ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিরিন সীমা ঘরবন্দী সময়টায় নিজের অনূভুতি ব্যক্ত করেছেন। তাঁর প্রিয় ক্যাম্পাস, হলের বেলী ফুল গাছ, ব্যস্ত রাস্তা, মানুষ.. শুধুই কি তাঁর হাহাকার শব্দাকারে বের হলো, না পুরো বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের?

পাশের বাসায় এক নবজাতক জন্ম নিয়েছে কয়েকঘন্টা আগে। পৃথিবীতে এসেই চিৎকার করে জানিয়ে দিচ্ছে তার অধিকার। সে জানে না পৃথিবী এখন অসুস্থ। সেদিন প্রথম আলোতেই পড়লাম, করোনাকালীন জন্ম নিবে আরো ২৪ লাখ শিশু! প্রসূতি ও শিশু মৃত্যু হার এখনো অনেক বেশি। করোনাকালীন সময়ে এটা হবে আরো চ্যালেঞ্জিং। 

ইদের আগে থেকেই বাজারে সবজি, ব্রয়লারের দাম বেশ চড়া, খবরে দেখলাম ঢাকাতেও বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম।

মধ্যরাতে টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ আমার মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছে। ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার আজ ৭৫ তম দিন। এইসময় কৃষ্ণচূড়া গাছগুলি ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে। ঘন্টা দুয়েকের ঝুম বৃষ্টিতে পানি জমে যায় মল চত্ত্বরে। টলটলে পানি লাল হয়ে যায় তার মাঝে ভাসতে থাকা কৃষ্ণচূড়ায়। তাই  বৃষ্টি হলেই সেই আগুন আমাকে ডাকে।

কেমন আছে আমার সেই ফুলগুলো?  

এখানে হুট করে বৃষ্টি এলে কালবৈশাখীর চেয়ে দ্রুত  বিদ্যুৎ চলে যায়। গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে আমি বারান্দায় যাই। বৃষ্টিস্নাত অজানা ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে বাতাসের সাথে। আমার মন খারাপ দ্বিগুণ হয়। রোকেয়া হলের বারান্দায় আমার নিজস্ব সম্পদ বলতে কিছু গাছও ছিল। যেদিন চলে আসি, আমার বেলী ফুলের গাছে নতুন কলি এসেছিল। কেমন আছে ওরা? ফিরে গিয়ে দেখতে পাবো তো? 

ইন্টারনেট সংযোগ তেমন ভালো না এখানে। মাঝে মাঝে বাসার বাইরে গিয়ে ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে যুক্ত থাকার চেষ্টা করি। অনেকেই অনেক সৃজনশীল কাজ করছে, জমানো বই পড়ছে, ছবি আঁকছে, গান গাইছে, কবিতা লিখছে, নিজের স্কিল ডেভলোপ করছে কেউ কেউ, কেউ আবার এই ফাঁকে বিসিএসের জন্য জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেউ বা জিআরই, আইএলটিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবু ঘুরে ফিরে সেই হতাশার কথা। 

করোনার পর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক  মন্দার হাওয়া সবার স্বপ্নকে ছুঁয়ে যাবে। বিদেশে পড়তে যেতে  চাওয়া বান্ধবীর আশংকা- হয়তো আশানুরূপ ফান্ড পাবে না। সদ্য গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা বন্ধুটি আশা দিয়েছিল তার প্রেমিকাকে, খুব তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলেই বাসায় জানাবে। এখন আড়াই মাস ধরে দুজন দেশের দু'টি বিভাগে বন্দী। ছেলেটি প্রতি নিঃশ্বাসে ভয় পায়, করোনার পর তার প্রিয়তমার হাত ধরার অধিকারটুকু থাকবে তো?

প্রিয় ক্যাম্পাস, মাঝে মাঝে তোমার উপর অভিমান হয়। তুমি তো ভালোই আছ আমাদের ছাড়া। শুনেছি শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ কমেছে। 

"তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে কোন্ বৃহস্পতিবার, 
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখিনা" 

কিন্তু ক্যাম্পাসের অনেকগুলি গাছ দেখতে পাব না ফিরে গিয়ে, কষ্ট হয়। করোনার আগের পৃথিবী আর করোনার পরের পৃথিবী কখনোই এক হবে না!

'এক কোটি বছর হয় তোমায় দেখি না' 

বাসায় থাকা গল্পের বইগুলো অনেকবার পড়া হয়েছে, নতুন বই না থাকায় আরো একটু নেড়েচেড়ে দেখি। সেদিন খুলেছিলাম শরৎবাবুর শ্রীকান্ত, মাথায় গেঁথে গেছে একটা লাইন, "শ্রীকান্তরে, তুই বড় অপয়া!"

পাহাড় ডাকে, প্রিয় বন্ধুদের জন্য মন কাঁদে, প্রিয় কাম্পাসের কেটে ফেলা গাছেদের জন্য হৃদয় হাহাকার করে, এনেক্সের মাঠের সোনালু গাছটার জন্য ব্যাকুল হই। গণ পরিবহণ খুলেছে ক'দিন হলো। তবু দুর্যোগে তেলাপোকা হয়ে আমার পা দুটি জিম্মি ঘরের কোণেই, আপনজনদের নিরাপদ রাখতে।

নিজেকে শান্ত করার ছুতো খুঁজি প্রিয় ওমর খৈয়ামের কবিতায়, "এই মুহূর্তগুলিই তোমার জীবন। উপভোগ করো।"

লেখিকা- শিরিন সীমা, শিক্ষার্থী (ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

ছবি কৃতজ্ঞতা- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা