আজ বিদ্যানন্দ হেরে গেলে, এক টাকায় আহার বন্ধ হলে হেরে যাবে এদেশের মানুষ, এর পরে হাজারটা চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে কেউ আর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখবে না, যে স্বপ্নটাকে বিদ্যানন্দ সত্যিতে পরিণত করেছে...

ঢাকায় এক ভদ্রলোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বাড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা নেই, হাসপাতালেও যেতে পারছেন না। যে বাসায় ড্রাইভারের কাজ করেন, সেখানে ছাদের ওপরে একটা চিলেকোঠার মতো জায়গায় কাটছে দিন, সংক্রমণের ভয়ে ওপরে উঠে কেউ তাকে খাবার দেয়ার সাহসও করছেন না, উল্টো বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন সবাই। ভদ্রলোক নিরুপায় হয়ে ফোন করেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দে, আকুতি জানিয়েছেন, অন্তত এক বেলার খাবার দিয়ে যান আমাকে, নইলে করোনার আগে না খেয়েই মরে যাবো! 

বিদ্যানন্দের ভলান্টিয়ার ছুটে গেছে খবর পেয়ে, কোন জুনিয়র নয়, তারা পাঠিয়েছে সবচেয়ে সিনিয়র এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিটিকেই। সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে তিনি আক্রান্ত ব্যক্তিটিকে খাবার পৌঁছে দিয়ে এসেছেন, এভাবে আগামী কয়েকদিন সেই বাসায় খাবার পৌঁছে দেবেন তারা, নিয়মিত। 

দূরপাল্লার বাস আর ট্রেনের অবস্থা বেহাল, এসব পরিবহনের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল। কাজেই এগুলোকে নিরাপদ রাখার কথা ছিল সরকারের। কিন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তো উদাসীন, তাদের এত কিছু দেখার সময় কোথায়! বিদ্যানন্দ উদাসীনতা দেখাতে পারেনি, তারা ছুটে গেছে নিজেদের সরঞ্জাম নিয়ে, অনুদানের লাখ লাখ টাকা খরচ করে কেনা হয়েছে রাসায়নিক, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস আর শরীরে একটা বাড়তি আবরণ জড়িয়ে বিদ্যানন্দের ভলান্টিয়ারেরা রাসায়নিক স্প্রে করেছেন বাসে, ট্রেনে। 

করোনায় আক্রান্ত রোগীকে খাবার দিয়ে আসছে বিদ্যানন্দ

যানবাহনের আসনের আনাচে কানাচে, হাতলে, যেখানে ভাইরাস লেগে থাকতে পারে- প্রত্যেকটি জায়গায় তারা রাসায়নিক ছিটিয়েছেন। এই কাজের জন্যে তাদেরকে কেউ টাকা দেয়নি, বাড়ি-গাড়ি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়নি, কেউ বলেন, এই কাজ করলে তাকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। বিদ্যানন্দ আর সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবকেরা এই কাজগুলো করেছে মনের আনন্দে, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদে। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে- এই লাইনটার সার্থক উদাহরণ তৈরী করেছে বিদ্যানন্দ। 

চিকিৎসকদের জন্যে বিনামূল্যে পিপিই বানাচ্ছে বিদ্যানন্দ, চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলস্টেশনে যাত্রীদের হাত ধোয়ার জন্য সেটআপ বসিয়েছে তারা। গত বইমেলায় পুরাতন জিনিসের বিনিময়ে বই দিয়েছে, আর এই সংগ্রহ দিয়ে পার্বত্যঞ্চলে এতিমদের জন্য তৈরি করেছে কম্পিউটার ল্যাব। উত্তরাঞ্চলের দুস্থ মানুষদের জন্য পরিচালিত হয়েছে মেডিকেল ক্যাম্প। মেয়েদের জন্য আবাসিক হোস্টেল নির্মাণ করেছে তারা, নির্বাচনী পোষ্টারের পেছনের সাদা অংশ দিয়ে বানিয়েছে এতিমদের লেখাপড়ার খাতা। এরই সাথে বিদ্যানন্দের এক টাকায় আহার প্রজেক্টের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয়। দরিদ্র‍্য মানুষের মধ্যে এভাবে ধারাবাহিকভাবে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ এমন বড় পরিসরে আর কেউ করেনি। উল্লেখ্য, এটি একটি চলমান প্রজেক্ট। 

ঝামেলাটা বেঁধেছে এই এক টাকার আহার প্রোজেক্টকে নিয়েই। গতকাল হঠাৎই 'এক টাকায় আহার' এর ফেসবুক পেজটি রিপোর্টের কারণে ডিজেবল করে দেয় ফেসবুক। বিদ্যানন্দ সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকের কাছে পেজ ফিরে পাওয়ার আবেদনও করেছে, কিন্ত সেটা ফেরত পাওয়া যায়নি। মাসে প্রায় পঁচিশ লাখ পেজভিউ ছিল 'এক টাকায় আহার' এর, দাতাদের সঙ্গে যোগাযোগের সেতুবন্ধন ছিল সেই ফেসবুক পেজ। কাজেই সেটা ডিজেবল হয়ে যাওয়া মানে যে খানিকটা হলেও ধাক্কা খাওয়া- তাতে কোন সন্দেহ নেই। 

বস্তি এলাকায় ছিটানো হচ্ছে রাসায়নিক

গতকালই নতুন পেজ খুলে সেখানে লাইক দেয়ার জন্যে আহবান জানানো হয়েছিল বিদ্যানন্দের পক্ষ থেকে, দারুণ সাড়া পড়েছিল তাতে। বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের ওপর অযাচিত আক্রমণ মেনে নিতে পারেনি ফেসবুক ব্যবহারকারীরা, দলে দলে অজস্র মানুষ শেয়ার করেছে পেজটি। বারো ঘন্টায় ১৩ লাখ মানুষের কাছে সেটি পৌঁছেছিল, এবং ফলোয়ার হয়ে গিয়েছিল ৭৯ হাজার। একটু আগে সেটাও গায়েব হয়ে গেছে।

এটা ফেসবুকের কোন সমস্যা না। একদল অমানুষ চাইছে বিদ্যানন্দ থেমে যাক, এক টাকায় আহার প্রোজেক্ট আর না চলুক। তাহলে যাদের উদাসীনতায় দরিদ্র‍্য মানুষ না খেয়ে থাকছে, বিদ্যানন্দের এই কাজের ফলে তাদের দিকে আঙুল উঠছিল। তাই বিদ্যানন্দকে থামিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে, তাদের ফেসবুক পেজ বারবার ডিজেবল করা হচ্ছে রিপোর্ট করে। তবে বিদ্যানন্দ জানিয়েছে, এমন আক্রমণে তারা থামবে না, হার মানবে না, কাজ করে যাবে আগের মতোই। 

ভালো কাজে পদে পদে বাধা আসবে- এটাই স্বাভাবিক। এক টাকায় আহার প্রোজেক্টের মাধ্যমে কি দুর্দান্ত কাজ হচ্ছিল, সেটা খুব কাছ থেকে দেখেছি আমরা, এগিয়ে চলো সাধ্যমতো বিদ্যানন্দের পাশে থাকার চেষ্টাও করেছে বরাবর। বিদ্যানন্দ, যারা সবার আগে মানুষের কথা ভেবেছে, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা আগে থেকেই ছিল, এখন আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। 

আজ যখন এক টাকায় আহারের ওপর আঘাত এসেছে, বিদ্যানন্দকে থামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে- তখন কোন সভ্য ব্যক্তিরই চুপ থাকাটা সাজে না। আজ বিদ্যানন্দ হেরে গেলে, এক টাকায় আহার বন্ধ হলে হেরে যাবে এদেশের মানুষ, এর পরে হাজারটা চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে কেউ আর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখবে না, যে স্বপ্নটাকে বিদ্যানন্দ সত্যিতে পরিণত করেছে...

বিদ্যানন্দের ফেসবুক পেজের লিংক- https://www.facebook.com/Bidyanondo/


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা