বাল্যবিবাহ ভেঙ্গে পালানো মেয়েটা এখন এসএ গেমসের স্বর্ণজয়ী!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মাত্র বারো বছর বয়সে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার, কিন্ত সেই বিয়ে ভেঙে পালিয়েছিলেন তিনি। চৌদ্দ বছরের কিশোরী মেয়েটা বাঘা বাঘা সব প্রতিযোগীকে হারিয়ে এসএ গেমসের আর্চারিতে জিতে নিয়েছেন স্বর্ণপদক!
যার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল, কারমা নামের সেই ভূটানি আর্চার কারমা আগামী অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। চৌদ্দ বছরের ইতি সেটা জানতেনও না। অবশ্য, এতকিছু জেনে তার কাজও নেই, যেটার তার করণীয়, মনঃসংযোগ অটুট রেখে লক্ষ্যে তীরটাকে বিদ্ধ করা- সেই কাজে তিনি সফল। প্রতিপক্ষকে ৬-০ সেট পয়েন্টের ব্যবধানে উড়িয়ে নিজের দায়িত্বটা দুর্দান্তভাবে পালন করেছেন, স্বদেশী রোমান সানার সঙ্গে জুটি বেঁধে আর্চারির 'রিকার্ভ মিশ্র ইভেন্টে' দেশকে স্বর্ণপদক এনে দিয়েছেন এসএ গেমসে। অথচ এই মেয়েটার হয়তো নেপালে যাওয়াই হতো না, যদি বছর দুয়েক আগে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সাহসটা ইতি না করতো!
ইতির বয়স এখন চৌদ্দ। যে গল্পটা বলবো এখন, সেটা আজ থেকে দুই বছর আগের। বারো বছর বয়স তখন ইতির, ক্লাস সিক্সের ছাত্রী সে। বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করা হলো তার। শুনে যারা চমকে উঠছেন, তাদের জন্যে জানিয়ে রাখি- বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনও এগারো-বারো বছর বয়সে ভুরি ভুরি মেয়ের বিয়ে হয়। সরকারী আইন-কানুন চলে না সেসব জায়গায়, বা আইনের ফাঁক দিয়ে নানা অনিয়ম করে বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়।
ইতির গল্পে ফিরে যাই, চুয়াডাঙ্গার মেয়ে ইতির বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল ২০১৬ সালে। ইতি বিয়ে করতে চায়নি, সে পড়ালেখা করতে চেয়েছিল, ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিল। কিন্ত কে শোনে কার কথা! স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে শখের বশে আর্চারিতে হাত পাকাতো ইতি, কিন্ত খেলাটাকে সিরিয়াসলি নেবে, এমনটা তার মাথায় কাজ করেনি কখনও।
আর্চারিতে ইতির স্বভাবজাত প্রতিভাটা চোখে পড়লো কাজী রাজীব উদ্দিনের, ভদ্রলোক আর্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। তাকে ইতির প্রতিভার খোঁজ দিয়েছিলেন তার বড় ছেলে, তিনিও আর্চারির সঙ্গে যুক্ত। চুয়াডাঙ্গায় ইতির ক্যাম্পে কোচ ছিলেন সোহেল রানা, তিনিও ইতির প্রশংসা করলেন। একরকম বিয়ের আসর থেকেই ইতিকে ঢাকায় নিয়ে এলেন আর্চারি ফেডারেশনের কর্মকর্তারা। কাজী রাজীবউদ্দিন স্মৃতিচারণ করছিলেন সেসব দিনের-
“ওর বাবা-মা ওকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। বলতে গেলে বিয়ের পিঁড়ি থেকে ওকে তুলে আনা। ওর বিয়ের প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু ওর চিন্তা ছিল পড়াশোনা করা। আর্চার হওয়ার ইচ্ছা ছিল না হয়ত, কিন্তু ওপরে ওঠার ইচ্ছা ছিল। এখন সে দেশ বরেণ্য আর্চারে পরিণত হয়েছে।”
“পড়াশোনা করবে বলেই সে বিয়ের আসর থেকে উঠে গিয়েছিল। সে তখন সুযোগ খুঁজছিল কিভাবে পালাবে। বিয়েটা যেন না হয়। আমাদের ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগামটা তার জন্য একটা উপলক্ষ্য ছিল। তার বো ধরা ও দাঁড়ানোর স্টাইল দেখলে আমাদের কোচরা বুঝে ফেলেন যে সে ভালো আর্চার হবে। তখন তীরন্দাজ সংসদ তাকে দলে নেয়।”
ইতি হাল ছাড়েননি, নিজেকে পরিণত করেছেন সময়ের সাথে সাথে। চৌদ্দ বছর বয়সে তারচেয়ে অনেক সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে এসএ গেমসের মতো টুর্নামেন্টে যে কেউ খেলার সুযোগ পায় না ইতি দারুণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েই সুযোগটা পেয়েছিলেন, স্বর্ণপদক জিতে সেটার প্রতিদানও দিচ্ছেন। রোমান সানা বা অন্য কারো মতো হতে চান না তিনি, চান নিজের মতো হয়ে বিশ্বজয় করতে, নিজের একটা সিগনেচার স্টাইল তৈরি করতে।
দলগত ইভেন্টে স্বর্ণ জিতেছেন, জিতেছেন মিশ্র ইভেন্টের স্বর্ণপদকও। তবুও ইতি নির্লিপ্ত, আনন্দের বহিঃপ্রকাশ তিনি করতে চাইলেন না, বললেন, এককের স্বর্ণপদক জিতেই যা বলার বলবেন। নিজের অতীত সংগ্রাম নিয়েও মুখ খুলতে চান না ইতি, সেসব ভুলে শুধু আর্চারি নিয়েই বেঁচে থাকতে চান, শাণিত তীরন্দাজে পরিণত করতে চান নিজেকে। বারো বছর বয়সে যে মেয়েটা অকল্পনীয় একটা যুদ্ধে জয়ী হয়ে এসেছে, তার জন্যে তো এটা অসম্ভব কিছু নয়!