ইংরেজদের উচ্চারণে ইংরেজি না বলাটা কি অপরাধ?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

একটা বাচ্চা মেয়ে কিভাবে ইংরেজদের মতো ইংরেজি বলতে হবে শেখাচ্ছে- এই ভিডিও ফেসবুকে ঘুরে ফিরছে। আমার চোখেও পড়েছে।
সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে'ই হয়ত ভিডিওটা দেখছে এবং আমি মোটামুটি নিশ্চিত, বেশিরভাগ সবাই ভাবছে- আমাদেরও ইংরেজদের মতো ইংরেজি বলতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ইংরেজদের মতো উচ্চারণে কেন আমাদের ইংরেজি বলতে হবে? আপনি ইংরেজি ভাষা শিখতে পারেন। আমাদের দেশে তো ক্লাস ওয়ান থেকে ১২ ক্লাস পর্যন্ত ইংরেজি এমনিতেই শেখানো হয়। ইংরেজি যেহেতু একটা আন্তর্জাতিক ভাষা, সেটা শেখা যেতেই পারে। কিন্তু তাই বলে ইংরেজদের মতো উচ্চারণে'ই কেন শিখতে হবে?
খোদ ইংল্যান্ডে যে এতো এতো ভারতীয় থাকে, তারা তো ভারতীয় ইংরেজি উচ্চারণে'ই ঘুরে বেড়াচ্ছে, চাকরি করছে! আফ্রিকানদের নিজস্ব উচ্চারণ আছে। তারাও তো সেই উচ্চারণেই কথা বলছে। লন্ডন শহরে গেলে বুঝা যায়- জগত জুড়ে এক ইংরেজি ভাষার কতো রকম উচ্চারণ আছে। তাই বলে তো কেউ তাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে না। বরং এটাই এখন লন্ডন শহরে প্রচলিত হয়ে গিয়েছে।
আমি যে সময়ে বড় হয়েছি, তখন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ছিল না বললেই চলে। পুরো বাংলাদেশেই হয়ত চার-পাঁচটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ছিল। আমি কিংবা আমরা ভাই- বোনরা সবাই তো বাংলা মাধ্যমেই পড়াশুনা করেছি। আমরা কেউ ইংরেজদের মতো করেও ইংরেজি বলি না। এর মানে তো এই না- আমরা ইংরেজি জানি না কিংবা বুঝি না। যত টুকু জানা কিংবা বুঝা দরকার সেটা আমরা শিখেছি। আলাদা করে ইংরেজদের মতো ইংরেজি বলা শিখতেও আসলে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু সেটা আপনি শিখতে পারেন- যদি আপনার খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ না থাকে।
ধরুন আপনি দেশের বাইরে চাকরি করবেন। আপনাকে তো অবশ্য'ই ইংরেজি জানতে হবে। কারন এটাই আন্তর্জাতিক ভাষা। এখন যারা আপনাকে চাকরি দিবে- তারা তো অবশ্য'ই দেখবে আপনি ইংরেজি বলতে পারেন কিনা কিংবা বুঝতে পারেন কিনা। এটা তো যোগাযোগের মাধ্যম।, কিন্তু তারও আগে দেখবে- আপনি যেই কাজটি করবেন, সেটা পারেন কিনা।
আমার পরিচিত এমন অনেক আইটি বিশেষজ্ঞ কিংবা ইঞ্জিনিয়ার অথবা অন্যান্য পেশার লোকজন আছে, যারা মোটেই ইংরেজ কিংবা আমেরিকানদের মতো ইংরেজি বলে না। ইন ফ্যাক্ট, খুব ভালো ইংরেজিও বলে না। চালিয়ে নেবার মতো। কিন্তু তারা তাদের কাজটা ভালো পারে। যার কারনে তারা ইউরোপ-আমেরিকায় ভালো ভালো জায়গায় চাকরি করছে।
ব্যাপারটা অনেকটা এমন- ধরুন আপনার বাসায় জানালা ঠিক করতে হবে। এখন মিস্ত্রী এসে খুব চমৎকার করে শুদ্ধ ভাষায় আপনার সঙ্গে কথা বলছে। আপনি বেশ অভিভূত হলেন। কিন্তু মিস্ত্রী ভদ্রলোক জানালা ঠিক করতে পারলেন না! তাহলে আপনি কি তাকে কাজে ডাকবেন আর? ধরুন- আপনার বাসায় আপনি একজন বুয়া ঠিক করেছেন। বুয়া ভদ্রমহিলা বেশ গুছিয়ে কথা বলে। কিন্তু ঘরটা ভালো করে কি করে গুছিয়ে রাখতে হয় কিংবা ঝাড়ু দিতে হয়, সেটাই জানে না! তাহলে কি ফায়দা হবে? আপনার কি স্মার্ট মিস্ত্রী কিংবা বুয়া দরকার নাকি সঠিক কাজটা যে জানে, তাকে দরকার?
দেখুন, ইউরোপ-আমেরিকায় যারা চাকরি দেয়- তারা দেখে আপনি কাজটা পারেন কিনা। আপনি কতো সুন্দর করে কথা বলছেন, সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয় না। আপনি যদি কথা বুঝতে পারেন এবং বলতে পারেন; তাহলেই চলবে। আলাদা করে ইংরেজদের মতো করে কথা বলার দরকার নেই।
আমি নিজেই তো প্রায় ৭ বছর হয় ইউরোপে শিক্ষকতা করছি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন পর্যন্ত বোধকরি পৃথিবীর প্রায় ৪৯টা দেশ থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়েছি। থিসিস সুপারভাইজ করেছি। আফ্রিকার নাইজেরিয়া-ক্যামেরুন-ঘানা, আমেরিকার মহাদেশের কলোম্বিয়া, পেরু, আমেরিকা কিংবা ইউরোপের ইংল্যান্ড, স্পেন-ইতালি, জার্মানি থেকে শুরু করে ভারত-পাকিস্তান, বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের আমি পড়িয়েছি কিংবা পড়াচ্ছি।
আমি তো কোন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়িনি জীবনে। আমি ইংরেজদের মতো করে ইংরেজিও বলি না। কিন্তু ঠিক যত টুকু বললে বুঝানো যাবে কিংবা আমি নিজে বুঝবো; তত টুকু আমি জানি। অর্থাৎ চালিয়ে নেবার মতো বলতে পারি। নানান দেশ থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদেরও নানান সব ইংরেজি উচ্চারণ। প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম- কি করে বুঝবো। এরপর মানিয়ে নিয়েছি। এখন কিন্তু ঠিক'ই বুঝতে পারি। ওরাও নিশ্চয় পারে।
ভাষা জানা কেবল একটা স্কিল। এটা মোটেই মুল কোন স্কিল নয়। ইংরেজি ভাষাটা জানার দরকার, কারন এটি আন্তর্জাতিক ভাষা। বিদেশে পড়তে গেলে কিংবা চাকরি করতে গেলে, এই ভাষা জানার দরকার আছে।, এই যেমন আমি অতি সাধারণ বাংলা মাধ্যমে পড়েই সেটা জেনেছি। আলাদা করে ইংরেজি মাধ্যমে যেতে হয়নি। আলাদা করে ইংরেজদের মতো করেও ইংরেজি শিখতে হয়নি।
এর চাইতে বরং মুল যেই কাজ, নিজের সাবজেক্টে পড়াশুনা কিংবা টেকনিক্যাল বিষয় গুলোতে নজর দেয়া যেতে পারে। ইংরেজদের মতো ইংরেজি বলে কেবল বাংলাদেশের মতো দেশে স্মার্ট হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবেন। কিন্তু খোদ লন্ডন শহরে আপনি ভাত পাবেন না! যদি না, আপনার সত্যিকারে কোন একটা বিষয়ে স্কিল থাকে!
আমি বুঝতে পারি- শত বছরের উপনিবেশিক মন-মানসিকতা আমাদের আছে। আমাদের বাবা-মায়েরা মনে করে- ভালো করে একটু ইংরেজি বললেই বিশাল কিছু! আমাদের সমাজও কেউ একটু ভালো ইংরেজি বললে, তাকে স্মার্ট মনে করে! ইংরেজি কেবল একটা ভাষাই। আপনি সেটা শিখতে পারেন, সমস্যা নেই। আমরা সবাই সেটা স্কুল থেকেই শিখি। কিন্তু যেই ইংরেজি শিখতে গিয়ে যদি নিজের দেশ "বাংলাদেশ'কে" কিভাবে ইংরেজদের মতো করে উচ্চারণ করতে হবে শিখতে হয়! সেই ইংরেজি শেখার দরকার নেই।
সেটা ইংরেজরা আমাদের কাছ থেকে শিখবে- কিভাবে "বাংলাদেশ" উচ্চারণ করতে হয়। আমাদেরকে কেন ইংরেজদের মতো করে বাংলাদেশ উচ্চারণ করা শিখতে হবে? এইসব ব্যাপার এখন আবার দেখছি নানা সব অন লাইন স্কুল- মোটিভেশনাল স্পীকার'রা শেয়ার দিচ্ছে! উৎসাহিত করছে- শেখার জন্য!
কাজের কাজটা আগে শিখুন। পাশের দেশ ভারতীয়রা নিজদের উচ্চারণে ইংরেজি বলেই পৃথিবীর নামি-দামী কোম্পানিতে চাকরি করছে। এমনকি যেই ভদ্রলোক গত বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছে, সেই বাঙালি ভারতীয়-আমেরিকানও কিন্তু ভারতীয় উচ্চারণে ইংরেজি বলে! আর আমরা আছি- কিভাবে ইংরেজদের মতো করে ইংরেজি বলতে হবে!
এইসব লোক দেখানো ইংরেজি বলা কিংবা স্মার্ট'নেস বাংলাদেশেই কেবল বিদ্যমান। কাজের কাজ কিছু পারি না আমরা- আছি কেবল লোক দেখিয়ে কিভাবে স্মার্ট হওয়া যাবে!