কক্সবাজারের জেলেরা কিছু ডলফিন পিটিয়ে মেরে ফেলেছিলো বেশ ক'দিন আগেই। সেটা নিয়ে পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। আমরা তিরস্কারও করেছি এই অমানুষগুলোকে। কিন্তু সেই একই কক্সবাজারেই সম্প্রতি হয়েছে এক অসাধারণ কাজ৷
আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজফিডই বলি অথবা সংবাদপত্রের শিরোনাম, সবখানেই মানুষের বর্বরতার খণ্ড খণ্ড চিত্র আমরা প্রতিদিনই পাই। মানুষের ওপরে মানুষের বর্বরতা তো আছেই। হিংস্রতার আঁচ মানুষ পেরিয়ে বনের বাঘ, হাতি, ঘরের বিড়াল অথবা সমুদ্রের ডলফিনের ওপরেও চলে আসে। আমরা বিব্রত হই, বিরক্ত হই, হই বিষন্নও। আবার এরমধ্যে দুয়েকটা সংবাদে আমাদের সন্তুষ্টি দেয়। এই সেদিন শুনলাম, তামিলনাড়ুর একটি গ্রামে ৩৫ দিন ধরে আলো জ্বালেননি গ্রামবাসী, শুধু একটি বুলবুলি পাখির বাচ্চা ভূমিষ্ট হওয়ার জন্যে! এরকমই আরেকটি ঘটনা নজর কাড়লো সম্প্রতি। সে ঘটনার জন্যে যেতে হবেনা বিদেশে। ঘটনাটি ঘটেছে আমাদের দেশেই, কক্সবাজারে।
কক্সবাজারে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে রহস্যজনকভাবে প্রায় ৫০ টনেরও বেশি বর্জ্যপদার্থ সমুদ্র থেকে তীরে চলে আসে৷ স্থানীয় মানুষজন এই বর্জ্যের উৎস ঠিক কোথায়, সেটি ধারণাও করতে পারেননা। সবাই-ই পুরোদস্তুর অবাক। কারণ গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে এরকম বিপর্যয় তারা আর দেখেননি। এত বিশাল ময়লার স্তুপ, যা প্রায় দশ কিলোমিটার জুড়ে সমুদ্রতটকে গ্রাস করে ফেলেছে, সেটা তাদের ভাবনারও অতীত ছিলো আগে। এবং এই ময়লার তালিকায় কী নেই! প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ব্যাগ, তারের স্তুপ, মাছ ধরার জাল সব আছে এই বর্জ্যের মিছিলে।
ময়লার স্তুপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সামুদ্রিক প্রানীগুলোর। সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ সহ অজস্র প্রাণী মারা গিয়েছে এই ধ্বংসযজ্ঞে। তবে এরমধ্যেও সবচেয়ে বেশি মৃত্যুহার বোধহয় কচ্ছপের। কচ্ছপের শারিরীক গঠনের কারণেই এসব বর্জ্যের কারণে তার মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। কখনো কী কেউ আপনার মাথাকে পলিথিনে মুড়িয়ে দমবন্ধ করার চেষ্টা করেছে? তাহলে যেরকম লাগে, কচ্ছপদেরও ঠিক সেরকমই হয়। যেকোনো পলিথিন বেকায়দাভাবে কচ্ছপের শরীরে জড়ালে মৃত্যু একরকম নিশ্চিতই হয়ে যায়। এবারে সেই হার যেন বেশি। কয়েকটা অতিবিপন্ন প্রজাতি, যেমন অলিভ রাইডলি সি টার্টলস, যারা সারা পৃথিবীতেই বিপন্ন, সেরকম কচ্ছপও মারা গিয়েছে এই বর্জ্যের কারণে। যারা মারা যায়নি তারা মুমূর্ষু অবস্থায় এসেছিলো সমুদ্রতীরে।
স্থানীয় মানুষজন এরপরেই উঠেপড়ে লাগে এই কচ্ছপদের বাঁচানোর জন্যে। ছুটে আসে অসংখ্য মানুষ৷ কচ্ছপগুলোর শরীর থেকে বর্জ্যের, পলিথিনের স্তুপ সরিয়ে, যেসব কচ্ছপ একটু বেশি মুমূর্ষু তাদের শুশ্রূষা দিয়ে আবার ফেরত পাঠায় সমুদ্রে।
এই খবরটুকু জেনে খুব শান্তি পেয়েছি আসলে। যেই মানুষজন বর্বরতার নিত্যনতুন নিদর্শন স্থাপিত করছে প্রতিদিনই, সেই মানুষজনই আবার লিখছে ভালোবাসার উপাখ্যান। এগুলো ভেবেও ভালো লাগে অন্তরাত্মার কোথায় যেন। বুঝি, পৃথিবীতে ভালো মানুষ নেহায়েতই কম নেই। তারা প্রকাশ্যে অতটা আসেনা বলেই আমরা বুঝে উঠতে পারিনা তাদের প্রকৃত সংখ্যা।
তবে বিরক্তও লাগে সেসব অকালকুষ্মান্ড মানুষদের ওপরে যাদের ফেলা বর্জ্যের কারণে সমুদ্রতীরে এই বিপর্যয় সৃষ্টি, যাদের কারণেই মরে গেলো এতগুলো প্রানী। আমাদের দায়বোধ আমরা ঠিক তো জানিইনা। সে সাথে বুঝিওনা। প্রতিদিনই নষ্ট করি আমাদের আশেপাশের পরিবেশ। একারণেই হয়তো কর্তৃপক্ষ কক্সবাজারে বোর্ড ঝুলাতে বাধ্য হন, যেখানে লেখা-
The Place was beautiful, before your arrival.
এবার থেকে সমুদ্রে একটি চিপসের প্যাকেট ফেলার আগেও দুইবার ভাববেন যে, এই চিপসের প্যাকেটটাও মৃত্যু ঘটাতে পারে এক সামুদ্রিক প্রাণীর। নাহয় ধরে নেবেন, এই বাস্তুসংস্থান নষ্ট করার পেছনে আপনি নিজেও অনেকটা দায়ী, যেমনটা দায়ী বাকি সবাই। আপনার মুখে তখন মানবতার গল্প একদম মানাবে না৷
একদম না৷
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন