ই-কমার্স থেকে সময়মতো পণ্য না পেয়ে ভোগান্তিতে আছেন অনেকে। তাদের কেউ কেউ হুংকার দেন ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ দেয়ার। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে কতটুকু জানেন? কিভাবে অনলাইনেই ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ দেয়া যায়?

জাবেদ কিছুদিন হলো একটা চাকরিতে জয়েন করেছেন। আগের মতো তাই তার হাতে বাড়তি সময় থাকে না। তাই এখন তিনি কেনাকাটার জন্যে অনলাইনের উপর কিছুটা নির্ভরশীল হতে চান। এজন্যে তিনি বাংলাদেশের ই-কমার্সগুলো থেকে মাঝে মধ্যে প্রোডাক্ট অর্ডার দেন।

অফিসের কাজে প্রায়ই বাইরে থাকতে হয়। তাই ফোন চার্জের জন্যে একবার তিনি একটা পাওয়ার ব্যাংক অর্ডার দিলেন। দুইদিন বাদেই পাওয়ার ব্যাংকটা ডেলিভারি পেলেন। জাবেদ মোটামুটি খুশি। এরপর সে আরেকটি ই-কমার্স থেকে একটা ব্যাগপ্যাক অর্ডার দিলেন। কয়েকদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও ব্যাগপ্যাকটি ডেলিভারি হচ্ছিলো না। আর যখন ব্যাগপ্যাক পেলেন তখন খেয়াল করলেন ডিজাইনে মিল নেই। যেরকমটা দেখে অর্ডার দিয়েছিলেন, প্রোডাক্ট এসেছে তার ব্যতিক্রম।

একবার কার্গো প্যান্ট দিয়েও বিরুপ অভিজ্ঞতা পেলেন। প্যান্ট ডেলিভারি পাওয়ার পর তার মনে হলো এই প্যান্ট কোনো ক্রমেই নতুনের মতো দেখতে না। দ্বিতীয়ত প্যান্টটা থ্রি কোয়ার্টার, যা তিনি চান নি। এই প্রোডাক্ট রিটার্ন দিতে গিয়ে তার আরো বেগ পোহাতে হলো। রিফান্ড আসতে আসতে ১১ দিন লাগলো প্রায়। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন দিতে হয়েছে কাস্টমার কেয়ারে।

জাবেদ তবুও টুকটাক কেনাকাটা করতে থাকলেন ই-কমার্স থেকে। একবার বিশেষ অফারে তিনি একটি দামি ফোন অর্ডার দিলেন সাহস করে। তিনি পণ্যের দামও আগেই দিয়ে দিলেন অফারের শর্ত মোতাবেক। নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও ফোন আসলো না। এক মাস পর তিনি যখন ফোন হাতে পেলেন তখন দেখলেন, তার পছন্দের কালার দেয়া হয় নি। তিনি চেয়েছিলেন সাদা, দেয়া হয়েছে গ্রে কালারের ফোন। সেলারের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানলেন, তার পছন্দের কালারের স্টক শেষ হয়ে গিয়েছে। জাবেদের এতে খুব মন খারাপ হলো।

বাংলাদেশে অনলাইনে কেনাকাটা বাড়ছে। বিশেষ করে অনলাইনের মাধ্যমে শুরু হওয়া উদ্যোক্তার সংখ্যা এখন তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো। ফেসবুকের এফ-কমার্স তো বটেই বাংলাদেশে ই-কমার্সের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। কিন্তু, এতোগুলো ই-কমার্স মিলেও এই খাতকে আস্থাশীল পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে নি। মূলধারার যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, তাদের সবারই কিছু না কিছু ত্রুটি লক্ষণীয়।

বাংলাদেশের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি

প্রথমত প্রোডাক্টের মান তারা নিশ্চিত করতে পারছে কিনা, দ্বিতীয়ত সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারছে কিনা, তৃতীয়ত কোনো সমস্যা হলে যোগাযোগ রক্ষায় তারা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে কিনা এই প্রশ্নগুলো বড় হয়ে দেখা দেয়। এবং এই প্রশ্নগুলোতে এখনো দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো লেটার মার্কস পাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে নি এখনো। এটা ঠিক নতুন ইন্ডাস্ট্রি, তাই সময় দেয়া উচিত তাদের। কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় যখন কিছু ক্ষেত্রে তারা পাস মার্কসই তুলতে পারেন না সার্ভিসে, কোয়ালিটিতে তখন। মানুষ কেনো তাহলে ই-কমার্সকে বিশ্বাস করবে?

ভোক্তাকে ঠকিয়ে কিংবা অন্ধকারে রেখে বা বিভ্রান্ত করে অন্তত এই ২০২০ সালে কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বাজারে আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হবে তা হবার নয়। কারণ, এই মুহুর্তে অনলাইনে সচেতন একটি শ্রেণীরও বিকাশ হতে দেখছি আমরা। যারা নিয়ম মানেন, আইন পছন্দ করেন। যারা অধিকার সম্পর্কে সচেতন। তারা ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। এই সচেতন শ্রেণীর গ্রাহকরা যখনই প্রতারিত হন, তারা গালাগালির আশ্রয় নেন না। বরং যথাযথ নিয়মে ভোক্তা অধিকার আইনে অভিযোগ প্রদান করেন।

২০০৯ সালে দেশে ভোক্তা অধিকার আইন প্রণীত হয়। এই আইনের অধীনে ভোক্তাদের অধিকার রক্ষার মোট ৮২টি ধারা আছে। কিছু কিছু ধারার কথা উল্লেখ করতে পারি। যেমন- ৪৪ ধারায় উল্লেখ আছে, পণ্যের মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করলে অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। অনলাইনের কেনাকাটায় অনেক সময় আমরা খেয়াল করি, বিজ্ঞাপনে এক রকমের পণ্য দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে পরে অন্য পণ্য ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা যে পণ্য দেখানো হচ্ছে, তার সাথে মিল থাকছে না ডেলিভারি হওয়া পণ্যের।

এই আইনের ৪৫ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইভ্যালি নামক একটি জন-আলোচিত ই-কমার্সের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। দারুণ অফার দিয়ে আলোচনায় আসা এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সমালোচনার মুখে পড়েছে তাদের ডেলিভারি সিস্টেমের কারণে। প্রতিশ্রুত পণ্য সময়মতো দেয়ার ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। সবচেয়ে যেখানে তাদের নিয়ে সমালোচনা তা হলো, গ্রাহকের সমস্যা তারা তাদের মূল ফেসবুকে গ্রুপে এপ্রুভ করেন না। কাস্টমার কেয়ার থেকে জবাব আসে না। এপসে ইস্যু রিপোর্ট করেও উত্তর মেলে না। এধরণের কেইসে প্রতিশ্রুত পণ্য / সেবা যথাযথভাবে সরবারাহে ব্যর্থ হলে ভোক্তা অধিকার আইনের ৪৫ ধারা গ্রাহকের পক্ষে কাজ করতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে ইভ্যালি

আরেকটি সুন্দর ধারার কথা জেনে রাখতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৫৩ ধারা বলছে, "কোন সেবা প্রদানকারী অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতা দ্বারা সেবা গ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানী ঘটাইলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।" কোনো ভোক্তা যদি মনে করেন, সেবা প্রদানকারী কোম্পানির অবহেলা, দায়িত্বহীনতার কারণে ভোক্তার অর্থ, স্বাস্থ্যের হানি ঘটছে তিনি এই ধারায় অভিযোগ দায়ের কর‍তে পারেন।

কেবল অনলাইনে কেনাকাটা নয় অফলাইনেও আপনি যেকোনো ধরণের প্রতারণার মুখে পড়লে এই আইনে অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা নিতে পারেন। কোনো দ্রব্য নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দাম রাখছে, ভেজাল পণ্য দিচ্ছে এরকম কেইসে অনায়াসে অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে জরিমানা ধার্য হবে তার ২৫% অভিযোগকারী ভোক্তা পাবেন। অর্থাৎ, ১ লাখ জরিমানা হলে ২৫ হাজার টাকা পাবেন ভোক্তা।

ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ করে অনলাইনেই জানা যায় অভিযোগের বর্তমান অবস্থা

এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে অভিযোগ জানানো যায় এটা অনেকেই জানেন না বলে, অভিযোগ করতে পারেন না। অথচ, এখন স্রেফ অনলাইনে ঘরে বসেই এতো সহজভাবে অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি আছে যে মাত্র ৫ মিনিট সময় নিয়ে যে কেউ ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ জমা দিতে পারেন। এজন্যে আপনাকে অনলাইনে ভোক্তা অধিকারের ফরমে অভিযোগের বিবরণ লিখতে হবে। যুক্ত করতে হবে আনুসঙ্গিক প্রমাণ, ক্রয়ের রসিদ। ঠিকভাবে পূরণ করে জমা দেয়ার পর আপনাকে অনলাইনেই একটি আবেদন রশিদ নাম্বার দেয়া হবে। আপনি সেই নাম্বার দিয়ে আবার যাচাইও করতে পারবেন যে আপনার অভিযোগের বর্তমান অবস্থা কী।

ই-কমার্স থেকে কেনাকাটা একটি নতুন অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা সময়ের সাথে সাথে আরো সুখকর হবে বলে আশা করা যায়। তবে যেকোনো ক্ষেত্রেই "আনচেকড" এবং "আনকোয়েশ্চেনড" ব্যবস্থা উন্নতির প্রধান অন্তরায়। আজকের দিনে ই-কমার্সের কেনাকাটায় যেসব ভোগান্তির তথ্য আমরা দেখতে পাই তাকে প্রশ্ন ছাড়াই এভাবে চলতে দিলে সিস্টেম আরো নিম্নগামী হতে পারে। আর এক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ভোক্তাদের ভোগান্তির প্রতিকারে এগিয়ে আসতে পারে। তবে তার জন্যে ভোক্তাকেও যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।

ভোক্তা অধিকার আইন- http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-details-1014.html

অনলাইনে অভিযোগের ফরম- http://online.forms.gov.bd/onlineApplications/apply/MTMyLzMzLzI2


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা