র্যাগিং থেকে র্যাগ ডে: তিনশো শিক্ষকের সভায় এ কেমন ভুল!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভার্চুয়াল সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন বিভাগের ডিন, শিক্ষক, প্রো-ভিসি সহ প্রায় তিনশো শিক্ষক। সেখানে এরকম একটি ভুল কারো চোখে পড়েনি, তা মেনে নেয়া একটু কষ্টকরই হয়ে যায়...
জল আর জলপাই কী এক? আম আর আমলকি কী এক? আচ্ছা, এগুলোও বাদ। আলু আর আলুবোখারা কী এক? ভাবছেন, এ কী তামাশা করছি লেখার শুরুতেই! মোটেও তামাশা ভাববেন না, এটি অতীব সিরিয়াস লেখা। তাই খুব সিরিয়াসনেসের সাথেই লেখাটা পড়ার অনুরোধ থাকবে।
আমি গত দুইদিন ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগবাজি দেখছি। খুব যে খারাপ লাগছে তাও নয়৷ করোনাকালে এমনিতেই তো মানুষের সুস্থ আনন্দ-বিনোদন কমে গিয়েছে। সেখানে এরকম নির্মল হাসিখুশির উপকরণ পাচ্ছি, তা তো নেহায়েত ফেলনা নয়। এজন্যে তারা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
দুইদিন আগে তারা প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেন। বড় হেডিং এ বোল্ড হরফে লিখলেন- ঢাবিতে র্যাগ-ডে নিষিদ্ধ। সেখানে বিভিন্ন অনুষদের ডিন, শিক্ষকবৃন্দ, প্রো-ভিসি'রা সহ উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৩০০ জন শিক্ষক। সেখানে তারা 'র্যাগ ডে'কে নিষিদ্ধ করলেন। শুধু নিষিদ্ধ করলেই হতো। সেখানেই থেমে থাকেননি তারা। এই উৎসবকে 'নিষ্ঠুর, অমানবিক, নীতিবিরুদ্ধ' ট্যাগও লাগালেন। স্বভাবতই শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হলো। বাতাসের আগে ছুটলো এই সংবাদ। ২রা সেপ্টেম্বরের এই প্রেস বিজ্ঞপ্তি ভাইরাল হয়ে গেলো সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সবই ঠিক ছিলো। তারা 'র্যাগ ডে' নিষিদ্ধ করলেন, তাও মানলাম। কিন্তু এই ঘটনার এক দিন পরেই তাদের মুখে দেখলাম ভিন্ন কথা। মানুষের তোপের মুখে অথবা বিদ্রুপের ফলশ্রুতিতে কী না জানিনা, তারা বিজ্ঞপ্তি আবার পরিবর্তন করলেন। 'র্যাগ ডে সংক্রান্ত সংশোধিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি'তে তারা লিখলেন- তাদের সংবাদ নাকি অসাবধনতাবশত ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তারা 'র্যাগ ডে' নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছেন না। বরং যাতে অনুষ্ঠানগুলো সুশৃঙ্খলভাবে করা যায়, সেজন্যে নীতিমালা প্রনয়ণ প্রনয়ণ করার কথা ভাবছেন।
এরকম বিপরীতমুখী 'প্রেস বিজ্ঞপ্তি' আমাদের সামনে কয়েকটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো দুম করে। যে সভায় তিনশো জনের মত শিক্ষিত মানুষ ছিলেন, তারা এই ভুলটা বুঝতে পারলেন না? 'প্রেস বিজ্ঞপ্তি'র হেডিং এর এই ভুলটা কী একেবারে কারোই চোখে পড়লো না? কারো চোখেই না? এরকম অদ্ভুতুড়ে ঘটনা ও সেটির এরকম দায়সারা ব্যাখা হজম করা একটু কষ্টকর বৈ কী। সে সাথে, আরেকটি প্রশ্নও মাথায় চলে এলো, তারা কী 'র্যাগিং' ও 'র্যাগ ডে' এর পার্থক্য জানেন? এরকম অজস্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের উদাহরণ দেয়া যাবে, যারা র্যাগিং ও র্যাগ ডে'কে বরাবরই এক জিনিস ভেবে এসেছেন। শুধুমাত্র এই ব্যাখা দিয়েই তাদের অদ্ভুতুড়ে ভুলকে জাস্টিফাই করা যায়। আর কোনো প্রাসঙ্গিক ব্যাখাই দেওয়া যায় না এক্ষেত্রে।
তাছাড়া, তারা বলেছেন, 'র্যাগ ডে' সুষ্ঠুভাবে পালনের লক্ষ্যে ভিন্ন নীতিমালা প্রনয়ণ করবেন। মানলাম। কিন্তু আগের 'প্রেস বিজ্ঞপ্তি'তে যে 'র্যাগ ডে'কে নিষ্ঠুর, অমানবিক, নীতিবিরোধী বলা হয়েছে, সেটি নিয়ে যে ধোয়াশা তৈরী হয়েছে, সেটির উত্তর আমরা পাইনি। তারা কী র্যাগ ডে'কে নিয়ে তাদের আগের তিনটি শব্দ থেকে সরে আসবেন? নাকি, সেগুলোকে ঠিক রেখেই তারা নতুন নীতিমালা প্রনয়ণ করবেন, সেটি বোধগম্য না। তারা কী এখনো 'র্যাগ ডে'কে অমানবিক, নিষ্ঠুর, নীতিবিরোধী ভাবছেন? নাকি ভাবছেন না? এখানে একটি অস্পষ্টতা রয়ে গিয়েছে।
তাছাড়া বিজ্ঞপ্তি থেকে জানলাম, শিক্ষাসমাপনী বা গ্রাজুয়েশন শেষের পর ছেলেমেয়েরা যে 'র্যাগ ডে' পালন করেন, সেখানে তারা নীতিমালা দেবেন। কোন রকম নীতিমালা দেবেন? সেটি আসলে ছেলেমেয়ের স্বাধীনতাকে কতটুকু খর্ব করবে? ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ অনুষ্ঠানটি ঠিকঠাকভাবে পালন করতে পারবে তো? সে প্রশ্নও কিন্তু রয়ে যায়। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যখনই সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে, সেই বিষয়টি তখন আর শিক্ষার্থীদের অধিকারে থাকেনি। প্রশাসন আস্তে আস্তে গ্রাস করে নিয়েছে পুরোটাই। র্যাগ ডে'র ক্ষেত্রে সেরকমটি হবে না তো?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের আগের সিদ্ধান্তের ভুল বুঝতে পেরে আবার নিজেদের সংশোধন করেছেন, এটি নিঃসন্দেহে ভালো বিষয়। কিন্তু এখন তারা যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন, সেখানেও অজস্র 'যদি-কিন্তু-অথবা' রয়ে গিয়েছে, অনেক জায়গায় ঝাপসা কথাবার্তাও রয়ে গিয়েছে। যেগুলোর সঠিক উত্তর, সদুত্তর দেয়াটা জরুরি। তাছাড়া ৩০০ জন মানুষের একটি সভায় এত বড় একটি ভুল হয় কী করে, সেটাও একটু খতিয়ে দেখা জরুরি। এতগুলো শিক্ষিত মানুষের সভায় এরকম সিরিয়াস বিষয়ে 'অসাবধনতাবশত ভুল' কথাটা খুবই পলকা। এটা কোনো অর্থই বহন করেনা। এরকম দায়সারা গোছের কাজ একটি দায়িত্বশীল প্রশাসন করলে সেটি ভালো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনা। এসব বিষয়ে প্রশাসনের উচিত তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা।
নাহয় মানুষের বিদ্রুপ, অনাস্থা বাড়তেই থাকবে এদের উপর। কমবে না। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের জন্যে যা হবে একটি লজ্জারই বিষয়।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন