বলিউড নয়, মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির সুপারস্টার তিনি। তারপরও বিশ্বজুড়ে তার অগণিত ফ্যান, বাংলাদেশেও সংখ্যাটা অনেক। কী কারণে তার এত জনপ্রিয়তা?
২০১৬/১৭ সালের দিকে বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে গ্রুপগুলোতে ব্যাপকভাবে আলোচনার জন্ম দেয় মালায়ালাম সিনেমাগুলো। সবাই এই সিনেমাগুলো নিয়ে কথা বলে, প্রশংসা করে। আমার আশেপাশের বন্ধুরাও কয়েকটি সিনেমার নাম বলে এবং দেখার জন্য উপদেশ দেয়। কোনো এক বিষণ্ণ রাতে আমি দেখা শুরু করলাম উস্তাদ হোটেল।
এটা ছিল আমার দেখা প্রথম মালায়ালাম সিনেমা। রীতিমতো আমি মুগ্ধ। এমনিতেই আমার পড়ালেখা ট্যুরিজম এবং হস্পিটালিটি ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে। তাই এই সিনেমাটি আমি আরো বেশি রিলেট করতে পারি৷ আর এই সিনেমা দিয়ে খোঁজ পেলাম একজন শক্তিশালী অভিনেতার, যার এক্সপ্রেশন, ডায়ালগ ডেলিভারি সব কিছু মারাত্নক নিখুঁত। মানুষটা দুলকার সালমান। এই লেখায় সিনেমা নিয়ে কথা বলবো না, বলবো দুলকার সালমানকে নিয়ে। দুলকার সালমানের অভিনয় সবার চেয়ে খানিকটা আলাদা, ভীষণ ন্যাচারাল মনে হয়। আরোপিত কিছু না, দেখে মনে হয় তিনি জানেন তার কী কাজ করতে হবে, কী বলতে হবে।
এটা সম্ভব হয়েছে তার লাইফস্টাইলের জন্য। তিনি সবসময় নতুন কিছু খোঁজেন, নতুন কিছু শিখতে চান। বাস্তব জীবনে বিভিন্ন মানুষ, বিচিত্র কালচারের সাথে পরিচিত হতে তার ভাল লাগে। ফলে, তিনি জানেন সিচুয়েশনগুলো কেমন হয়। তাই অভিনয়টাকে তিনি এতো বেশি ইম্প্রোভাইজ করতে পারেন।
ব্যাঙ্গালোর ডেইজ সিনেমাটা ছিল আমার দেখা দুলকার সালমানের দ্বিতীয় সিনেমা। যদিও এই সিনেমায় মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির অনেক বড় বড় সুপারস্টাররা ছিলেন। ফাহাদ ফাসিল, নিভিন পৌলি, নাজরিয়া নাজিম, পার্বতী সহ অনেকে। তবু, এই সিনেমায় দুলকার সালমানের অভিনয় এখনো মনে দাগ কেটে আছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে বোহেমিয়ান জীবন যাপন করা দুলকার সালমান অনেক বছর বাদে আসেন প্রিয় কাজিনের বিয়েতে। তিন কাজিনের হাসি, আনন্দ, জীবনযাপনের সিনেমা এটি৷ দুলকার সালমানের অভিব্যাক্তিতে নিঃসঙ্গতা, বাইক রেসিং এর প্রতি তার ভালবাসা, তার প্রেম- সবকিছু এতো সুন্দর করে ফুটে উঠেছে যে সেই অভিনয়টা, গল্পটা আজুর না, এটা দুলকার সালমানেরই নিজের গল্প৷
হয়না এমন যে, সিনেমার কষ্টের দৃশ্য যখন অভিনয় করে দেখানো হয় মনে হয় কষ্টটা আরোপিত, আসলে অভিনেতা সেটা ফিল করতে পারছেন না। এই ব্যাপারটাতে দুলকার সালমান ভীষণ ইউনিক। তিনি যা দেখান, মনে হয় এটা তার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা কোনো ব্যাপার। জীবনকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন বলেই হয়ত এতো বাস্তব জীবন্ত এই মানুষটার অভিনয়। এই সিনেমা দেখে অদ্ভুত বিষাদ আর আনন্দ, এক্সাইটমেন্ট সব কিছু পেয়েছি একসাথে।
চার্লি সিনেমা দুলকার সালমানের আরেকটা সেরা মাস্টারপিস। সিনেমার গল্প, চরিত্র, সিনেম্যাটোগ্রাফি সবকিছুই এতো অমানুষিক সুন্দর যে এই সিনেমা এখনো মন ছুঁয়ে আছে। আমাদের জীবনের লক্ষ্য কী আসলে? এই সিনেমায় জীবনের অন্য একটা মানে খুঁজে পাওয়া যায়। সিনেমা দেখে ভাবতে হয় এভাবেও জীবনকে উপভোগ করা যায়। আর দুলকার সালমান অভিনয় করেছেন বলেই সিনেমাটার আবেদন এতো বেশি, গল্পটা দেখে দুলকারের ন্যাচারাল অভিনয় দেখে আপনার মনে হতেই পারে ইশশ, ইফ আই কুড বি লাইক চার্লি!
বাংলাদেশে অনেকে চার্লি ক্যারেক্টারকে হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রের সাথে তুলনা করেছেন। যদিও দুইটি চরিত্রই বাউণ্ডুলে কিন্তু একটুও মিল নেই তাদের। চার্লি ভবঘুরে হলেও তার জীবন মিনিংফুল, সে সবসময়ই কিছু না কিছু খুঁজে বেড়ায় জীবন থেকে। যেকোনো অবস্থায় জীবনকে উপভোগ করতে চায়। অদ্ভুত সুন্দর একটা চরিত্র।
ভিক্রামাধিত্যান সিনেমাটা দেখেও কি যে ভাল লেগেছিল আমার। এই সিনেমা আবারো স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমার ও একটা স্বপ্ন আছে। এই সিনেমা দেখে আবারো উপলব্ধি করেছি, স্বপ্ন যদি রক্তে মিশে যায় তাহলে ওই স্বপ্ন হাজার ব্যর্থতা আর হোচট খেলেও আলোর মুখ দেখে। কোন সিনেমার কথা বলবো আসলে? এনপিসিভি, কালি, কমরেড ইন আমেরিকা, সালালা মোবাইলস, সলো, হান্ড্রেড ডেইজ অব লাভ, ও কাদাল কানমানি, কামাত্তিপাদাম, পারাভা, মাহানতি ইত্যাদি ইত্যাদি। দুলকার সালমানের প্রায় সবগুলো সিনেমাই দেখা হয়েছে।
তার সিনেমা রিমেক হয় অন্যান্য ইন্ড্রাস্ট্রিতে। ও কাদাল কানমানি বলিউউডে রিমেক হয়েছে ওকে জানু নামে। তবে কোনো রিমেকই অরিজিনাল প্রেজেন্টেশনকে ছাড়িয়ে যায়নি, দুলকার সালমানের অভিনয়কেও ছাপিয়ে যাওয়ার মতো কোনো রিমেক হয় না। ফলে, দুলকার সালমান সিনেমায় আছেন মানে সেই সিনেমা স্পেশাল। কারণ, তিনি মুহুর্তগুলো তৈরি করে নেন, ইম্প্রোভাইজ করেন।
সব সিনেমায় যে তিনি লিডিং রোলই প্লে করেছেন এমন নয়। তার কাছে একটা ভাল সিনেমার অংশ হওয়াটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার। যেমন পারাভা সিনেমার কথাই ধরুন। এই সিনেমায় খুব অল্পসময় স্ক্রিন টাইম ছিল দুলকারের। কিন্তু এই সামান্য কয় মিনিটেই তিনি অসামান্য অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছেন। সিনেমার লিড করার লোভ করার চাইতে ভাল সিনেমায় অংশ নেয়া, ভাল সিনেমার পার্ট হিসেবে ভাল ভাল কাজ যত বেশি করে যেতে পারবেন সেটাই তার কাছে বড় প্রাপ্তি৷
তাকে গোটা মালায়লাম সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সুপারস্টার বলা হয় এখন, সুপার হিরোও বলেন কেউ কেউ। শুধু কেরালায় না, তিনি অন্য ভাষাতেও, অন্য প্রদেশেও সিনেমা করেছেন। ২০১৮ সালে তিনি ইরফান খানের সাথে একটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। হিন্দি সিনেমা "কারওয়ান"। এটি তার প্রথম হিন্দি সিনেমা। এখানেও তার লিড রোল নেই সেই প্রচলিত অর্থে। কিন্তু, তিনি ইরফান খানের কাছ থেকে নতুন কিছু শিখবেন, তার সাথে অভিনয় করবেন এই নতুন চ্যালেঞ্জটা নিবেন বলেই এই সিনেমায় অভিনয় করছেন। তার মতে ইরফান খান সবসময়ই মনোযোগ দিয়ে ভাল ডিরেক্টর, ভাল গল্প খুঁজে বেড়ান। ইরফান খান ভাল সিনেমার অংশ থাকতে চান, সেটা বাংলা সিনেমা হোক, হিন্দি কিংবা হলিউড যা-ই হোক। এই ব্যাপারটা দুলকার সালমানের নিজের মধ্যেও আছে। তাই তিনি ইরফান খানের মতো অভিনেতার কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করেছেন এই সিনেমায়৷
তার জনপ্রিয়তা এখন বেশ আকাশচুম্বী। ২০১৬ সালে তিনি ভারতের ৫০ জন প্রভাবশালী তরুণের তালিকায় চতুর্থ ছিলেন। তারও আগে তিনি ভারতের সবচেয়ে আবেদনময়ী সুদর্শন পুরুষের তালিকায়ও ছিলেন ২০১৪ সালে। তার স্টারডম দিনে দিনে সুদে আসলে বৃদ্ধি পেয়ে আকাশ ছুঁয়েছে। তবুও এই মানুষটা নিজের পা মাটিতেই রাখতে চান। স্টারডম সম্পর্কে তার বক্তব্য খুব স্পষ্ট। তিনি বলেন, "সত্যি বলতে আমি মনে করি না, আমরা আমাদেরকে স্টার হিসেবে দেখি। মিডিয়া আমাদের এসব ট্যাগ দিতে পছন্দ করে। আমি ব্যাক্তিগতভাবে এসব নিয়ে খুব বেশি ভাবি না।" দুলকার সত্যিই স্টারডম নিয়ে ভাবেন না। তিনি শুধু ভাবেন সিনেমা নিয়ে।
প্রতি সিনেমায় তাকে হিরো থাকতে হবে তা নয়৷ পারাভা সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "আমি সবসময় ভাবি আমাকে বছরের সেরা সিনেমাটার অংশ হতে হবে, আমার ভিশন সে জায়গাটায়। আমি খ্যাতির জন্য সিনেমা করি না। স্টারডমের জন্য না। আমার কাছে সিনেমাই বড় হিরো এবং স্ক্রিপ্টও হিরো৷ যদি সিনেমা ভাল হয় তাহলে সবাই জেতে। যদি খারাপ হয় তাহলে কেউ মনে রাখে না সিনেমাটাকে।"
পারাভা সিনেমায় তার স্ক্রীনটাইম নিয়ে কথা উঠেছিল। অনেকে অবাক, এতো তরুণ এতো ইয়াং একজন হিরো লিড রোলে অভিনয় করছেন না, আবার স্ক্রিনটাইমও কম, তারউপরে বাচ্চাদের ছবি, তাহলে কেনো দুলকার সালমান এই সিনেমায় সাইন করলেন? পারাভা টিম তো সালমানের জনপ্রিয়তা বিক্রি করে সিনেমা হিট করে ফেলবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। কেন করেছেন সেটার উত্তর পাওয়া যায় যখন সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর সবাই ব্যাপকভাবে সিনেমাটির প্রশংসা করে এবং পুরষ্কার পেতে শুরু করে সিনেমাটি। সালমান মূলত এই ভাল কিছুর অংশ হতে চান। তিনি বলেন, "যদি আমি পারাভার একটা অংশ হই এবং এটা ভাল করে তাহলেও আমিও বেনিফিটেড হবো এই সিনেমা থেকে। এটা এমন না আমি তাদের সাহায্য করছি শুধু, আসলে তারাও আমাকে সাহায্য করছে একটা ভাল সিনেমায় আমাকে যুক্ত করে।"
দুলকার সালমানের নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষুদা প্রচন্ড। তিনি সর্বশেষ যে ছবিটা করেছেন তার থেকে নতুন কোনো চ্যালেঞ্জ না অনুভব করলে, নতুন কিছু না এক্সপ্লোর করতে পারলে তিনি সিনেমায় সাইন করতে চান না। তিনি সবসময়ই স্ক্রিপ্ট এর ব্যাপারে ভীষণ চুজি। হিসাব সহজ তার। একটা সিনেমা শুধু অভিনয়ের উপর সফল হয় না। গল্প ভাল হতে হয়, মেকিংটা কে করছে সেটাও এক্স ফ্যাক্টর। যদি সিনেমাটাই খারাপ হয় তাহলে সেখানে যত কঠোর পারফর্মেন্স করেন না কেনো সেটা অগোচরে পড়ে থাকবে। তিনি এটা চান না। তিনি সিনেমাকে প্রচন্ডরকম ভালবাসেন এবং সেটার রিফ্লেকশনটা তিনি দেখাতে চান তার অভিনীত সিনেমায়৷ এজন্যে সিনেমা বাছাইয়ের ব্যাপারে তিনি বেশ ভাবনা চিন্তা করেন। কিন্তু প্রত্যেকটা সিনেমা সফল হওয়ার পর সেটা নিয়েই বসে থাকতে চান না। এর পর কী আছে, এর পর নতুন কী তিনি শিখছেন, জানছেন, অভিনয় করছেন, এরপর কোন ক্যারেক্টার প্লে করবেন সেই ভাবনাতে তিনি ডুবে থাকতে চান।
সফল হলে তারও ভাল লাগে। কিন্তু সাফল্য নিয়েও তার নিজের ফিলোসফি আছে। তিনি বলেন, "আমি খুব উপভোগ করি প্রত্যেকটা সাফল্যকে। মাথার ভেতর ব্যাপারটা ঘুরতে থাকে উইকেন্ডে মানে শনিবার, রবিবারে। কিন্তু, সোমবারে আমাকে আবার নিজের পৃথিবীতে ফেরত আসতে হয় এবং নিজেকে শোনাই যদি এই শুক্রবার ভাল যায় এটা তোমাকে এই শুক্রবারের জন্য স্বস্তি দিবে, কিন্তু এখনো পরের শুক্রবার আসার বাকি আছে।"
অথচ আপনি জেনে অবাক হবেন দুলকার সালমান অভিনয়টাই করতে চাননি। তার বাবার জন্য। কেনো? দুলকার সালমানের বাবা ম্যামোত্থি মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির লিজেন্ডারি এক্টর। বছরের পর বছর আরেক লিজেন্ডারি অভিনেতা মোহনলালের সঙ্গে সিনেমা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে ম্যামোত্থির। অগণিত ফ্যান ম্যামোত্থির। তাকে কেরালার মানুষ ভীষণ রকম পছন্দ করে। বলিউডে একজন অমিতাভ বচ্চন যেমন সমাদৃত, মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রিতে ম্যামোত্থির অবস্থান অনেকটা সেরকম। এই মাপের একজন মানুষের সন্তান যখন সিনেমায় আসবে, তখন সবাই কানাঘুঁসা করবে, ছেলেটা নিশ্চয়ই বাপের ফেস ভ্যালুর কারণে সুযোগ পেয়েছে। বাপ এতো বড় হিরো না হইলে জীবনেও এতো প্রিভিলেজ পেতো না।
দুলকার সালমানের মনেও এই ভয়টা ছিল। তিনি নিজের 'ট্রু কলিং' এর জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এমনিতে তার প্রতিভার শেষ নেই। ছোটবেলা থেকে তিনি শর্ট ফিল্ম বানানোর চেষ্টা করতেন। তার এমনিতে মনে হতো তিনি গল্প বলতে ভালবাসেন। তিনি ডিরেক্টর হবেন একদিন। অভিনয়টা ভয় পেতেন। কারণ, সবাই তার বাবাকে টেনে আনবে এই ভয়ে কিংবা সে অভিনয় করলেই সবাই তার বাবার অভিনয়ের সাথে তুলনা করা শুরু করে দিবে।
কিন্তু তিনি অবশেষে সত্যিকারের তাগিদ অনুভব করলেন সিনেমার জন্য। এটা ছিল তার নিজের একটি শর্ট ফিল্মের সময়কার কাহিনী। সেই শর্ট ফিল্মটি একটা কন্টেস্টে সংক্ষিপ্ত তালিকায় ঠাই করে নেয়। তিনি সেই শর্ট ফিল্মটিতে অভিনয়ের সময় খেয়াল করলেন একটা দৃশ্য সঠিক ভাবে করার জন্য তিনি গোটা একটা দিন না খেয়ে কিংবা না ঘুমিয়েও কাটিয়ে দিচ্ছেন। তার মাথায় শুধু চলে কীভাবে শট পারফেক্ট করা যায়! তখন তিনি বুঝতে পারলেন তিনি আসলে অভিনয় করবেন, করতে চান।
তবে তার আগে শেষ করলেন পড়ালেখা। আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ব্যাচেলর পড়লেন। সিনেমা জগতে প্রবেশের আগে পড়ালেখাটা শেষ করতে চেয়েছিলেন তিনি। এমনকি বিয়েটাও করে ফেলেছিলেন সিনেমায় অভিষেক হওয়ার আগেই। ২০১২ সালে তার প্রথম সিনেমা সেকেন্ড শো মুক্তি পাওয়ার ৪৪ দিন আগে ভালোবাসার মানুষ আমাল ইউসুফের সাথে বিবাহবন্ধণে আবদ্ধ হন দুলকার। তার একটি কন্যা সন্তানও আছে।
দুলকার পারিবারিক ভাবে ভীষণ সুখী একজন মানুষ। তার নিজের পরিবারের বন্ডিংটাও বেশ মজবুত। তারা প্রায়ই স্বপরিবারে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে যান। গাড়ি ড্রাইভ করেন দুলকারের বাবা নিজেই। তার বাবা ম্যামোত্থি একদম বন্ধুর মতো মিশেন দুলকারের সাথে। ম্যামোত্থি কখনো কোনো কিছু চাপিয়ে দেন নি। এখনো দুলকারের কোনো সিনেমার স্ক্রীপ্ট সিলেকশন নিয়ে নিজের মতামত দিয়ে প্রভাবিত করতে চাননা। তিনি ছেলেকে তার মতো চলতে দিয়েছেন। দুলকার সালমান নিজে যখন সিনেমার অফার যখন গ্রহণ করেন তার বিবেচনায় থাকে এই সিনেমা তাকে নতুন কোনো চ্যালেঞ্জ দিতে পারলো কি না।
যখন আর নতুন কিছু করার সাহস পাবেন না, তখন অভিনয়টা ছেড়ে দিবেন এমনটাই ভাবেন এই অসাধারণ অভিনেতা। দুলকারের সিনেমায় খেয়াল করলে দেখবেন প্রায় সিনেমায় তাকে বাইক নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। মনে হবে যেনো দুলকার মারাত্মক রকমের বাইক ফ্রিক। প্রায় সব সিনেমায় বাইক থাকাটা কাকতালীয় হতে পারে, বাইকের প্রতি দুলকারের ভালবাসাও থাকতে পারে, কিন্তু তার বড় নেশা হলো পুরাণ গাড়ির প্রতি। তার কালেকশনে বেশ কিছু পুরাণ গাড়ি আছে। এমনকি তার একটা ওয়েবসাইটও ছিল, যেখানে তিনি পুরাতন গাড়ি কেনাবেচা করতেন।
এখানেও তিনি গল্প খোঁজেন। একটা কয়েকবার হাতবদল হওয়া পুরান গাড়ি ক্রয়ের পর তিনি এর প্রথম মালিককে খুঁজে বের করেন, তিনি জানতে চান গাড়ির স্মৃতি, গাড়িটাকে ঘিরে জমে থাকা গল্প, গাড়ি কেনো বিক্রি হলো, পরিবার কোনো বিপদে না থাকলে মানুষ সহজে গাড়ি বিক্রি করে না। দুলকার এই গল্পগুলো খুঁজে বেড়ান।
দুলকার সালমানের আরো একটি গুণের কথা তো বলাই হলো না। তিনি গানও গাইতে পারেন। এমনকি তিনটি সিনেমায় তিনি প্লেব্যাক গেয়েছেনও। চার্লি সিনেমায় গাওয়া গানটা আমার ব্যাক্তিগতভাবে বেশি পছন্দ। এমনকি তিনি লেখালেখিও করেন। দুলকার সালমান কলেজ জীবন থেকেই টুকটাক লিখেন। গল্প বানান। স্ক্রিপ্ট লেখেন। এখন সিনেমার ব্যস্ততায় তেমন কিছু ভাবার সময় পাচ্ছেন না। তার মতে লেখালেখি একটা শৃঙ্খলার বিষয়। ভাবতে হয় অনেক। সময় দিতে হয়। তার স্বপ্ন নিজের লেখায় একটা সিনেমা ডিরেকশন দিবেন, অদূর ভবিষ্যতে।
আমেরিকার জীবন দুলকারকে অনেকগুলো কালচারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সেখানে বড় ইন্ডিয়ান কমিউনিটি আছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষরা একত্রে থাকে। ফলে, অনেকগুলো ভাষা তিনি সেখান থেকে শিখার চেষ্টা করতেন। তিনি শুনে শুনে ধরতে চেষ্টা করতেন কোনটা পাঞ্জাবি, কোনটা তামিল, কোনটা মাদ্রাজি ভাষা। এই কারণে এখন যখন মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রির বাইরেও ভাল কোনো সিনেমার অফার আসে তখন তিনি এই চ্যালেঞ্জগুলো আরো আগ্রহভরে নেন। হিন্দিতে তিনি খুব সাবলীল, তামিলও নিজে নিজে বলতে পারেন। তেলেগুও উচ্চারণ করে করে নিজের সিনেমার ডাবিং নিজেই করতে পারেন। একসাথে অনেকগুলো ভাষার এই দখল তাকে অন্য সব নায়ক থেকে আরো বেশি এগিয়ে রাখে।
ম্যামোত্থির প্রতিভাবান পুত্র এখন মালায়লাম ইন্ডাস্ট্রি মাতিয়ে রাখছে। আজকাল অবস্থা এমন মানুষ দুলকারকে বলে না, তুমি ম্যামোত্থির ছেলে। বরং এভাবে পরিচয় দেয় যে, মালায়লাম সিনেমার হার্টথ্রুব দুলকার সালমানের পিতা ম্যামোত্থি। এই যে দুলকার নিজের কাজে প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন সেটা সম্ভব হয়েছে তার পিতার কারণে। ম্যামোত্থি দুলকারকে ছোটবেলায় বলতেন, "আমি বলতে চাই না তুমি স্কুলে ফার্স্ট হও, ভাল স্কোর করো, এটা হও, সেটা হও। সেসব একেবারেই তোমার ব্যাপার। আমি শুধু এটাই বলতে চাই আমি যে কাজটা করছি সেটাতে আমি সেরা। আমি তিনবার ন্যাশনাল এওয়ার্ড পেয়েছি, মানে আমি তিনবার সারা দেশের নাম্বার ওয়ান। তাই তুমি কী করতে চাও সেটা তুমিই ঠিক করো, কিন্তু আমি এরকমই, যা করি সেটায় সেরা।" ম্যামোত্থির এই মজা করে বলা কথাটাও হয়ত দুলকারকে নিজের কাজের প্রতি আরো বেশি নিবেদিত হতে প্রেরণা যুগিয়েছে।
বাবাকে ভীষণ ভালবাসেন দুলকার। ছোটবেলায় বাবার সিনেমা দেখার জন্য থিয়েটারে যাওয়ার স্মৃতিও তার মনে পড়ে। কেউ যদি তার বাবার সিনেমা নিয়ে উলটাপালটা কিছু বলতো তাহলে তার ভীষণ খারাপ লাগতো। আবার কেউ সিনেমা নিয়ে ভাল কিছু বললে তার কি যে খুশি লাগতো! দুলকার সালমান নিজেই তার বাবার সবচেয়ে বড় ফ্যান। তার কাছে মনে হয় সে অতটা সুদর্শন না, এই কথা তার বেশি মনে হয় বাবার সামনে দাঁড়ালে। তার বাবাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন তরুণ মনে হয় দুলকারের, মনে হয় বাবা এখনো তার চেয়েও তরুণ।
যেহেতু বাবা সিনেমার লাইনে আছেন, তাই দুলকার নিজেও জানতেন সিনেমা করা তার জন্য সহজ। সব সিনেমার তারকাদের সন্তানদের জন্য হয়ত সিনেমার জগতে প্রবেশ করা সহজ। কিন্তু দুলকার একটু অন্যরকম ভাবে ভাবতেন। তার কথা হলো, "যদি আমি সুযোগ পাই সেটা নষ্ট করা যাবে না। কারণ ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করা সবসময়ই সহজ, কিন্তু এখানে কতদিন আপনি টিকে থাকবেন সেটাই বড় প্রশ্ন।" তাই ম্যামোত্থির ছেলে বলে বাড়তি ফেভার নিয়ে তিনি সিনেমায় আসতে চাননি। তার লক্ষ্য যে দুলকার সালমান হওয়া!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন