দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে এই পৃথিবী, লন্ডভন্ড হয়ে গেছে দেশ গোত্র জাতির সীমানা, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে। দেশান্তরিত হয়েছিলো কোটি কোটি মানুষ, ধনী গরীব মিলিয়ে মারা গিয়েছিলো প্রায় ১০ কোটি মানুষ, তখনও এতোটা স্থবির হয়নি পুরো পৃথিবী।
যে শহর কখনই ঘুমাতো না, সেই নিউইয়র্ক এখন দীর্ঘ নিদ্রায়, মেরু অঞ্চলের শীতনিদ্রার চেয়ে ভারী সে ঘুম। যে প্যারিসকে বলা হতো ভালোবাসার নগরী, সেই প্যারিস এখন জনশুন্য, ভালোবাসা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। যে মিলান শহর ছিল সমগ্র বিশ্বের ফ্যাশন নগরী, সেই মিলান এখন জীর্ণ শীর্ণ, বড় বিশ্রি রকম, কফিনে ঢাকা সেই মিলান।
যে কাবা শরীফে প্রতিদিন লাখো মানুষ তওয়াফের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হতো, সেখানে এখন সিকিউরিটির কড়া পাহারা। সকল মসজিদ, মন্দির, গীর্জা এখন আর মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল নয়। আল্লাহ, খোদা, ভগবান, ঈশ্বর এখন আর নিজেদের ঘরে আবদ্ধ নয়, লাখো মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে।
পর্যটন নগরী ব্যাংকক এখন পর্যটকশূন্য, সিন সিটি লাস ভেগাস এখন ক্লিন সিটি, ভেনিসের লেকে এখন ডঙ্গোলার ভিড় নয়, সেখানে ভেসে বেড়ায় দুধ সাদা হাঁস। ডাবল ডিজিটের জিডিপি ছোঁয়া চায়নার ফ্যাক্টিরিগুলোও বন্ধ।
ডিজনির সিনেমায় এখন ম্যাজিক নেই, হলিউড ব্যুলোভার্ডে নেই এখন সেলিব্রেটিদের পদচারণা, বলিউডের জমকালো গালা পার্টি এখন স্থগিত। সিডনি অপেরা হাউজে শো চলছে না অনেকদিন। প্যারিসে, মিলানে, মাদ্রিদে, লন্ডনে এখন নেই সুপারমডেলদের আনাগোনা, ফ্যাশন হাউজ আর বিউটিশপগুলো ধুলো জমে মলিন হয়ে আছে।
কারো সাথে দেখা হলে করমর্দন করা বা জড়িয়ে ধরা হঠাত করেই মারনাস্ত্রে পরিণত হয়েছে, নিষিদ্ধ করা হয়েছে প্রকাশ্যে দেখা সাক্ষাত। বৃদ্ধ বাবা মাকে দেখতে না যাওয়া, বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা না দেয়াই হচ্ছে তাদের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ।
হঠাৎ করেই, খ্যাতি, রুপ, টাকা পয়সা, ক্ষমতা জৌলুস একেবারে মূল্যহীন হয়ে উঠেছে, মুল্যবান হয়ে উঠেছে ফুসফুসভর্তি অক্সিজেনযুক্ত বাতাস। একটু বুক ভরে নিশ্বাস নেয়াটা এখন লাখো লাখো মানুষের আর্তিতে পরিণত হয়েছে।
দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে এই পৃথিবী, লন্ডভন্ড হয়ে গেছে দেশ গোত্র জাতির সীমানা, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে। দেশান্তরিত হয়েছিলো কোটি কোটি মানুষ, ধনী গরীব মিলিয়ে মারা গিয়েছিলো প্রায় ১০ কোটি মানুষ, তখনও এতোটা স্থবির হয়নি পুরো পৃথিবী।
এতোকিছুর পরও জীবন চলে যাচ্ছে এখন এক অদ্ভুত নিয়মে। তিন মাস আগেও এমনটি কল্পনাও করা যায়নি। পৃথিবী এরকম হয়ে যেতে পারে এই ইঙ্গিত কেউ দিলেও নেহাত পাগল বলা হতো তাকে। এককভাবে কোন পরাশক্তির ক্ষমতা ছিলোনা পুরো পৃথিবীকে এভাবে গৃহবন্দি করার। অথচ সামান্য, অতি সামান্য, চোখে দেখা যায়না এক শক্তি তার আপন কির্তিতে কতো সহজেই স্থবির করে দিয়েছে গোটা পৃথিবী।
আহ কতো অসামান্য তার কির্তি, কতো সুন্দর প্রকৃতির এই ফিরে আসার চেস্টা। মানুষের চোখে দেখলে হয়তো এর সৌন্দর্যটা চোখে পড়বে না কারন পরাজিতের কাছে যুদ্ধাবসান কখনই ভালো সংবাদ নয়। প্রকৃতির এই বিজয়কে উপলদ্ধি করতে হবে প্রকৃতির এক সামান্য অংশ হিসেবে, এর নিয়ন্ত্রক হিসবে দেখলে আসল চেহারাটা চোখে পড়বে না।
সেই প্রাগঐতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ এবং প্রকৃতির এই সঙ্ঘর্ষ চলে আসছে, প্রকৃতি চাইলেই এই যুদ্ধে একতরফা জিতে যেতে পারতো বহু আগেই, কিন্তু এতোটা নির্মম নয় এই প্রকৃতি, যত কিছুই হোক আমরা মানুষেরা তো এই প্রকৃতিরই একটা অংশ। প্রকৃতির সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়েছে মানুষ, শক্তিশালী হচ্ছে মানুষ।
আগের বহুবারের মতোই এবারও প্রকৃতি মানুষকেই জিতিয়ে দিয়ে যাবে, একই সাথে আরো একটু মানবতাবোধ দিয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে, দাঁড়াতে হবেই, এই দুঃস্বপ্নের আঁধার কাটবেই। মানুষ বাঁচবে মানুষের মতোই, আবারও।
নচিকেতার মতোই বলতে হয়- একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে। বসতি আবার উঠবে গড়ে, আকাশ আলোয় উঠবে ভরে জীর্ণ মতবাদ সব ইতিহাস হবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে। ঝড় থেমে যাবে, কিন্তু লন্ডভন্ড করে দিয়ে যাবে সবকিছু। এই স্থবির সময়ের মধ্যেই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মজুদ করা খাবার শেষ হয়ে যেতে পারে, দেখা দিতে পারে খাদ্য সংকট।
নতুন ফসল নতুন উৎপাদন না হওয়া পর্যন্ত এই খাদ্য সঙ্কট চলতে পারে। সাহায্যও পাওয়া যাবেনা কোথাও, কারন এই সংকট ভৌগলিক অবস্থানে সীমাবদ্ধ নয়। সমগ্র পৃথিবী একসাথে আক্রান্ত, কে, কাকে, কতজনকে সাহায্য করবে। খাদ্য সংকটের সাথে সাথেই দেখা দিতে পারে অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য সংকট দ্রুত কেটে গেলেও অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগে যেতে পারে বেশ কয়েকটা বছর।
আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এর আঁচ লাগবে ভালোমতোই। ঠিক তখনই আসল পরীক্ষা শুরু হবে মানুষের। এই বৈশ্বিক দুর্যোগ থেকে কোন শিক্ষা কি গ্রহন করতে পেরেছি আমরা। আমরা কি বুঝতে পারছি যে ঠিক আমি নিজে ভালো থাকলেই তাকে ভালো থাকা বলে না, আমার পাশের মানুষটি ভালো না থাকলে আমিও ভালো থাকতে পারি না।
আমাদের কি এই শিক্ষা হয়েছে যে সামগ্রিক দুর্যোগে ব্যাক্তিগত ধন সম্পদ কোন কাজেই আসে না। আমাদের কি এই উপলদ্ধি হচ্ছে যে ব্যাঙ্ক ভর্তি টাকা পয়সার চেয়ে পরিবারের সকলকে সময় দেয়া বেশী জরুরী। ঘর ভর্তি দামী বিদেশী ফার্নিচারের চেয়ে ঘরের মধ্যে কথা বলার, ভালোবাসার, খেয়াল রাখার মানুষ থাকা জরুরী।
এইসব শিক্ষা যদি আমরা সত্যিই পেয়ে থাকি তাহলেই বেঁচে যাবে মানবতা। মানুষ বেঁচে থাকবে, মানুষের জন্য, আরো একটু বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে। ব্যাক্তিগত সম্পদের পাহাড় থেকে খানিকটা ভাগ পাবে পাশের বাড়ির, পাশের এলাকার, পাশের দেশের মানুষটিও। সবাই মিলে হাতে হাত ধরে এই লন্ডভন্ড পৃথিবীকে আবার রাঙিয়ে তুলবো আমরা নতুন রঙে। আবার আলো ঝলমল হবে আমাদের সন্ধের রাস্তা, রাতের শহর। আবার ঘুরে বেড়াবো আমরা এই পৃথিবীতে, আরো একটু বেশী মানবিক পৃথিবীতে, বাউলের পৃথিবীতে।
আরও পড়ুন-