আপনাদের এই গালির বন্যায় নেটফ্লিক্সের কিছু আসে যায় না!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

এক্সট্র্যাকশনে ঢাকাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করায় আমরা ক্ষেপে গিয়েছি, গালি দিচ্ছি। কিন্ত নিজেদের ভালো ব্র্যান্ডিং তৈরী করতে না পারার দায় কি আমাদের নেই?
হিমেল আশরাফ: মাস খানেক আগের কথা, আমি কোক কিনে বাসায় এনে ফ্রিজে রাখছিলাম। আমার আমেরিকান রুমমেটের আমেরিকান মেয়ে বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করলো আচ্ছা বাংলাদেশে কোক পাওয়া যায়? আমি কিছুক্ষন তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ও কি মজা করছে নাকি সিরিয়াস। যখন বুঝলাম ও সিরিয়াস আমি জানতে চাইলাম ওর কেন মনে হচ্ছে বাংলাদেশে কোক পাওয়া না'ও যেতে পারে? ও বুঝলো আমি মাইন্ড করছি তাই সে অনেকবার স্যরি বলে বোঝাতে চাইল সে আসলে বাংলাদেশকে ছোট করতে চায় নাই ওর ধারনা এখানে কোক পেপসি বা এসব পানীয় পাওয়া যায় না অথবা এসব এক্সপেনসিভ(!) পানীয় খাওয়ার মানুষ নাই! আমি উত্তরে কিছু বলি নাই, আসলে কি বলবো? যার মনে হয় একটা দেশে কোক পাওয়া যায় না তার মতো ব্যাক্কলরে কোথা থেকে কি বলবো!
আমার এক আমেরিকান কলিগ একদিন কথায় কথায় আমার কাছে জানতে চাইলো বাংলাদেশে কি গাড়ী আছে? আমি ওর দিকে অবাক হয়ে তাকানোর পর ও প্রশ্নটা আরেকটু এডিট করে আবার প্রশ্ন করল না মানে অনেক গাড়ী আছে? আমি বললাম ১৮ কোটি মানুষের দেশে অনেক গাড়ী থাকবে সেটাই কি স্বাভাবিক না? ও উত্তরে বলল না মানে আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে ওভাবে জানি না মাঝে মাঝে খবরে দেখি বন্যা হয় সবসময় তাই ভাবলাম তোমরা হয়ত নৌকায় বেশী চলো, রাস্তা ডুবে থাকলে গাড়ী কিভাবে চলবে, তাই। আমি বললাম যে আমরা ৬ মাস ভেনিস শহর আর ৬ মাস ঢাকার শহর!
নিউয়র্ক ইমিগ্রেন্টদের শহর। সারা দুনিয়া থেকে এখানে লোক আসে। তাই কারো সাথে পরিচিত হবার পরেই প্রথম যেই প্রশ্ন পাই বা করি তা হচ্ছে তুমি কোন দেশ থেকে এসেছো? বাংলাদেশ উত্তর দেয়ার পর আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা ৩০% লোক জানেই না এইটা কোথায় বা এইনামে কোন দেশ আছে। ৪০% লোক জানে এটা ইন্ডিয়ার মধ্যে বা এশিয়ার কোন এক জায়গায় আছে। আর ৩০% লোক বাংলাদেশ কোথায় তা জানে বা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে। বিশেষ করে যেসব দেশে ক্রিকেট জনপ্রিয় সেসব দেশের মানুষেরা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিস্তারিত জানে যেমন ইংল্যান্ড, অষ্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ড।
একজন বাংলাদেশি হিসেবে যখন আমাকে কেউ চিনে না বা আমার দেশে কোক গাড়ী পাওয়া যায় কিনা এইটা নিয়া প্রশ্ন করে তখন খুব রাগ হয়, লজ্জা হয়, চিৎকার দিয়ে কান্না আসে। কিন্তু একবার কি ভেবে দেখেছি কি এই যে সাদা চামড়ার ওরা আমাদের চিনে না, এর জন্য কি ওরা দায়ী? ১৯৭১ থেকে বিশ্বকে চেনানোর মতো আমরা আসলেই কি কিছু করেছি? ক্রিকেট খেলে ১৫টা দেশ, তারা আমাদের চিনে। এরকম ক্রিকেটের মতো আমাদের আর কোথাও কি কোন পদচিহ্ন আছে? অলিম্পিকে, ফুটবলে, সিনেমা, গানে, বিজ্ঞানে, আবিষ্কারে, শিক্ষায়, চিকিৎসায়, অর্থনীতিতে কোথাও কি আমাদের এমন কোন অর্জন আছে যার জন্য তারা জানবে বাংলাদেশ আসলে কোথায়? বাংলাদেশের রাজধানী কেমন? আমরা বার বার খবরে আসি বন্যায় ডুবে, সিডরের আঘাতে, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে, রানা প্লাজা ভেঙে, হোলি আর্টিজানের খবরে... এসব খবরে পায় বলেই হয়ত তারা বাংলাদেশ নিয়ে মাথা ঘামায় না বা অবহেলা করে।

জানি অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না, বলবেন আমরা এই করেছি সেই করেছি, এই ছিড়েছি কিন্তু বিশ্বাস করেন আমরা দুনিয়া থেকে এখনো অনেক দূরে, অনেক। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি শুধু আমরা গাই না, কোথাও খুঁজে যেন কোন দিন না পাওয়া যায় সে চেষ্টাই অনবরত করছি।
কিছুদিন আগে সাবিলা নূর এক আমেরিকান অভিনেতার সাথে কথা বলার সময় বলছিল যে আমি বাংলাদেশ থেকে, তুমি হয়তো বাংলাদেশ চিনো না, এটা নিয়া বেচারিরে অনলাইনে গালিগালাজ করে শেষ। এখন এক্সট্রাকশনে ঢাকাকে রিপ্রেজেন্ট করা নিয়েও আমাদের মাথা গরম, আমরা এই সিনেমার ডিরেক্টরের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে দিচ্ছি। একজন বাংলাদেশি হিসেবে এই আবেগ থাকা দোষের না। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে দুনিয়ার এত জায়গা থাকতে একজন এ্যাকশন মুভি পরিচালক লোকেশন হিসেবে কেন ঢাকাকে বেছে নিয়েছে? ঢাকার সৌন্দর্য্য দেখাতে? ঢাকার মনোরম পরিবেশ দেখাতে? না রে ভাই, সে ইন্ডিয়া/ ঢাকা লোকেশন হিসেবে নিছেই এই কারনে যে তাতে পশ্চিমা দেশের মানুষ সহজে এই গল্প বিশ্বাস করবে। গল্পের প্রয়োজনে বা এ্যাকশন দৃশ্য দেখাতে পরিচালক হয়তো এরকম ঘিঞ্জি জায়গা খুঁজছিল প্লাস এমন একটা দেশ যেটা সম্পর্কে পশ্চিমাদের ধারনা সেখানে কোন আইন নাই, ভাল মানুষ নাই। একই কারনে মেক্সিকো কলম্বিয়া বা ব্রাজিল হলিউডের গল্পে বার বার আসছে, এই পরিচালক একটু নতুনত্ব আনতে ঢাকা পর্যন্ত গেছে। একজন বাংলাদেশি হিসেবে সিনেমাটা আমার ভালো লাগে নাই, একজন দর্শক হিসেবেও না। এই সিনেমার ঢাকা আমাদের ঢাকা না, এই সিনেমার দেশ আমাদের বাংলাদেশ না।
Nauru নামে একটা দেশ আছে যার জনসংখ্যা ১১,০০০। আপনি চিনেন এই দেশ? দেশটা কই, এর রাজধানী কই জানেন? ৯৯ ভাগ বাংলাদেশি বলবেন আপনি চিনেন না। আমাদেরও বেশীর ভাগ মানুষ চিনে না কারন ওদের ১১ হাজার লোক নিয়েও যেমন কোন আওয়াজ নাই, আমাদের ১৮ কোটি মানুষ নিয়েও কোন আওয়াজ নাই। এক গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই ভারতকে কত সুন্দর ভাবে প্রেজেন্ট করে। পেপসি, মাইক্রোসফট চালায় এখন ভারতীয়রা। এক কোরিয়ান (বং জুন হো) চারটা অস্কার পুরস্কার নিয়ে গেল কোরিয়ান ভাষায় সিনেমা বানিয়ে (প্যারাসাইট)। আর আমাদের বেশীর ভাগ প্রবাসী বিদেশে কি করেন বা করি তা বলতে চাই না, আমাদের কর্মকান্ড দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় ভাগ্যিস আমরা কোন দেশ থেকে আসছি কেউ জানে না। মালয়েশিয়া গিয়ে দেখি বেশীর ভাগ রাস্তা ঝাড়ু দেই আমরা, সিংগাপুর গিয়ে দেখি বেশীর ভাগ শ্রমিক আমরা, আমেরিকায় এসে দেখি বেশীর ভাগ ড্রাইভার আমরা। আমাদের তাইলে চিনবোটা কেমনে ভাই?
এই যে একজন পরিচালক লেখক বাংলাদেশকে এরকম বিকৃতি করে উপস্থাপন করতে পারে, এই যে একজন আমেরিকান আমাকে প্রশ্ন করে বাংলাদেশে কি কোক পাওয়া যায় তা হয়তো তাদের অজ্ঞতা, হীনমন্যতা কিন্তু আমাদের কি কোন দায় নাই? ওরা এই ভাবে বিকৃত করার সাহস পায় কি করে? আমরা কি আসলে আমাদের পরিচয় বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারছি? কোন আওয়াজ কি আমাদের আছে? করতে পারছি? করার চেষ্টা করছি?
আরও পড়ুন-