নোনা বাতাসের ঝাপটা, ফুঁসতে থাকা সাগরের উত্তাল ঢেউ, সঙ্গী নাবিকদের বিদ্রোহ, স্কার্ভি রোগে একের পর এক নাবিকের মৃত্যু- এসব পেরিয়ে একদিন ঈগলস নেস্ট থেকে ভেসে আসা চিৎকার শোনা গেল- “ডাঙা দেখতে পাচ্ছি, আমি ডাঙা দেখতে পাচ্ছি…!” এ এক রুদ্ধশ্বাস যাত্রার গল্প!

- আলফনসো!

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, নোনা বাতাসের ঝাপটা আর সাগরের গর্জন ছাপিয়ে গুরুগম্ভীর ডাকটা চীফ মেট আলফনসো গঞ্জালেসের কানে এসে পৌঁছুলো। পেছনে তাকিয়ে আপার ডেকে দাঁড়ি-গোঁফের জঙ্গলে ঢাকা মানুষটাকে দেখতে পেলেন গঞ্জালেস। ত্রিশের আশেপাশে বয়স, যদিও দেখলে খানিকটা বেশীই মনে হয়। সদাসতর্ক চোখ দুটো দেখে বোঝার উপায় নেই মাথার ভেতর কি খেয়াল খেলা করছে; গঞ্জালেস জানেন, এই বয়সেই পোড়খাওয়া মস্তিষ্কের অধিকারী এই ব্যক্তির ঝুলিতে সাগর সম্পর্কে যত জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা রয়েছে, এতটা নেই পর্তুগালের বহু বৃদ্ধ নাবিকেরও। 

মানুষটা বয়সে বছর দশেকের ছোট গঞ্জালেসের চেয়ে, নীল পানির বুকে সময়ও গঞ্জালেসই বেশী কাটিয়েছেন; তবে দূরদর্শী চিন্তাভাবনা আর সাগর নামের অদ্ভুত জগতটাকে বোঝার বেলায় এই যুবক তার চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। আর সেকারণে অন্যরকম একটা শ্রদ্ধাবোধও কাজ করে গঞ্জালেসের মধ্যে। 

-ইয়েস ক্যাপ্টেন। 
-উত্তামাশা অন্তরিপের আশেপাশেই আছি বলে মনে হচ্ছে আমার। 
-আমারও তাই ধারণা। এখানকার পানি ঘোলাটে হয় জানতাম। 
-বৃষ্টি আরো বাড়তে পারে। সন্ধ্যে নাগাদ ঝড়ে রুপ নেবে বলেই আশা করছি। তোমার কি ধারণা? 
-কোথাও নোঙ্গর করতে পারলে ভালো হতো। ‘সাও গ্যাব্রিয়েল’ আর ‘সাও রাফায়েল’ ঝড়ের ধাক্কা সামলে নিতে পারলেও, ‘সাও মিগুয়েল’ চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। 
-গ্যাব্রিয়েল আর রাফায়েলকে পাশাপাশি সমান্তরালে নিয়ে এসো। কোয়েলহোকে বার্তা পাঠাও, ও যেন নিজের জাহাজকে আমাদের মাঝে নিয়ে আসে। 
-আর মালবাহী জাহাজটা? ওটা পেছনে থাকবে? 
-না, নৌকা পাঠাও ওটায়। নুনিশকে আমার আদেশ দাও, ও যেন জাহাজ সামনে নিয়ে আসে। ঢেউয়ের ধাক্কা তাহলে সরাসরি মিগুয়েলে লাগবে না। গ্যাব্রিয়েল আর রাফায়েলের গতি কমিয়ে নিতে বলো। 

গঞ্জালেস ভাবতে থাকেন, এত দ্রুত সমাধান দিতে পারেন বলেই মানুষটার নাম ভাস্কো ডা গামা। পর্তুগালের রাজা নিজে যাকে বাছাই করেন ভারতে যাওয়ার জলপথ আবিষ্কারের কাজে। দুইশো মানুষ আর চারটে জাহাজের বহরের সর্বময় কর্তা যিনি হয়ে ওঠেন মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই।  

ভাস্কো ডা গামা নিজের কেবিনে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন। তাঁর মাথায় একটাই ভাবনা, আফ্রিকা পেরিয়ে পথের নিশানা খুঁজে বের করার কাজটা যত জলদি সম্ভব করতে হবে। বছরখানেকের প্রস্ততি নিয়ে বেরিয়েছেন তিনি, তিন মাস প্রায় শেষ হয়ে এলো। পূর্বসূরীরা যেখানে তাঁদের অভিযান শেষ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই ‘গ্রেট ফিশ রিভার’ থেকে এখনও অনেকটা দূরে তাঁর জাহাজ। চারটে জাহাজ আর শ’দুয়েক লোকবল নিয়ে তিনি লিসবন ছেড়েছিলেন ১৪৯৭ এর ৮ই জুলাই, ১৭০ জন নাবিকের পাশাপাশি ছিলেন জনাতিনেক আরবি জানা দোভাষীও। বাবা ছিলেন বিখ্যাত নাবিক, ছেলেও তাই বেছে নিয়েছিলেন বাবার পথ। সাগরের ডাক যার রক্তে, তাঁকে তো অন্য কোন পেশা থামিয়ে রাখতে পারে না। 

১৪৯২ সালে পর্তুগীজ নৌবাহিনীতে যোগ দেন ভাস্কো ডা গামা। বছর দশেক ধরেই ভারতের পথ খুঁজে বের করতে হয়রান হচ্ছে ইউরোপীয় নাবিকেরা, কিন্ত বারবার ব্যর্থতাই মিলছে। পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে পর্তুগীজ রাজা ঠিক করলেন তিনি নিজে বহর পাঠাবেন এবার; সেই সময়ের পর্তুগালের সবচেয়ে অভিজ্ঞ নাবিকদের পাঁচজনকে রাজা নিজে বাছাই করলেন এই অভিযানের জন্যে। তবে প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই পেরো দি অলেনকুইয়ের, পেদ্রো এসকোবার, জোয়াও দি কোইমব্রা কিংবা আরেক ঝানু মেট আলফনসো গঞ্জালেসকে ডিঙিয়ে এই অভিযানে তাঁর নেতৃত্ব পাবার ব্যাপারটা সবাই ভালো চোখে দেখেনি, এটাও ভাস্কো ডা গামা জানেন। তবে এসবকে তিনি পরোয়া করেন না। তাঁর সমস্ত ভাবনাজুড়ে শুধুই ভারত নামের অজানা দেশটা!

আফ্রিকার কেনেরি দ্বীপপুঞ্জ পেরিয়ে মধ্য আটলান্টিকে পড়লো পর্তুগীজ বহর, টেনেরিফ দ্বীপটাকে পাশে রেখে জাহাজ এগিয়ে গেলো বামে; কেপ ভার্দে দ্বীপপুঞ্জ অতিক্রমের পরেই প্রবল স্রোতের মুখে পড়লো ভাস্কো ডা গামার বহর। গালফের তীব্র স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে টিকে রইলো একশো বিশ টনের দুই জাহাজ সাও রাফায়েল আর সাও গ্যাব্রিয়েল। পঞ্চাশ টন ধারণক্ষমতার ছোট জাহাজ সাও মিগুয়েলও পেরিয়ে এলো চোরাস্রোতের এলাকা, এরপর বিষুবরেখা পেরিয়ে দক্ষিণ বরাবর আটলান্টিকের বুক চিরে ছুটে চললো চারটে জাহাজ, ভারত নামের ভূখণ্ডের খোঁজে। 

১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর সকালে ভাস্কো ডা গামার জাহাজের বহর উপস্থিত হলো উত্তামাশা অন্তরীপ থেকে একশো মাইল উত্তরে সেন্ট হেলেনা উপসাগরে; বাতাস তখন প্রতিকূলে বইছে, ঝোড়ো হাওয়ার সাথে বিপরীত থেকে ছুটে আসা বিশালাকৃতির ঢেউয়ের বহর ঠেলে এগিয়ে যেতে রাজী হচ্ছিলেন না নাবিকেরা, তবুও সামনেই নোঙ্গর ফেলার আশ্বাস দিয়ে নাবিকদের খানিকটা আশ্বস্ত করলেন ভাস্কো ডা গামা। 

বাইশে নভেম্বর উত্তামাশা পেরিয়ে নৌবহর জাহাজ নোঙ্গর করলো মোসেল উপসাগরের একটি দ্বীপে। সবার শেষে এলো দুইশো টনের মালবাহী জাহাজটা, সেটা দেখে বাকীদের আক্কেল গুড়ুম! সামনের পাটাতন ভেঙে পড়েছে, মাস্তুল তো পুরো ধ্বংসস্তপ প্রায়। গতি কম হওয়ায় বহরের অন্যান্য জাহাজের চেয়ে পিছিয়েই চলতো নাম না দেয়া মালবাহী জাহাজটা, উত্তামাশা অন্তরীপ পেরুনোর সময় ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়েই এই ভগ্নদশা তার। বিপদে পড়ে আলোক সঙ্কেত পাঠালেও ঘন কুয়াশা এবং বৃষ্টির কারনে অন্য জাহাজ থেকে চোখেও পড়েনি সেটা। উপায় না পেয়ে জাহাজটা ভেঙে ফেলার আদেশ দিতে হলো ভাস্কো ডা গামাকে, মালপত্রগুলো ভাগাভাগি করে তোলা হলো অন্য জাহাজগুলোতে। আবার যাত্রা শুরু হলো অজানার সন্ধানে। 

আনুমানিক ১৫ বা ১৬ই ডিসেম্বর জাহাজ তিনটে গ্রেট ফিশ রিভার অতিক্রম করলো, এখান থেকেই ভাস্কো ডা গামার পূর্ববর্তী নাবিক ডিয়াজ ফিরে গিয়েছিলেন পথের দিশা না পেয়ে। এরপরের পথের সবটুকুই এই দলের অচেনা; পঁচিশে ডিসেম্বরের বড় দিনে জাহাজ নোঙর করা হলো এক নতুন দ্বীপে, সেই জায়গার নাম ভাস্কো ডা গামা দিলেন ‘টেররা নাটালিয়া’। আফ্রিকার পুর্ব উপকূল ধরে যতোই এগিয়ে যাচ্ছে জাহাজের বহর, ততই খারাপ হচ্ছে আবহাওয়া, ফুঁসছে সাগর। নাবিকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে অসন্তোষের বীজ; একটানা সমুদ্রযাত্রা, অপরিচিত আবহাওয়া এবং বিরূপ পরিবেশই এর কারন, বুঝতে পারছেন ভাস্কো ডা গামা। নাবিকদের দুটো বিদ্রোহ দমন করা হলো, বেশ কজন হলো বন্দী। 

এই পথ ধরেই ভারতে এসেছিলেন ভাস্কো ডা গামা

১৪৯৮ সালের ১১ই জানুয়ারী মোজাম্বিক আর নাটালিয়ার মাঝামাঝি ছোট্ট এক নদীর মোহনায় এসে পৌঁছুলো জাহাজ, ভাস্কো ডা গামা এই নদীর নামকরণ করলেন ‘রিও ডে কোব্রে’ বা তাম্রনদী। আরো উত্তর দিকে এগিয়ে মোজাম্বিকের কাছাকাছি পৌঁছুল পর্তুগীজদের জাহাজ, নাবিকদের মধ্যে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়লো স্কার্ভি রোগ। অচেনা এক দ্বীপে এক মাসের মতো যাত্রাবিরতি করা হলো, সেখান থেকে জাহাজ ভরে নেয়া হলো ফলমূল আর মাংস, আপেল ফল আর লেবুও উঠলো ঝুড়ি ভর্তি করে। 

মার্চের শুরুতে জাহাজ ভিড়ল মোজাম্বিক দ্বীপে। মোজাম্বিকের অধিবাসীরা ছিলো মুসলিম ধর্মাবলম্বী, তারা ভাবলো, আরবদের মতো উজ্জ্বল চামড়ার পর্তুগীজরাও বুঝি তাই! খ্রিষ্টান পরিচয় দিলে বিপদ হতে পারে, এমন আশঙ্কায় ভাস্কো ডা গামাও আর ওদের ভুল ভাঙালেন না। মোজাম্বিকের সুলতান আনুষ্ঠানিকভাবে দেখা করলেন তাঁর সাথে, কিন্ত সুলতানকে দেয়ার মতো দামী কোন উপঢৌকন ছিলো না জাহাজে। সুলতান খানিকটা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন তাতে।

আরব বণিকদের যাতায়াত ছিলো মোজাম্বিকে, তাদের জাহাজ ভিড়তো এখানে, নানারকমের বাহারী পণ্য নিয়ে আরব সওদাগরেরা ভীড় জমাতেন আফ্রিকান উপকূলের এই বন্দরে। স্বার্থহানী হবে বুঝে আরবরাও সুলতানকে বোঝালো এই পর্তূগীজদের জায়গা না দিতে। সেটাই হলো, স্থানীয় লোকজন আরবদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে আক্রমণ করলো ভাস্কো ডা গামার জাহাজে; প্রান নিয়ে পালাতে হলো সেখান থেকে, এমনকি ধাওয়া করতে আসা নৌকাগুলোকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্যে কামানের গোলাও ব্যবহার করতে হয়েছিলো ‘সাও গ্যাব্রিয়েল’ জাহাজ থেকে। বলা হয়ে থাকে, ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ব্যবহৃত প্রথম কামানের গোলা সেটিই ছিল। 

এপ্রিলের সাত তারিখ মোম্বাসা পৌঁছুল নৌবহর, কিন্ত স্থানীয়রা সাদা চামড়ার ইউরোপীয়দের তীরে ভিড়তে দিলো না। সেখান থেকে জাহাজ ঘুরিয়ে নেয়া হলো মালিন্দিতে। এখানে দিন-দশেকের যাত্রাবিরতি করবেন, এমনটাই ইচ্ছা ভাস্কো ডা গামার। তিনি এখানে দেখা পেলেন জনাকয়েক ভারতীয় বণিকের, পরিচয় হলো আহমেদ বিন মাজিদ নামের এক আরব নাবিকের সাথে। লোকটা নিজের পরিচয় দিলেন গুজরাটি মুসলমান হিসেবে। মৌসুমী বায়ুর গতিবিধি আন্দাজ করতে এবং তারা দেখে দিকনির্ণয়ের কাজে মাজিদ ছিলেন দারুন পারদর্শী; এর আগ ভারতের কালিকট বন্দরেও গিয়েছেন বলে দাবী করলেন নিজেকে। তাই মাজিদকে সঙ্গে নেবেন বলে ঠিক করলেন ভাস্কো ডা গামা। দশ দিনের বিরতি ছয় দিনে নামিয়ে জাহাজ আবার ছুটে চললো ভারতের খোঁজে, মাজিদ যাকে বর্ননা করেছেন গরম আর মশলার দেশ বলে। 

সেদিন ছিলো চব্বিশে এপ্রিল, ১৪৯৮। মে মাসের বিশ তারিখ, ভোর বেলা। মাস্তলের ওপরে লাগানো ঈগলস নেস্টে সারাক্ষণ দূরবীন নিয়ে বসে থাকে এক নাবিক, দূরে কোথাও জাহাজ কিংবা ডাঙা দেখা গেলে চিৎকার করে জানান দেয় সে। ভাস্কো ডা গামার চোখ লাল, সারারাত ঘুমাননি তিনি। সেক্সট্যান্ট (দিক নির্ণয়ে ব্যবহৃত যন্ত্র), কম্পাস আর লগবুক নিয়ে পড়েছিলেন রাত থেকেই, কোথাও হিসেবে ভুল হচ্ছে কিনা মিলিয়ে দেখছিলেন। মাজিদের হিসেব মতে আরো দিন তিনেক আগেই ভারতের পশ্চিম উপকূলের দেখা পাবার কথা, দিক ভুল করে অন্য কোনদিকে চলে যাচ্ছে না তো জাহাজ?

এমন সময় চিৎকারটা শুনতে পেলেন ভাস্কো ডা গামা। ঈগল’স নেস্ট থেকে লোকটা একনাগাড়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে- “ডাঙা দেখতে পাচ্ছি, আমি ডাঙা দেখতে পাচ্ছি...” জাহাজের ডেকে উঠে এলেন ভাস্কো ডা গামা, মাজিদকেও দেখলেন পাশে। আরো আধ ঘন্টা পর আকৃতিটা স্পষ্ট হয়ে এলো চোখের সামনে, একচোখা দূরবীন দিয়ে ভাস্কো ডা গামা দেখতে পেলেন, কালিকট নামের বন্দরটার ঘুম ভাঙছে, আড়মোড়া ভেঙে উঠছে কোন এক রূপসীর বেশে। 

জীবনে কোন দৃশ্য দেখে এতটা সুন্দর লাগেনি ভাস্কো ডা গামার! 'অবশেষে'- আনমনেই বললেন এই পর্তুগীজ। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে তাঁর পূর্বপুরুষেরা দুইশো বছর ধরে ভারতের জলপথ আবিষ্কারের যে প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছিলেন, সেটা আজ সফল হলো ভাস্কো ডা গামার হাত ধরে! তৃপ্তির হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে নাবিকদের নোঙর তৈরী করার আদেশ দিলেন পর্তুগীজ ক্যাপ্টেন।  

পরিশিষ্ট- ভাস্কো ডা গামার আগমনের সময়ে কালিকট ছিলো দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত বন্দর, এখানকার রাজা ছিলেন সামুথিরি। ইউরোপীয় দূত হিসেবে ভাস্কো ডা গামা ও তাঁর সঙ্গীদের জানানো হলো অভ্যর্থনা, রাজার সাথে দেখা করে ভাস্কো ডা গামা তাকে উপহার দিলেন পর্তুগাল থেকে আনা উপহারসামগ্রী। কিন্ত স্বর্ণ বা রূপার কোন উপহার নেই দেখে রাজা যথেষ্ট বিস্মিত হলেন। ভারতে তখন আরব বণিকদের নিয়মিত যাতায়াত, আরবরা রাজা সামুথিরিকে বোঝালেন, ভাস্কো ডা গামা আদতে কোন রাজপ্রতিনিধি নন, বরং জলদস্যু হবেন হয়তো। 

ভাস্কো দা গামা চেয়েছিলেন রাজার সাথে একটি বাণিজ্যচুক্তি করতে, যাতে পর্তুগীজ জাহাজগুলো শুল্কমুক্তভাবে পণ্য নিয়ে আসতে পারে এই এলাকায়, কিন্ত রাজা সেই চুক্তি করতে রাজী হলেন না তার আরব ব্যবসায়ী বন্ধুদের কথা শুনে। ভাস্কো ডা গামার নিজেরও মন টিকছিলো না এই অজানা বিদেশ বিভূঁইয়ে, তাই সে বছর ২৯ আগস্ট পাল তুললো পর্তুগিজ নৌবহরের তিনটে জাহাজ। ফিরতি পথের অশান্ত সাগর, বিরূপ আবহাওয়া আর স্কার্ভির প্রকোপ এড়িয়ে ভাস্কো ডা গামা লিসবন পৌঁছুলেন পরের বছর সেপ্টেম্বরের নয় তারিখে। 

১৭০ জন নাবিক আর চারটি জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করা বহরে তখন অবশিষ্ট আছে দুটো মাত্র জাহাজ, প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছিলেন মাত্র চুয়ান্ন জন নাবিক! মারা যাওয়াদের দলে ছিলেন ভাস্কো ডা গামার আপন ছোট ভাই পাওলো ডা গামা, যিনি ছিলেন ‘সাও রাফায়েল’ জাহাজের ক্যাপ্টেন।

দুই বছরে প্রায় সাতশো দিন সরাসরি সাগর নামের দানবের সাথে যুদ্ধ করে ভাস্কো ডা গামা আবিষ্কার করেছিলেন ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষে আসার সরাসরি জলপথ, চব্বিশ হাজার মাইল জলভ্রমণ করেছেন, চষে বেড়িয়েছেন প্রশান্ত হয়ে আটলান্টিক থেকে ভারত মহাসাগরের বুক। তাঁর দেখানো পথ ধরে বিপুল সম্পদের এই ভূখণ্ডে ছুটে এসেছে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর নাবিকেরাও। 

১৫০২ সালে পনেরোটি জাহাজ আর যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আবার ভারতে এসেছিলেন তিনি, কোচিনে স্থাপন করেছিলেন পর্তুগীজ বাণিজ্যকুঠি। পরে ১৫২৪ সালে পর্তুগীজ ভাইসরয় হয়ে তৃতীয়বার এই দেশে পা রেখেছিলেন তিনি। সে বছরই চব্বিশে ডিসেম্বর একটি বাণিজ্যকুঠি পরিদর্শন করতে গিয়ে কোচিনে মৃত্যু হয় ভাস্কো ডা গামার।  

তথ্যসূত্র- 
১/ http://www.history.com/topics/exploration/vasco-da-gama 
২/ http://exploration.marinersmuseum.org/subject/vasco-da-gama/ 
৩/ https://sourcebooks.fordham.edu/mod/1497degama.asp 
৪/ http://www.bbc.co.uk/history/historic_figures/da_gama_vasco.shtml 
৫/ http://onushilon.org/corita/vasko-da-gama.htm

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা