বা খারাপভাবে রিপ্রেজেন্ট করতে পারে?

নেটফ্লিক্সের সিনেমা এক্সট্র্যাকশনে বাংলাদেশে বাজেভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ এসেছে

এতক্ষণে অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন আমি কী নিয়ে বলছি। প্রথমেই বলি, থর ভাইয়ার মুভিটা আমি দেখিনি। (থর ভাইয়া শুনতে অস্থির শোনায়, ঠিক যেমনটা রব ভাইয়া, জন ভাইয়া, থিয়ন ভাইয়া শুনতে অস্থির শোনায়।) তবে থর ভাইয়ার এক্সট্র্যাকশন নিয়ে আপনাদের অসংখ্য অসংখ্য রিভিউ দেখে বুঝতে পেরেছি যে মুভিতে বাংলাদেশকে খুবই বাজেভাবে রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে। মানে যাকে বলে একদম ছ্যাঁচড়াভাবে। এক্সট্র্যাকশনে দেখানো হয়েছে আমরা দুর্নীতিবাজ, আমরা ঘুষখোর, আমরা চামচা, আমরা বস্তি।

কথা সেটা না, কথা হচ্ছে, ফিকশন কি আসলেই পারে আমাকে বা আপনাকে বাজেভাবে রিপ্রেজেন্ট করতে? এখনো না বুঝলে উপরের কথাগুলো আবার পড়ুন।

এবার পরের অংশে আসি। ধরুন, তারা বাংলাদেশকে আসলেই বাজে চোখে দেখে, তাই বাজেভাবে রিপ্রেজেন্ট করেছে। ওরা হয়তো আসলেই ভাবে আমরা ‘বস্তি’। এখন এর দায় আসলে কার? নেটফ্লিক্সের? থর ভাইয়ার? রুশো ভাইয়ার? নাকি আমাদের লোকাল ভাইয়ার? আমাদের লোকাল ভাইয়া যখন বিদেশি কারো স্ট্যাটাসে লিখে আসে, ‘ব্রো, চিকন পিনের চার্জার হবে’, তখন কি ওদের আমাদের সম্পর্কে ‘বস্তি’ ধারণা হয় না? আমাদের লোকাল ভাইয়া যখন স্বয়ং জাকারবার্গের আইডিই খেয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে আসে, তখন কি বিদেশি ভাইয়াদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় না, ‘শালা বোকচোদ’? আমাদের লোকাল ভাইয়া যখন জাকারবার্গের সাথে তার বৌয়ের ছবি দেখে কমেন্ট করে আসে, ‘চুদির ভাই, জিতছস’, এরপর পাশে নিজেই ইংলিশে অনুবাদ করে দেয়, ‘Great achievement, brother. Love from bangladesh’, তখন কি বিদেশিরা গুগল ট্রান্সলেটরের সহায়তায় কিছু শব্দের অর্থ ধরতে পেরে মনে মনে বলে ওঠে না, ‘বাইঞ্চতটা ভাবছে আমরা বুঝবো না?’

সাকিবকে কেন টিমে নেয়নাই সেটা নিয়ে যখন ‘সাকিব নাই কেন, ভারতীয়দের ষড়যন্ত্র মানি না’ লিখে আসে, তখন কি দেশের মিসরিপ্রেজেন্টেশন হয় না? সর্বোপরি বিদেশি পেজগুলাতে গিয়ে যে বলদামি আর ছ্যাঁচড়ামিগুলো করে আসে আমাদের লোকাল ভাইয়ারা, সেগুলোতে কি দেশের পাছাটা ফেটে চৌচির হয় না? সাকিব তার ব্যাট নিলামে তুলেছে ফান্ড গঠনের জন্য, সেখানে গিয়ে আমাদের বলদগুলা কমেন্ট মেরে আসছে, ‘ওই ব্যাটা, নিলামের দশভাগ ত্রাণ হিসেবে দিয়ে যে বাকি নব্বই ভাগ নিজের পকেটে ভরবি, সেটা কি আমরা বুঝি না?’

মিথিলা ‘কনসেন্ট’ নিয়ে ভিডিও করছে, সেখানে খুব সুন্দর করে ‘সম্মতি’ এবং এটা নেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝিয়ে বলছে, ঐ ভিডিওতে গিয়ে কি আমাদের দেশি ভাইয়ারা কমেন্ট করে আসেনি, ‘মাগী, নিজের সংসার বাঁচাইতে পারোস না, আসছস অন্যরে জ্ঞান দিতে?’ মানে কী দাঁড়ালো এটা? মিথিলা নিজের সংসার টেকাতে পারেনি বলে ‘সম্মতি’ নিয়ে বলতে পারবে না? এড হোমিনেম ফ্যালাসি।

এরকম লাখো উদাহরণ দেয়া যাবে আমাদের ছ্যাঁচড়ামি নিয়ে, আমাদের বস্তিপনা নিয়ে। এখন যদি আপনি গাল ভেটকিয়ে সোনামুখ করে বলেন, ‘হেঁ, হেঁ, জাঁনি ঠিঁকই, কিঁন্তু বঁলবো নাঁ’, তাহলে বলবো, আপনার বলার জন্য বসে নেই বিদেশিরা। ওরা ইতোমধ্যেই জানে।

ওহ ফাক, বস্তিপনা নিয়ে বলতে গিয়ে তো আমাদের দুর্নীতি নিয়েই বলা হয়নি! যা-ই হোক, দুর্নীতি নিয়ে এক লাইনেই বলি: আমরা দুর্নীতিবাজ এটা যে স্বীকার করে না, সে আসলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদি। আমাদের আসলে যুক্তিটা কোথায়? আমাদেরকে খারাপভাবে দেখিয়েছে মুভিতে, সেটা?

এখন ধরেন, আপনার কাছে এলাকার মোকলেসকে ভালো লাগে না তার বস্তি মার্কা স্বভাবের জন্যে। আপনি কথায় কথায় আরেকজনকে বলেই ফেললেন মোকলেসের সম্পর্কে দুটো বাজে কথা। এরপর মোকলেস এসে আপনার কলার চেপে ধরলো, ‘ঐ, তুই আমাকে মিসরিপ্রেজেন্ট করলি কেন? এলাকার মানুষ এখন আমাকে খারাপ জানবে না, বল?’ মোকলেস যেটা বুঝতে পারছে না তা হচ্ছে, আপনি তাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেননি, আপনি আপনার ‘লেন্স’ দিয়ে তাকে যেভাবে দেখেছেন ঠিক তা-ই বলেছেন। মানে, ও-ই নিজেকে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি। আর আপনি একা পুরো এলাকার মানুষের লেন্স পরিবর্তন করার সামর্থ্য রাখেন না। ওরাও মোকলেসকে দেখছে, বিবেচনা করছে, তবে সেটা তাদের নিজস্ব লেন্স দিয়ে। তাহলে আপনার একার বক্তব্যে কীভাবে মোকলেস পুরো এলাকায় খারাপ হয়ে গেল, যদি না মোকলেস আসলেই নিজেকে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়ে থাকে?

এক্সট্র্যাকশন সিনেমায় ক্রিস হ্যামসওর্থ

এবার বলুন, দায়টা আসলে কার? আপনার, নাকি মোকলেসের নিজের?

এই যে গণহারে সবাই নেটফ্লিক্সের গুষ্ঠি উদ্ধার করছেন, এতে কি তাদের আমাদের প্রতি ভালো ধারণা হচ্ছে? আমাদের ক্রিটিকের বিষয় হওয়া উচিত ছিলো মুভিটা কীভাবে টেকনিক্যাল দিকে হেরে গেছে। যেমন কলকাতার উচ্চারণে বলা বাংলা, এটা একটা ফেয়ার পয়েন্ট। কাহিনীর গভীরতা না থাকা, ফেয়ার পয়েন্ট। যারা মুভিটা দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই এমন আরো অনেক ফেয়ার পয়েন্ট জানেন? আমরা পারতাম শুধু এগুলো নিয়ে ক্রিটিক দিয়ে ওদেরকে বুঝিয়ে দিতে যে আমরা আসলে ‘বস্তি’ না, আমরা ওদের মতোই জ্ঞান রাখি। কিন্তু আমরা কী করলাম? ওভার রিয়েকশান। এইসব অতি আবেগ আর নেটফ্লিক্স বর্জনের ঘোষণাগুলো ওরা কিন্তু ঠিকই দেখছে, জানছে। কথা হচ্ছে, এসব করে কি আমরা আমাদের সম্পর্কে ওদের যে সামগ্রীকভাবে খারাপ ধারণা, সেটাকে আবারো ঠিক বলে প্রমাণ করলাম না?

এক হাজার শব্দ হয়ে গেছে এখুনি, আর লিখতেও ইচ্ছা করছে না, মনে হচ্ছে সময়ের অপচয় করছি। কারণ এসব কথা আপনি এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দেবেন। এসব স্ট্যাটাস কারো মন স্পর্শ করবে না, দুনিয়া উলটে গেলেও না, করবে কেবল নেটফ্লিক্সের ছবিতে ক্রস এঁকে ব্যান করার আহ্বান নিয়ে দেয়া স্ট্যাটাস (হ্যাঁ, এরকম কিছু স্ট্যাটাসে হাজারে উপরে প্রতিক্রিয়া দেখলাম)। অতএব, আমার মনে হচ্ছে আমি যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছি, এই সময়টা আমি নিজের প্রকাশিতব্য বইগুলোতে দিলে অনেক ভালো হতো। এটলিস্ট, কিছু পাঠকের ক্ষোভ থেকে রেহাই পেতাম। এরপরেও যা করলাম, এটা বিরক্তি থেকে করলাম, সাধারণ একটা বিষয়কে আপনারা সবাই মিলে যে ‘অসাধারণভাবে’ উপস্থাপন করেছেন, তার জন্য বাধ্য হয়ে করলাম। এই অ-বিখ্যাত, গায়ে সকল ধরনের ফোস্কা, বিচি, খোস-পাঁচড়া ধরানো স্ট্যাটাসের যবনিকা পতন টানছি এখুনি।

আপনি চান বিদেশিরা আমাদের ভালো বলবে? তাহলে প্রথমে নিজে উন্নত মানসিকতা ধারণ করুন। নিজে পরিবর্তন হোন। ভালো কাজে উৎসাহ দিতে শিখুন, অপছন্দের লোক ভালো কাজ করলে সেটা নিয়ে ভালো বলার অভ্যাস করুন, তা না পারলে অন্তত মুখটা বন্ধ রাখতে শিখুন, বিদেশিদের আইডি বা পেইজে গিয়ে ফাতরামি করা বন্ধ করুন। মনে রাখবেন, আপনি নিজেই বাংলাদেশের একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ। আপনি নিজেকে ভালোভাবে রিপ্রেজেন্ট করুন। আপনার পাশের জন করুক, এরপর তার পাশের জন। এভাবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের যে শরীরটা তৈরি হবে, তাতে কালো দাগ থাকবে খুব কমই, অনেকটা চাঁদের কলংকের মতো। মানুষ চাঁদের কলংকের কথা বলে না, তার সৌন্দর্যের কথা বলে। আপনি ভালো চলুন, ভালো কথা বলুন, মানসিকতার উন্নতি সাধন করুন, ছ্যাঁচড়ামি বন্ধ করুন, দেখবেন আজ থেকে পাঁচ বছরের ভেতর বাংলাদেশকে ওরা আসলেই ভালো চোখে দেখা শুরু করবে।

নাহলে বিদেশিদের আমাদেরকে মিসরিপ্রেজেন্ট করতে হবে না, আমরাই আমাদের মিসরিপ্রেজেন্ট করে ফেলবো।

কথা বলুন নিঃসংকোচে

প্রিয় পাঠক, করোনার এই দিনগুলিতে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হতেই পারেন আপনি। সেটা হতে পারে অর্থনৈতিক, মানসিক- বা অন্য কিছু। আপনার সমস্যার কথা জানান আমাদের, আমরা চেষ্টা করব সেটা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অবহিত করার, যাতে বেরিয়ে আসে সমাধানের পথ।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা