এদের মধ্যে কারো কাছে নির্বাচনে অংশ নেয়াটা নেশার মতো। ব্যালট পেপারে নিজের নাম দেখেই তারা খুশি, এর বেশি আর কিছু তাদের চাওয়ার নেই। মানুষের তো কত রকমের শখ থাকে, এদের শখ নির্বাচনে অংশ নেয়া।

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে ঢাকা এখন সরগরম। আমার বাসার নিচেই একটা মাইক লাগানো আছে, সেখানে প্রায় সারাটা দিন কোন এক জাহাঙ্গীর ভাইয়ের গুণগান গাওয়া হয়, বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় সব গানে তার নাম লাগিয়ে বাজানো হয় একের পর এক। ঢাকার আকাশ ছেয়ে গেছে মেয়র আর ওয়ার্ড কমিশনার পদ প্রার্থীদের সাদাকালো পোস্টারে। কিন্ত এদের মধ্যে কতজন সিরিয়াসলি ভোটের মাঠে নেমেছেন, আর কয়জন শখের বশে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন, সেই খবর কি কেউ রাখে? 

দুই সিটি কর্পোরেশনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট চৌদ্দ জন প্রার্থী। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সমীকরণ, তাতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির চারজন প্রার্থীর বাইরে যে দশজন মেয়র পদে লড়াই করার জন্যে মনোনয়ন নিয়েছেন, তাদের আত্মবিশ্বাস দেখে নিজের কাছেই অবাক লাগে। গত কয়েক বছর ধরে ভোটের যে সংস্কৃতি, তাতে বিএনপির প্রার্থীই প্রস্তুত হয়ে থাকেন মাঝপথে কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন বয়কট করার জন্যে। এর মধ্যে এই লোকগুলো কী করে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস পান? 

এদের মধ্যে কারো কাছে নির্বাচনে অংশ নেয়াটা নেশার মতো। ব্যালট পেপারে নিজের নাম দেখেই তারা খুশি, এর বেশি আর কিছু তাদের চাওয়ার নেই। মানুষের তো কত রকমের শখ থাকে, এদের শখ নির্বাচনে অংশ নেয়া। খানিকটা আলোচনার খোরাক হতে পারলেই তারা তৃপ্ত। কয়টা ভোট পাবেন, জামানতের টাকাটা যে বাজেয়াপ্ত হবে, লোকজন তাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করছে- এসব তাদের স্পর্শ করতে পারে না মোটেই। কেউ কেউ তো এবার সহ মোট তিন-চারবারও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, কিন্ত তাদের শখ মিটছে না!

সাইফুর রহমান মিলন

পোস্টারে সাইফুর রহমান মিলনের ছবি দেখেননি, এরকম মানুষ ঢাকা শহরে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। জাতীয় পার্টির এই নেতার পোস্টারে সয়লাব হয়ে থাকে পোস্তগোলা থেকে মহাখালী, ফার্মগেট থেকে সদরঘাট। এর আগেও তিনি মেয়র নির্বাচন করেছেন, ভোট পাননি। এবারও মনোয়ন নিতে ভুল হয়নি তার, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি। তবে গনসংযোগে মনযোগ নেই, মিডিয়ার ক্যামেরা দেখলে লজ্জায় পড়েই হয়তো দু-চারটে পোস্টার বিলি করেন। ভোটে দাঁড়ানোর নাকী কথাই ছিল না তার, মহাজোট থেকে তাকে 'বসে যেতে' বলা হচ্ছে বলেও জানালেন সাইফুর রহমান মিলন। বসেই যদি যাবেন, তাহলে দাঁড়ালেন কেন, সেই প্রশ্নটা আর করা হলো না তাকে!

প্রার্থীরা প্রচারণা চালায় কোথায়? জনবহুল এলাকায়, রাস্তাঘাটে, বাসা-বাড়িতে। একজন মেয়র প্রার্থী শুক্রবার সকালে ফাঁকা সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় ঢুকে দলবল নিয়ে ভাষণ দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছেন, অথচ তার কথা শোনার জন্যে মানুষ তো দূরে থাক, একটা কুকুর-বেড়ালও হাজির নেই সেখানে! এমন অদ্ভুত প্রচারণার দেখা মিললো বাংলাদেশ কংগ্রেস নামের একটা দলের হয়ে মেয়র নির্বাচন করা আকতারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লার বদৌলতে! 

এর আগেও মেয়র নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন আয়াতুল্লাহ, জামানত হারিয়েছেন। আগেরবার তার প্রতীক ছিল ডাব, এবার পেয়েছেন লাউ। ফাঁকা জায়গায় প্রচারণা চালিয়েও তার আশা, অতীতের সকল রেকর্ড তিনি ভঙ্গ করবেন। সেই রেকর্ড কি জামানত রক্ষার রেকর্ড কীনা- সেটা আর জানা হলো না। 

আরেক মেয়র প্রার্থী দুষলেন মিডিয়াকে। তারা নাকি আওয়ামী লীগ আর বিএনপি প্রার্থীদের বাইরে অন্য কারো প্রচারণায় সাহায্য করছে না, তাদের নিয়ে খবর করছে না! বাহরানে সুলতান বাহার নামের এই মেয়র প্রার্থী নির্বাচন করছেন ঢাকা দক্ষিন থেকে। নিজেকে 'একাই একশো' দাবী করে তিনি নিজের লিফলেট নিজেই বিলি করে বেড়াচ্ছেন। 

জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী শাহীন খান

সবচেয়ে মজার কাণ্ড ঘটিয়েছে শাহীন খান নামের এক মেয়র প্রার্থী। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে মেয়র নির্বাচন করলেও, তাকে দেখা গেছে মৌচাকে লিফলেট বিলিয়ে বেড়াতে। অথচ মৌচাক ঢাকা দক্ষিণের আওতায় পড়ে! নিজের নির্বাচনী এলাকার হদিশ না জানা এই মেয়র প্রার্থী স্বীকারও করে নিলেন, পরিচিতি পাওয়ার জন্যেই তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। এরপরে আবার দাবী করলেন, জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী! শাহীন খানের মতো কনফিডেন্স আমার থাকলে কবেই বিসিএসটা হয়ে যেতো! 

একেকটা নির্বাচন আসে, আর এই অদ্ভুত মানুষগুলোর দেখা মেলে। এরা কেউ ক্ষতিকারক নন, মন্দ চোখে দেখার কিছু নেই। তারা ব্যাংকের টাকা লুটে খাচ্ছেন না, খুন করছেন না কাউকে। হাস্যরসের যোগান দিচ্ছেন, এটা সত্যি। জাতি হিসেবে আমরা বিনোদনপ্রিয়, আমরা বিনোদন দিতে পছন্দ করি। এই মানুষগুলো আছেন বলেই দু'দণ্ড হাসির অবকাশ পাওয়া যায়, এটাই বা কম কী? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা