অধিকাংশ মানুষের কাছে নিজের বিশ্বাসটাই হলো বড় ধর্ম। কেন মানুষ কোনো বিশ্বাসকে জোর করে ছড়িয়ে দিতে চায়? সম্ভবত বিশ্বাসকে চাপিয়ে দেয়ার মধ্যে নিজের দূর্বলতা কিংবা হীনমন্যতাকে জোর করে লুকিয়ে রাখার একটা প্রবণতা কাজ করে...

জটিল উদাহরণ না দিয়ে সহজ একটা কথা বলি। দুইজন তীব্র ফুটবলপ্রেমীর একজন মনে করে মেসি সেরা খেলোয়াড়। আরেকজনের বিশ্বাস রোনালদো মেসির চেয়ে ভাল পারফর্মার। এখানে তেমন দোষের কিছু নেই। কিন্তু, মেসি/রোনালদো সেরা এই মতবাদ আরেকজনকেও জোর করে কেনো গেলানো লাগবেই? সত্যি বলতে এইসব যুদ্ধ যারা করেন, তারা মেসি কিংবা রোনালদোর জন্য যুদ্ধটা করেন না। তারা শুধু নিজের বিশ্বাসের পক্ষে যুদ্ধ করেন।

যখন কেউ ভিন্ন মত জানায়, তখন এই ভিন্নমত তার অস্তিত্বে গিয়ে আঘাত দেয়। এমনভাবে হিংস্র হয়ে তখন সে মেসি বা রোনালদোর পক্ষে যুদ্ধে নামে যেন এই যুদ্ধে হেরে গেলে মেসি - রোনালদোও হেরে যাবে। আসলে, তার অবচেতন মন ভেবে নেয়, এটা তার নিজেরই পরাজয়। আরেকজন ভিন্ন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে সেটাকে ফেস করার জন্য যে সাহস দরকার সেটা সে হারিয়ে ফেলেছে বহু আগে। কারণ, তার মন নির্দিষ্ট গতিপথে চিন্তা করতে শিখেছে। প্রশ্নকে এড়িয়ে যেতে শিখেছে। সে ভেবেছে, সে যা জানে, যা ভাবে সেটাই সর্বোত্তম।

ধর্মের বিবাদগুলো খেয়াল করলেও দেখা যাবে, মানুষ ব্যক্তিগত ভয় এবং স্বার্থপর অবস্থান থেকে বিবাদগুলো বাড়ায়। ভারতে গো-মাংস খাওয়ার অপরাধে যে মুসলমানকে মরতে হয় কিংবা বাংলাদেশে হিন্দু হওয়ার কারণে যার ঘর বাড়ি পুড়ে তারা কেউই মূলত ধর্মের কারণে প্রাণ দেয় না। তাদের এই পরিণতি কিছু ভীতু মানুষের হীনমন্যতার ফসল।

যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে হিংস্রতা করে, তাদের কোনো ধর্ম নেই কথাটা ঠিক না। তাদের বিশ্বাসটাই তাদের ধর্ম। এতে করে তারা সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করে? সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসের প্রমাণ দেয়? তারা আসলে শুধু নিজের বিশ্বাসকে বিশ্বাস করে। 

রাজনৈতিক বিশ্বাসগুলোও একইরকমে কাজ করে। ধরুন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ রাজনৈতিক নেতাদের জন্য পাথেয়। এখন এই আদর্শের কথা মুখে বলে বাজে কাজ যারা করে, তারা কি আসলে আদর্শকে সার্ভ করেন নাকি নিজেদের স্বার্থকে? আপনি যদি এদেরকে ভুল ধরিয়ে দিতে চান তাহলে এরা আপনাকে আদর্শবিরোধী, বিদ্রোহী ইত্যাদি বলে একঘরে করে দিতে পারে।

ধর্মের নামে যারা অকর্ম করে তারা কিন্তু কোনোভাবেই ধর্মকে সার্ভ করে না। তারা নিজেদের অকর্মের ঢাল হিসেবে ধর্মকে হাতিয়ার করে। এদেরকেও প্রশ্ন করলে এরা সদোত্তর দেয়ার বদলে আপনাকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে দিতে পারে। কট্টর নারীবাদী লেখাগুলো খেয়াল করলে দেখা যায়, কোনো নারী প্রবল পুরুষ বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রেখেও অনেক সমর্থন পাচ্ছে। আবার এই নারীবাদীতাকেই আক্রমণ করেও অনেকে প্রচুর সমর্থক পান।

এসব থেকে কী প্রমাণ করার চেষ্টা হয় শেষ পর্যন্ত? নারীর অধিকার, সম্মান, বোধ এসবের জন্য লড়াই করতে পুরুষ বিদ্বেষকে হাতিয়ার করা কিংবা কোনো নতুন '__বাদ' প্রতিষ্ঠা কিংবা তার কট্টর বিরোধীতা জরুরি কেন হয়? মূলত সকল কট্টরপন্থীদের অস্ত্র একইরকম। প্রশ্ন করলেই আপনাকে কিছু একটা ব্লেম দিয়ে একঘরে করে অপদস্ত করা হতে পারে সম্মিলিতভাবে। 

কেন এমন হয়? আসলে মাথায় কিছু না থাকলেও অনেকজন মস্তিষ্কহীন মানুষ একটা বিশ্বাসের পক্ষে দাঁড়ালে সেটা শক্ত ভিত্তি পায়। একারণে, বিশ্বাসটা যতটা বিশ্বাসজনক, যুক্তিযুক্ত তারচেয়ে বেশি দরকার হয়, কতজন এই বিশ্বাসের স্বপক্ষে আছে সেটা দেখানো। এখানে, যার হাতে ক্ষমতা সে একটু বাড়তি এডভান্টেজ পায়। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা একটু এডভান্টেজ পায়।

এই কারণে খেয়াল করে দেখবেন, মুসলিম প্রধান দেশে ধর্ষণকে কেউ পোষাকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সেই মতবাদ সমর্থন করার লোক অনেক পাওয়া যায়। হিন্দু অধ্যুষিত দেশে গোমাংস ভক্ষণ করার বদলে কল্লা কর্তন করে দিলেও তাতে অনেকের সমর্থন থাকে। সাদা মানুষের দেশে কালো মানুষদের হেয় করাটাকে অস্বাভাবিক লাগে না। মোহমুক্তির বার্তা প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী লোকেদের দেশে যদি সংখ্যালঘু কারো উপর হামলা হয়, তাতে মোহমুক্তি না হলেও বিশ্বাসের জোর দেখানো যায়।

এতটা স্বার্থপরতা নিয়ে কী এচিভ করতে চাই আমরা? কি অদ্ভুত লাগে..দুনিয়াকে যারা নরক বানিয়ে দিচ্ছে তারাই স্বর্গের স্বপ্ন দেখে সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীকে যারা বসবাসের অনুপযুক্ত করে দিচ্ছে তারা ভাবে তাদের অস্তিত্ব সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হবে। হায়রে! ধ্বংসের বীজ বুনে স্বর্গ কিভাবে তৈরি করা যায় আমার বুঝে আসে না একটুও...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা