এগিয়ে চলোর চার বছর: পাঠকের প্রশ্ন, আমাদের উত্তর
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

এগিয়ে চলো কি ইসলামবিরোধী অপশক্তি? এরা কি ভারতীয় এজেন্ট? 'র' থেকে এদের বেতন দেয়া হয়? এগিয়ে চলো নাস্তিকতা প্রমোট করে? চলুন, জেনে আসা যাক এসব প্রশ্নের উত্তর...
এগিয়ে চলো চার পেরিয়ে পঞ্চম বছরে পদার্পণ করলো আজ। সময়ের হিসেবে খুব বেশি নয়, কিন্ত আমরা যারা মোটামুটি শুরু থেকে এই জার্নিটার সঙ্গে আছি, তাদের বয়স গত চার বছরে অনেকটা বেড়ে গেছে মনে হয়। প্রতিটা মুহূর্তে সংগ্রামের নতুন গল্প লেখা হয়, টিকে থাকার লড়াইটা থামে না এক সেকেন্ডের জন্যেও। ভালো কিছু করার চেষ্টায়, পাঠককে ভালো এবং ভিন্ন রকমের কিছু উপহার দেয়ার চেষ্টায় এই যুদ্ধটাকেও আসলে আমাদের কাছে কষ্ট বলে মনে হয় না।
একদম শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম আমরা। আপনাদের সঙ্গে নিয়ে এখন প্রায় দুই লক্ষ সদস্যের বড়সড় একটা পরিবার। অন্য অনেক মিডিয়া হাউজের সঙ্গে তুলনা করলে সংখ্যাটা ক্ষুদ্র মনে হতে পারে, কিন্ত কোন মিডিয়া মোঘল বা কর্পোরেট বিগশটের হাত না ধরে, কয়েকজনের দলীয় উদ্যোগে হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমরা এগিয়ে গেছি, ধাক্কা খেয়েছি বারবার, ভুল করেছি, সেই ভুল থেকে শিখেছি।
চার বছরের এই পথচলায় অজস্র মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সঙ্গী হয়েছে আমাদের। সত্যি বলায়, মুক্তিযুদ্ধ বা যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে সরাসরি অবস্থান নেয়ায়, ধর্মান্ধতা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নারীর অধিকার এবং ধর্মকে ব্যবহার করে সংঘটিত নানা অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় অনেকে আবার রুষ্ট হয়েছেন, কেউ কেউ ভুল বুঝেছেন। কমেন্টবক্সে ক্ষোভের উদগীরণ ঘটিয়েছেন অনেকে। এই লেখাটা মূলত তাদের জন্যেই।
গত চার বছরে কিছু জিনিস চোখে পড়েছে। এগিয়ে চলো নিয়ে কারো কারো ভ্রান্ত কিছু ধারণা আছে, কোন নির্দিষ্ট মত বা দলের ট্যাগ আমাদের গায়ে সাঁটিয়ে দিতে চান অনেকেই। কেউ বলেন ভারতের দালাল, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' নাকি আমাদের বেতন দেয়। কারো অভিযোগ, আমরা 'ইসলামবিরোধী অপশক্তি', নাস্তিকতা প্রমোট করে বেড়াই, কেউ কেউ তো এককাঠি বাড়িয়ে আমাদের ইসকন সদস্যও বানিয়ে দেন।
আমরা সেসব কমেন্ট পড়ি, তারপর 'র' থেকে উপহার পাওয়া ফ্ল্যাটের অবস্থানটা কোথায় সেটা খোঁজার চেষ্টা করি। ব্যাংক থেকে মোবাইলে মিলিয়ন ডলার ট্রানজেকশনের কোন মেসেজ এসেছে কিনা চেক করে দেখি। মাসের শেষ সপ্তাহে ফাঁকা হয়ে যাওয়া মানিব্যাগের দিকে তাকাই, শেষমেশ এসব অলীক কল্পনার কথা ভেবে হেসে ফেলি।
আমরা যৌক্তিক সমালোচনায় বিশ্বাস করি। এগিয়ে চলো'র নিয়মিত পাঠক হয়ে থাকলে আপনার জানার কথা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিএসএফের সীমান্ত হত্যা- সবকিছু নিয়েই আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। বাংলাদেশের অন্য কোন মিডিয়া হাউজ তাদের লেখায় নরেন্দ্র মোদিকে সরাসরি 'সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি' উল্লেখ করেছে কিনা আমাদের জানা নেই, আমরা করেছি। গুজরাট দাঙ্গায় নিহত হাজারো নিরীহ মানুষের মৃত্যুর দায়ভার যে মোদি এড়াতে পারেন না, সেটাও বলেছি উঁচু গলায়।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত হবার পর থেকেই আমরা ক্রমাগত প্রতিবাদ জানিয়েছি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ও বাহক ছিলেন, নরেন্দ্র মোদি তার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাকে প্রধান অতিথি করাটা তাই জাতির পিতাকে অপমান করার শামিল- এই কথা জোর গলায় উচ্চারণ করেছি আমরা। এরপরও যদি আপনাদের মনে হয় আমরা ভারতীয় এজেন্ট, 'র' থেকে আমাদের বেতন দেয়া হয়, তাহলে একটা মুচকি হাসি দেয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।

আরেকটা ভুল ধারণা অনেকের, এগিয়ে চলো ইসলামবিরোধী কোন প্ল্যাটফর্ম। একদমই অমূলক একটা ধারণা, বাস্তবতা থেকে যার দূরত্ব কোটি কোটি আলোকবর্ষ। ধর্মের নামে কেউ অনাচার করলে, সংখ্যালঘুর অধিকার হরণ করলে, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে কাউকে দমিয়ে রাখতে চাইলে আমরা প্রতিবাদ করেছি, ভবিষ্যতেও করব। কিন্ত তার মানে এই নয় যে আমরা ইসমালবিরোধী, বা নির্দিষ্ট কোন ধর্মের প্রতি আমাদের ক্ষোভ আছে।
আমরা সাম্যতায় বিশ্বাস করি। এই দেশে একজন মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার যেমন আছে, ধর্ম পালন না করার অধিকারও তেমনই সবার আছে- আমরা এই ধারণায় বিশ্বাসী। আমরা বিশ্বাস করি ভিন্ন মতের অনুসারী হবার 'অপরাধে' কাউকে মেরে ফেলা হবে না, সমলিঙ্গের সম্পর্কে বিশ্বাস করার 'অপরাধে' কারো ওপর আঘাত আসবে না। এগুলোকে যদি কেউ 'ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান' নেয়া মনে করেন, সেটার দায়ভার পুরোপুরি তার।
আমরা রমজানে জোর করে হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখার বিরুদ্ধে কথা বলেছি, মাদ্রাসায় ছাত্র বলাৎকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছি। জামায়াত বা হেফাজতের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান পরিস্কার। এগুলোকে অনেকেই এগিয়ে চলোর 'ইসলাম বিরোধী অবস্থান' হিসেবে চিহ্নিত করেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা স্পেডকে স্পেডই বলি, মুখ বুঁজে সেটাকে চেপে যেতে চাই না, চেপে যাওয়াটা আমাদের কাজ নয়। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিবাদের মাধ্যমেই ভালো কিছু হয়।
এগিয়ে চলো আওয়ামী লিগের পেইড এজেন্ট- এমন একটা মতবাদও আছে অনেকের মধ্যে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা অন্য যে কোন দলের চেয়ে আওয়ামী লিগের সমালোচনাই করেছি সবচেয়ে বেশি। আমাদের যাত্রাপথের গোটা সময়টা জুড়েই আওয়ামী লিগ ক্ষমতায়, তাদের ভুল-ত্রুটি, নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি, ছাত্রলিগের অপকর্ম- সবকিছু নিয়েই আমরা স্বোচ্চার থেকেছি। কোটা কিংবা সড়ক আন্দোলন- প্রতিটা জায়গায় আমরা সরকারের দিকে আঙুল তুলে কথা বলেছি। হুমকি এসেছে, আমরা সেসবকে একপাশে সরিয়ে কাজ করেছি, এখনও করে যাচ্ছি।
কেউ যদি বলেন এগিয়ে চলো আওয়ামী লিগের ফেভারে কাজ করে, তাকে অন্তত একশোটা কন্টেন্ট হাজির করে দেয়া যাবে, যেখানে আওয়ামী লিগের লোকজনের সমালোচনা করেছি আমরা। গোলাম রব্বানী থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- সবার সমালোচনাই আমরা করেছি, কারণ এদেশের সংবিধান সেই অধিকার আমাদের দিয়েছে।
আরেকটা কমন অভিযোগ, এগিয়ে চলোতে ভারতীয় কন্টেন্টের আধিপত্য থাকে। এই অভিযোগটাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিচ্ছি না আমরা। সংস্কৃতি বলুন, বাণিজ্য বলুন কিংবা রাজনীতি- আমাদের দেশের প্রতিটা বিষয়ের ওপরেই বৃহৎ এই প্রতিবেশী দেশটির প্রচ্ছন্ন প্রভাব আছে। এদেশের মানুষ হলিউডের চেয়ে অনেক বেশি খোঁজ রাখে বলিউডের। ব্র্যাড পিট বা ডি-ক্যাপ্রিওর চেয়ে সালমান-শাহরুখরা এখানে কোটিগুণ বেশি জনপ্রিয়। বড় বড় মিডিয়া হাউজও এই নিয়মের বাইরে যেতে পারে না, আমরাও পারি না সবসময়। কাজেই কন্টেন্ট সিলেকশনের সময় ভারতীয় টপিকগুলোর সংখ্যা পাঠকের চাহিদার কারণেই বেড়ে যায় অনেক সময়।
তারকাদের নিয়ে অনলাইনে হওয়া যথেচ্ছা নোংরামির প্রতিবাদ আমরা শুরু থেকে করে আসছি। তারকারাও মানুষ, তাদেরও পরিবার পরিজন আছে। কমেন্টবক্সে এসব নোংরামির নজির দেখলে তারা ব্যথিত হন। তারকাদের কেন আপনারা পাবলিক প্রোপার্টি ভাববেন? তাদেরকে যা খুশি তা বলার অধিকার তো কাউকে দেয়া হয়নি। আমরা যখন এসব নিয়ে প্রতিবাদ করি, তখব একদল এসে বলেন আমরা জ্ঞান দিচ্ছি। পাবলিক প্ল্যাটফর্মে গালিগালাজ করা এসব এই মুর্খ লোকজনকে জ্ঞান দেয়াটা কি উচিত নয়?
আমাদের নাম বিকৃত করে ডাকেন অনেকেই, চেগিয়ে চলো, হেগিয়ে চলো- এরকম অনেক নামই কমেন্টবক্সে চোখে পড়ে। প্রথম প্রথম অবাক লাগতো, রাগ হতো। এখন নিজেরাই মজা করি এসব নিয়ে। কারণ সময়ের সাথে সাথে আমরা বুঝতে পেরেছি, এগুলোতে মন খারাপের কিছু নেই আসলে। কিছু মানুষ আপনাকে গালাগাল দিচ্ছে মানে আপনি প্রোডাক্টিভ কিছু একটা করছেন, চুপ করে বসে নেই- এই বিশ্বাসটা নিজেদের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছি আমরা।
অজস্র সীমাবদ্ধতা আর প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে আমরা কাজ করি, যেটা হয়তো আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। আমাদের ছোট্ট দলটাতে যে কয়জন সদস্য আছে, তারা নিজেদের উজাড় করে দিয়ে চলেছেন প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে, পাঠকদের ভালোবাসার পাশাপাশি এই মানুষগুলোর অক্লান্ত শ্রম আমাদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আসলে সবাইকে ছোটই করা হবে বোধহয়।
সময় গড়াচ্ছে, দিন ফুরোচ্ছে দ্রুত। মান্না দে'র কফি হাউজ গানের মতো হয়ে গেছে জীবন, অনেক সঙ্গী পেয়েছি এই পথচলায়, তাদের অনেকেই এখন পাশে নেই, কিন্ত আমরা জানি তাদের ভালোবাসা আর আশীর্বাদ প্রতিনিয়তই সঙ্গী হয় আমাদের। আমরা ভালোবাসার শক্তিতে বিশ্বাস করি, আমরা জানি, যারা আমাদের পছন্দ করেন না, তাদের ভালোবাসা অর্জনের সামর্থ্যও আমাদের আছে। সেই চেষ্টাটা জারী থাকবে সামনের বছরগুলোতে, এই প্রতিজ্ঞাটা বুকের গভীরে পুষে রেখেই পথ চলি আমরা...