পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষনীয় শহরটার নাম দুবাই। কে না আসতে চায় এখানে! কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠে রয়েছে অন্য গল্প, যা আমরা কজনই বা জানি..

পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষনীয় শহরটার নাম দুবাই। কী নেই সেখানে? বিলাসবহুল আকাশছোঁয়া বিল্ডিংগুলো যেন চাঁদকে ছুঁয়ে ফেলবে। দামি দামি গাড়ি, সহজলভ্য স্বর্ণ, আয়েশী জীবনযাপন- ব্যস্ততম এই শহরে পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য যেন কোনো কিছুরই অভাব নেই। যে কেউ এই শহরে আসতে চাইবে। কিন্তু, চকচকে ও ফিটফাট এই শহরের রাতারাতি বদলে যাওয়া ও বিশ্ববাসীর নজরকে তাক লাগিয়ে দেয়া সুযোগ–সুবিধার আড়ালেও কিছু গল্প থাকে। সব গল্প যেমন আনন্দময় নয়, তেমনি দুবাইও ধারণ করে আছে কিছু গল্প, যা শুনলে নিশ্চিতভাবেই মনে হবে- চকচক করলেই সোনা হয় না!

১. শ্রমিকদের উপর অমানুষিক চাপ প্রয়োগ 

দুবাই প্রশাসন ট্যুরিস্টদের একটি পরামর্শ দেয়। সেটি হচ্ছে, দুবাইতে যখন তাপমাত্রা যখন ১২০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায় তখন যেন কোনো ট্যুরিস্ট সূর্যের আলোতে পাঁচ মিনিটের বেশি অবস্থান না করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি তারা এই নিয়মটি শ্রমিকদের বেলায় মানে না। ১২০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় শ্রমিকরা প্রায় ১৪ ঘন্টা দৈনিক টানা কাজ করে! এই ফিচারটি আপনি যখন পড়ছেন, তখন দুবাইতে হয়তো আরো নতুন ১০টি আকাশছোঁয়া দালানের নির্মাণকাজ শুরু হচ্ছে। তাতে কী! পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় পয়সাওয়ালা মানুষের বিনিয়োগ হয়তো এখন দুবাইমুখী, তবে মানবতামুখী তো আর নয়।

২. রাতে পালটে যায় দুবাইয়ের খোলস 

একটু আগেই কঠোর কঠোর যে নিয়মের কথা শুনিয়েছি তা অবশ্যই সত্য, তবে রাতের বেলায় প্রকাশ্যেই এই নিয়মের বরখেলাপ হয়। সবচেয়ে প্রাচীন পেশা দেহব্যবসা দুবাইয়ে অর্থ কামানোর অন্যতম উপায়। প্রায় ৩০ হাজার দেহব্যবসায়ী রাতে দুবাইতে তাদের শরীর প্রদর্শনী করে, তাদের ঘন্টা প্রতি পারিশ্রমিক ৫০০ ডলার! পুলিশ স্বাভাবিকভাবেই রাতের এসময়টায় অন্ধ হয়ে যায়।

রাতের বেলায় প্রকাশ্যেই প্রাচীন পেশা দেহব্যবসা করতে দেখা যায়

৩. তেলের মজুদ শেষ হলেই দুবাইয়ের খেলা শেষ

কালো টাকা আর স্বর্ণ থাকলে রাজপ্রাসাদ যেকোনো জায়গাতেই বানানো যায়। কিন্তু কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। যেমন চিরস্থায়ী নয় দুবাইয়ের তেলের মজুদ, যা তাদের অর্থের প্রধান উৎস। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সাধারণত তেলের উপর নির্ভর করে। তাদের অর্থনীতি তেল বিক্রয়ের মাধ্যমেই টিকে আছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর মতো দুবাইও ভুলে বসে আছে যে তাদের তেলের খনির জোর আর বেশিদিন নেই। আগামী ২০ বছর পর তাদের কাছে আর পর্যাপ্ত তেল থাকবে না। এর ফলে অবশিষ্ট তেলের দাম এত বেশি হবে যে তাদের অন্য কোনো জ্বালানি শক্তির উপর ঝুঁকতে হবে। তখন দুবাই টের পাবে ভবিষ্যৎ চিন্তা না করেই অর্থের এই নিদারুণ অপচয় তাদের কি দুঃসময়ের দিকেই না ঠেলে দেয়। 

৪. বর্ণবাদ আচরণের আখড়া 

পৃথিবী উন্নত হচ্ছে, মানুষের চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন হচ্ছে। বর্নবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে এখন কমবেশি সবাই সোচ্চার। কেউ আজকাল এটি পছন্দ করে না। কিন্তু দুবাই কাজে কর্মে তার বর্নবাদী দর্শনের প্রমাণ দিয়েই যাচ্ছে। এই শহরে যারা কাজ করতে আসে তাদের বেতনের মধ্যেও তফাৎ। ইউরোপ-অ্যামেরিকা থেকে যারা এখানে আসে, তারা একই কাজের জন্য দুইগুণ, তিনগুণ বেশি বেতন পায় অনুন্নত দেশের মানুষের তুলনায়। নারীরা এখানে পুরুষের তুলনায় কম বেতনে কাজ করে। শরীরের রঙও বেতন নির্ধারণের মাপকাঠি এখানে!

৫. নেই বাকস্বাধীনতা 

দুবাই এমন এক শহর যেখানে যতক্ষণ আপনি সরকারের সুরে সুরে কথা বলবেন ততক্ষণই কথা বলার সুযোগ পাবেন, এর বেশি নয়। যখনই কেউ কোনো ইস্যু নিয়ে অথবা সমস্যা নিয়ে প্রতিবাদ করতে চায়, তাদের কাছে একটি ফোন কল আসে। তথাকথিত “সিক্রেট পুলিশ অফ দুবাই” এই কল দেয়। তাদের কথাবার্তা খুবই স্পষ্ট। কেউ কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন তুললে তার জন্য মাত্র দুইটা অপশন। ১. এখনই চুপ করো, অথবা ২. এত দিনে যা অর্জন করেছো তা হারাবার জন্য প্রস্তুত হও।

৬. বন্য প্রাণীরও নেই স্বাধীনতা  

দুবাইয়ের শেখদের এত বেশি টাকা যে তারা মাঝে মধ্যে টাকা খরচ করার আর উপায় খুঁজে পায় না। এখন তাদের অন্যতম ট্রেন্ড হচ্ছে একটি বন্য প্রাণী পোষা। কুকুর, বিড়ালে এখন আর তারা মজা পায় না; তাই বাঘ, সিংহ, চিতার মতো বন্য প্রাণীর দিকে তাদের নজর! এইসব বন্য প্রাণী দুবাইতে একটুও শান্তিতে নেই, কারণ প্রকৃতি ছেড়ে তাদের এখন থাকতে হচ্ছে বড়লোকের বাড়িতে। প্রচুর অর্থ খরচ করে এসব বন্য প্রাণী ধরা ও পোষ মানানো হয়তো যায়, কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কোনো কিছুই বেশি বেশি করা ঠিক কিনা, কে জানে!

৭. সোনাপুর- দ্যা লেবার ক্যাম্প 

দুবাইয়ের আশেপাশেই সোনাপুর নামে একটি জায়গা রয়েছে যার কথা হয়তো অনেকেই শুনেনি। গরীব শ্রমিকেরা এখানে মানবেতর জীবনযাপন করে। অনুন্নত দেশ থেকে “জীবন বদলে যাবে একবার দুবাই গেলে”- এমন স্বপ্ন নিয়ে যাওয়া প্রায় ১৫ হাজার গরীব শ্রমিক এখানে অসহ্য যন্ত্রণার জীবন কাটায়। একটা ছোট খুপড়ি ঘর আট দশজনে শেয়ার করে থাকে। ১০০ জন মানুষের জন্য একটা বাথরুম। আর খাবার? দিনে একবেলা পাওয়াটাই যেখানে বড় সৌভাগ্যের!

শ্রমিকেরা সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করে

৮. পরিবেশ দূষণ ও পানি অপচয়ের শহর

দুবাই এর বিনিয়োগকারীরা কেউ অপেক্ষা করতে চায় না। পরিবেশের কি ক্ষতি হলো, শ্রমিকদের কি হাল অবস্থা- এসব তারা কখনোই বুঝতে চায়নি। বড় বড় কন্সট্রাকশনের ফলে প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে ড্রেনের ময়লা, রাসায়নিক পদার্থ। এত বেশি ময়লা হয় যে রাতারাতি তা সরিয়ে ফেলার জন্য তারা এখন সাগরকে ব্যবহার করে। অনেক ট্যুরিস্ট অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন যে সাগর আগের মতো পরিষ্কার নেই, দিন দিন নোংরা হচ্ছে। আবার এদিকে মরভূমির এলাকা দুবাই তাদের বিলাসবহুল গলফ কোর্টগুলো সবুজ রাখার জন্য প্রতিদিন অপচয় করছে ৪০ লাখ গ্যালন পানি। যেখানে পুরো বিশ্ব বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে ভুগছে সেখানে এমন অপচয় একমাত্র দুবাইবাসীদের দ্বারাই সম্ভব!

৯. নকল চাকচিক্যের অন্তরালে 

দুবাইয়ে যারা সাধারণ চাকরি করেন, তাদের অনেকেই বলেন, এখানকার সব কিছুই নকল। গাছের পাতা থেকে শুরু করে মানুষের হাসি পর্যন্ত! এখানে ধনীরা দুবাইকে এমনভাবে তৈরি করেছে বাইরের মানুষরা এসে চাকচিক্য ও বিলাসবহুল সুবিধা উপভোগ করে নিজেকে রাজা মনে করবে। কিন্তু কিছুদিন গেলেই বুঝা যায় এই চাকচিক্য আর আরামের অনুভূতি শুধু টাকা দিয়ে কেনা নকল ইমোশন। এখানে যার টাকা নেই, তার জন্য আইনও কঠোর। শো-অফের এই শহরে শ্রমিকদের জন্য কিছু নেই, অথচ লাখ লাখ ডলার দিয়ে কেনা ল্যাম্বরগিনি, বিএমডাব্লিউ গাড়ি অসুস্থ গতিতে চালিয়ে এক্সিডেন্ট করে মানুষ মারাও এখানে ফ্যাশন। মধ্যযুগীয় দাসপ্রথা, বর্নবাদী আচরণ, পরিবেশ নষ্ট করা আর তৃতীয় বিশ্বের সস্তাশ্রম দিয়ে বদলে ফেলা এই শহর, যেখানে মানুষ হাসেও টাকায়, কাঁদেও টাকায়।  

(দ্য রিচেস্ট অবলম্বনে)

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা