পেশায় তিনি ড্রাইভার, ছাব্বিশ হাজার টাকা বেতন; অথচ তার সম্পদের পরিমাণ কয়েকশো কোটি টাকা! ঢাকায় তার সাততলা দুটো ভবন আছে, জমি আছে কয়েক জায়গায়, আছে ডেইরি ফার্ম, সরকারী পাজেরো গাড়ি ব্যক্তিগত দরকারে ব্যবহার করেম তিনি...

রনবীর সিংয়ের 'গালি বয়' সিনেমাটা তো অনেকেই দেখেছেন। সেখানে একটা ডায়লগ ছিল- "ড্রাইভারের ছেলে তো ড্রাইভারই হবে, বড় স্বপ্ন দেখার দরকার কি?" ড্রাইভার হওয়াটা দোষের কিছু না, স্বপ্ন দেখাতেও ভুল কিছু নেই, স্বপ্ন দেখা উচিত, স্বপ্ন পূরণের দিকেও হাঁটা উচিত। তবে কেউ যদি হন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের গাড়িচালক, তাহলে তাকে জীবনের আইডল মানা যায়, তার মতো হওয়ার চেষ্টাও করা যায়। ড্রাইভিং পেশাটা সম্মানজনক কিনা, বেতন ভালো কিনা, সামাজিক নিরাপত্তা আছে কি নেই- এতসব না ভেবেও ড্রাইভার হবার স্বপ্ন দেখা যায়। কারন আবদুল মালেক নামের যে লোকের ছবি দেখতে পাচ্ছেন, তিনি তো ড্রাইভার হয়েও সফলতার অন্যরকম একটা বেঞ্চমার্ক তৈরি করে দিয়েছেন, নিজেকে নিয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরের একটা উচ্চতায়! 

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (শিক্ষা) গাড়িচালক আব্দুল মালেক ওরফে মালেক ড্রাইভারকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র দেখিয়ে ভয়ভীতি, চাঁদাবাজি, জাল টাকার ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আছে। এই কিংবদন্তীতুল্য ব্যক্তির কাছ থেকে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার জাল টাকা ও একটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ঢাকার কামারপাড়ায় ৪২ নম্বর বামনেরটেক হাজী কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলার বিলাসবহুল বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে গতকাল। তবে চোখ কপালে তুলে দেয়ার মতো খবর হচ্ছে, র‍্যাব তার শত কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে! 

আবদুল মালেকের সম্পদের বিবরণী শুনলে ভিরমি খাবে যে কেউই। একজন ড্রাইভারের সম্পদের পরিমাণ কিভাবে কয়েকশো কোটি টাকা হতে পারে, এই হিসেব সর্বসাধারণের মাথায় ঢুকবে না। অবশ্য বাংলাদেশ হচ্ছে সব সম্ভবের দেশ, এখানে শুধু অনন্ত জলিলই অসম্ভবকে সম্ভব করেন না, ড্রাইভার মালেকরাও করে। মালেকের স্ত্রীর নামে দক্ষিণ কামারপাড়ায় ২টি সাততলা বিলাসবহুল বিল্ডিং আছে। ধানমন্ডির হাতিরপুল এলাকায় ৪.৫ কাঠা জমিতে একটি নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবন আছে তার। দক্ষিণ কামারপাড়ায় ১৫ কাঠা জমিতে একটি ডেইরি ফার্ম আছে, যেটি তার ছেলে পরিচালনা করে। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত আছে। 

মালেক ড্রাইভারের নূরানি চেহারা দেখে যে কেউই তাকে পরহেজগার নিষ্পাপ বান্দা হিসেবে ভেবে বসতে পারে। দুটি বিয়ে করেছে সে। প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তারের নামে তুরাগ থানাধীন দক্ষিণ কামারপাড়া রমজান মার্কেটের উত্তর পাশে ছয় কাঠা জায়গার ওপর সাততলার (হাজী কমপ্লেক্স) দুটি আবাসিক বিল্ডিং আছে। দুই ভবন মিলিয়ে মোট ২৪টি ফ্ল্যাট আছে। এছাড়া আনুমানিক আরও ১০/১২ কাঠার প্লট রয়েছে ঢাকা শহরে। সপরিবারে এই ভবনেরই তৃতীয় তলায় বাস করেন মালেক। বাকি ফ্ল্যাটগুলোর কয়েকটি ভাড়া দেয়া হয়েছে। সেখান থেকেও প্রতি মাসে মোটা অংকের টাকা আসে। 

ড্রাইভার মালেকের মেয়ে বেবির নামে দক্ষিণ কামারপাড়ায় প্রায় ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ‘ইমন ডেইরি ফার্ম’ নামে একটি গরুর খামার রয়েছে। সেখানে প্রায় ৫০টি বাছুরসহ গাভী রয়েছে। আবদুল মালেকের বর্তমান বেতন বেসিক ২৬ হাজার ১০০ টাকা হলেও রাজধানীতে তার রয়েছে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক

স্বজনপ্রীতির অনন্য এক নজির স্থাপন করেছে আবদুল মালেক। নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে মেয়ে নৌরিন সুলতানা বেলি, ভাতিজা আবদুল হাকিমকে অফিস সহকারী পদে চাকরি নিয়ে দিয়েছে সে। এছাড়াও নিজের ভাই আবদুল খালেককে অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে মালেক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যে ক্যান্টিন আছে তাতেও আছে আবদুল মালেকের আধিপত্য। নিজের বড় মেয়ের জামাইকে সে ক্যান্টিনের ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রেখেছে। এছাড়াও ভাগ্নে সোহেল শিকারি, ভায়রা মাহবুব ও নিকট আত্মীয় কামাল পাশাকে অফিস সহায়ক পদে চাকরি নিয়ে দিয়েছে মালেক।

আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদফতরে গাড়ি চালক হিসেবে যোগ দেয় ১৯৮২ সালে। বর্তমানে কাগজে-কলমে সে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ৮ম শ্রেণি। মালেক নিজে গাড়িচালক হলেও মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত একটা সাদা পাজেরো জিপ গাড়িটি নিয়মিত ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে থাকে সে। এর বাইরেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরও দুটি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতো সে। নিজের গরুর খামারের দুধ এবং মেয়ের জামাইয়ের ক্যান্টিনের মালামালও বহন করা হতো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়ি দিয়েই। 

স্বাস্থ্য অধিদফতরে ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করে নিজে সেই সংগঠনের সভাপতি হয়েছে মালেক। এই পদের ক্ষমতাবলে সে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভারদের ওপর একছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। ড্রাইভারদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির নামে এই লোক বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করতো। এছাড়া মালেক স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক প্রশাসনকে জিম্মি করে বিভিন্ন ডাক্তারদের বদলি ও পদোন্নতি এবং তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে বলেও অভিযোগ আছে। 

চিকিৎসকদের একটা বিশাল অংশ যারা স্বাস্থ্য অধিদফতরে কাজ করেন, তারা মূলত এই আবদুল মালেককে সমীহ করেই চলে। কারণ শুধু শুধু ভেজালে পড়ার কোনো মানে হয় না। মালেকের সাথে কারো সঙ্গে যদি কোনো সমস্যা হয় তবে দেখা যায় যে, কিছুদিনের মধ্যে চিকিৎসকের বদলির আদেশ চলে আসে। কারণ মালেক ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বড় কর্তাদের প্রিয়পাত্র, কেন প্রিয়, সেই রহস্য ভেদ করা দুদকের কাজ, র‍্যাব-পুলিশের কাজ। এমনকি মালেক গ্রেপ্তার হবার পরেও তার কুকীর্তির ব্যাপারে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না অনেকে!

র‍্যাব আবদুল মালেককে গ্রেপ্তার করেছে অবৈধ অস্ত্র ও জাল টাকার ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পেয়ে। তারপর কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অ্যানাকোন্ডা অজগর। একবার ভাবুন, ছাব্বিশ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করা একজন ড্রাইভারের সম্পদ যদি হয় কয়েকশো কোটি টাকা, তার প্রভাব-প্রতিপত্তি যদি হয় এত ভয়ংকর, মালেক যাদের জন্য কাজ করতো, যাদের ক্ষমতা ব্যবহার করতো, তার সেই 'বড় স্যার'দের সম্পদের পরিমাণ কত? সেসবের তদন্ত কি হবে? দেশটাকে যারা এভাবে লুটেপুটে খাচ্ছে, এই হায়েনাগুলোকে কি আইনের আওতায় আনা হবে কখনও? 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা