একজন মানুষের বিখ্যাত হয়ে ওঠার পেছনে কিছু মানুষের অবদান থাকে। কেউ তাদের বেমালুম ভুলে যায়, কেউবা জোর করে ভুলিয়ে দিতে চায়। ছবির এই নারী চরিত্র মিলেভা। কে ছিলেন তিনি?
মহান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে নিয়ে আমাদের বিস্ময়ের শেষ নেই। তাকে পৃথিবী সেরা বুদ্ধিমানদের একজন বলে ধরা হয়, বলা হয় জিনিয়াস। শুধু তার বিস্ময়কর মস্তিষ্ক নিয়েই কতই না গবেষণা হয়েছে এখন পর্যন্ত। সবার কৌতূহল কিভাবে একজন মানুষ এতটা মেধাবী হতে পারেন, কিভাবে তিনি বিজ্ঞানের হরেকরকম দিগন্ত উন্মোচন করলেন!
কিন্তু, ইতিহাস যেভাবে তৈরি হয় এর মধ্যেও কিছু শুভঙ্করের ফাঁকি থাকে। একজন মানুষের বিখ্যাত হয়ে ওঠার পেছনে, এক্সট্রাঅর্ডিনারি হবার পেছনে কিছু মানুষের অবদান থাকে। কখনো কখনো ইতিহাস সেসব মানুষের ক্রেডিট একেবারেই ধামাচাপা দিয়ে ব্যক্তির অর্জন নিয়ে মেতে উঠে শুধু। আইনস্টাইনের জীবনের যে দিকটা আমরা জানি, তার পেছনেও কি এমন কেউ নেই? নাকি তিনি আইনস্টাইন একাই নিজেকে গড়েছেন?
আইনস্টাইনের মতোই জিনিয়াস ছিলেন মিলেভা মিরেক। তিনি এক সাইবেরিয়ান নারী। জন্মেছিলেন ১৮৭৫ সালে। গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানে মিলেভা মেরিক ছিলেন ভীষণ তুখোড়। সময়টার দিকে খেয়াল করেন। সেই সময়টায় খুব কম নারীই নিজের মেধা প্রমাণের সুযোগ পেতেন৷ খুব কম নারীই শিক্ষাদিক্ষায় অগ্রণী ছিলেন। মিলেভা ছিলেন সেইসব ব্যাতিক্রম নারীদের একজন।
১৮৯৬ সালে তিনি যখন এন্ট্রেন্স পাশ দিয়ে জুরিখ পলিটেকনিকে ভর্তি হলেন, সেই একই বছর আইন্সটাইনও এই পলিটেকনিকে ভর্তি হন। উল্লেখ্য, মিলেভা ছিলেন সেই সময়ে পলিটেকনিকের সেই সেকশনের একমাত্র নারী শিক্ষার্থী। যাইহোক, এই পলিটেকনিকেই আইনস্টাইনের সাথে মিলেভার চমৎকার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এত প্রগাড় হয় যে, তাদের মধ্যে বিবাহ বহির্ভুত একটা সম্পর্ক হয়ে যায়।
সেই সম্পর্কের জেরে ১৯০২ সালে তাদের একটি কন্যা সন্তান হয়। যদিও এই সন্তানকে নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে যায়৷ কারণ, কেউ কেউ বলে তাদের এই সন্তান মারা গিয়েছিল জ্বরে, কেউ বলে এই সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিয়েছিলেন তারা। মিলেভার সাথে আইন্সটাইনের বিবাহ হয় পরের বছর, ১৯০৩ সালে।
যদিও এই সম্পর্কও একসময় ভেঙ্গে যায়৷ দুই সন্তান জন্মাবার পর তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয় ১৯১৯ সালে। তবে মিলেভা যে আইনস্টাইনের পত্নী ছিলেন- এই লিখাটি তা জানানো মুখ্য উদ্দেশ্য না। মিলেভার আসলে সবরকম সম্ভাবনাই ছিল ইতিহাসের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন হবার। তিনি তার সব পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা করতেন আইনস্টাইনের সাথে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হলো, আইনস্টাইনের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পেছনে মিলেভার অবদান ছিল।
মিলেভার দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে আইনস্টাইন যা আবিষ্কার করেছেন তার জন্যে মিলেভা কোনো প্রতিদানই পাননি। বরং, ইতিহাস আইনস্টাইনকেই নিয়েই মেতেছিল। আইনস্টাইনও তার কাজের কোথাও মিলেভাকে কোনো ক্রেডিট দেননি৷ থিওরি অফ রিলেভিটিটি সূত্রটি নিয়ে এমনিতেই কম বিতর্ক নেই৷ অনেক পদার্থবিজ্ঞানী, পণ্ডিত এর আগে বিভিন্ন সময় ফতোয়া দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, এই সুত্রটির আবিষ্কারক আসলে আইনস্টাইন নন।
তবে, আইনস্টাইনের ছেলে তার যেসব চিঠি প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আইনস্টাইনের সাথে মিলেভার কথোপকথন হয়েছে এই সূত্র নিয়ে। E=mc2 সূত্রের প্রবক্তা আইনস্টাইনের আবিষ্কারে তার স্ত্রীরও বেশ ভাল অবদান আছে।
এক চিঠিতে দেখা যায় মিলেভা লিখছেন, “আমাদের এটা নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত ধারণার বিপরীত দিকে যাওয়া কি আমাদের উচিত? আমি নিশ্চিত নই। তবে সব কিছুই সম্ভব।” এই চিঠির উত্তরে আইনস্টাইন লিখেছেন, “আমাদের এটা নিয়ে ভালভাবে ভেবে দেখতে হবে। তবে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে পারাটা খুবই দারুণ ব্যাপার।”
আরেকটা চিঠিতে আইনস্টাইন লিখেছেন, “আমি কতটা খুশি এবং গর্বিত হব জানো না, যখন আমরা দুইজন একসাথে রিলেটিভ মোশনের উপর আমাদের কাজ বিজয়সূচক পরিণতির দিকে নিয়ে যাব।” বিভিন্ন চিঠিতেই আইনস্টাইন “আমাদের নতুন গবেষণা”, “আমাদের তদন্ত”, “আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি”, “আমাদের থিউরি” এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন।
এতে বোঝা যায়, মিলেভা আইনস্টাইনের কাজে সাহায্য করেছেন এবং আইনস্টাইনও সেটা নিয়ে বেশ খুশি। তবে, ব্যক্তিগত চিঠির বাইরে আইনস্টাইন তার গবেষণাপত্রে সবসময়ই আমিত্ববোধ দেখিয়েছেন। সেখানে মিলেভার কোনো স্থান ছিল না কখনোই৷ আইনস্টাইনের গবেষণাপত্রে যেসব গণিত, সেসবের অধিকাংশ সমাধানও নাকি মিলেভারই করা, গণিতের ভুলগুলোও শুধরে দিতেন এই মেধাবী নারী।
মিলেভার সাথে বিবাহের পর আইনস্টাইনের কয়েকটি গবেষণাপত্রের পাণ্ডুলিপিতে নাম ছিল “আইনস্টাইন – মেরিক”। সেইসময় আইনস্টাইনের গবেষণাগুলো প্রকাশিত হচ্ছিল দুনিয়াখ্যাত “এনালেন দের ফিজিক” জার্নালে। সেখানকারই এক সম্পাদকীয় বিভাগ সহকারী আব্রাহাম জোফে এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। পাণ্ডুলিপিতে নাম এরকম থাকলেও পরবর্তীতে সেসব একান্তই নিজের নামেই প্রকাশ করেন আইনস্টাইন। যদিও এখানে অন্য কারসাজিও হতে পারে। আইনস্টাইনের গবেষণা এমনিতেই তখন অনেক বিতর্ক উশকে দিচ্ছিল, সবাই তার মতবাদ গ্রহণ করতে পারছিল না। সেই সময়ে একজন নারীর নাম থাকলে গ্রহণযোগ্যতা আরো কমে যেতে পারে এমন সম্ভাবনা থেকেও হয়ত মিলেভা মেরিকের নাম কাটা যেতে পারে।
তবে, এখন আইনস্টাইন ভীষণরকম প্রবাদপুরুষে পরিণত হয়েছেন। টাইম ম্যাগাজিন তো তাকে বিংশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি বলেই ঘোষণা দিয়েছে। তাকে সবাই অহর্নিশ কুর্নিশ করে বেড়ায়৷ আর এই ডামাডোলে আড়ালে থেকে যায় মিলেভার নাম। বেচারি না নিজের ক্যারিয়ার গড়তে পারলেন, নিজের প্রতিভা দেখাতে পারলেন না যাকে সাহায্য করলেন সে দিলো তার দাম! নিয়তির পরিহাস বোধহয় একেই বলে।
অথচ, একটি চিঠিতে তিনি মিলেভাকে উদ্দেশ্য করে এই কথাও বলেছেন যে, “তুমি ছাড়া আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগি, কাজে আনন্দ পাই না, তুমি ছাড়া আমার জীবন আসলে জীবনই না।” এই চিঠিগুলো কিন্তু বাইরের কেউ ফাঁস করেনি, চিঠিগুলো প্রকাশ করেছেন আইনস্টাইনেরই সুযোগ্য পুত্র হ্যান্স আলবার্ট। চিঠিগুলো পড়লেই বোঝা যায়, একজন মিলেভার কতটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল আইনস্টাইনের আইনস্টাইন হয়ে উঠার পেছনে।
বাস্তবিক সত্য এই, আইনস্টাইন দেখতে তো প্রথাগত সুপুরুষ ছিলেন না। মিলেভা তাকে প্রথমদিকে পাত্তাও দিতে চায়নি৷ কিন্তু, পরে তাদের মধ্যে গভীর প্রণয় ঘটে৷ সেই প্রণয়ে সুবিধাভোগী আসলে আইনস্টাইনই৷ কারণ, মিলেভার মতো মেধাবী গনিতজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞান বুঝতে পারা একজন নারী তার সবটুকু মেধা আইনস্টাইনের সাথেই শেয়ার করেছেন। কিন্তু, তাতে কি লাভ হলো? যখন তাদের ডিভোর্স হয় আইনস্টাইন খুব বাজেভাবেই অপমান করেছিলেন মিলেভাকে। বলেছিলেন, “আমার থেকে কোনো ভালবাসা আর আশা করো না। বলা মাত্রই আমার শোবার ঘর, পড়ার ঘর ছেড়ে সব তল্পিতল্পা নিয়ে বিদায় নেবে।”
১৯১৮ সালে তাদের যখন ডিভোর্স হবে হবে একটা অবস্থা, মিলেভা তো মেনে নিতে চাননি প্রথমে। সেইসময় আইনস্টাইন তার নোবেল জয়ের অর্ধেক অর্থ অফার করেন মিলেভাকে, ডিভোর্সের প্রতিদান হিসেবে। আইনস্টাইনের এই কাজটাই বিতর্ক উশকে দেয়৷ কেন তিনি তার নোবেল জয়ের অর্ধেক অর্থ মিলেভাকে দিলেন? অনেকের ধারণা আইনস্টাইন আসলে তার আবিষ্কারে মিলেভার কন্ট্রিবিউশনের বিপরীতে তাকে এই টাকা দিয়েছেন। অর্থ দিয়ে যেন কিনে নিয়েছিলেন মিলেভার সব অবদান। কারণ, আইনস্টাইনের অর্ধেক কাজই বলতে গেলে মিলেভার সাহায্য ছাড়া অসম্ভব ছিল।
বেচারি মিলেভাকে কাগজের অর্থ দিলেও, কাজের কাগজগুলোতে কোথাও তার নাম রাখেননি “জিনিয়াস আইনস্টাইন”! বলা হয়ে থাকে, প্রতিটি সফল পুরুষের পেছনে নাকি একজন রমণীর ভূমিকা থাকে।
এই কথাটি কতটা সত্য, সেটা আইনস্টাইনের জীবনের এই আড়ালের অধ্যায়টুকু থেকে খুব ভালভাবেই বোঝা যায়। যদিও, সফল পুরুষরা দুনিয়ার মাতামাতিতে ঠিকই আরো শক্তিমান হয়ে যান, তাদের অতিমাত্রায় উপরে তুলে দেয়া হয়। আড়ালে থেকে যায়, মিলেভা মেরিকেরা...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন