ইসলাম সম্পর্কে ভীতিকর মন্তব্য শুনে শুনে বড় হয়েছেন৷ যেহেতু তিনি ইহুদী, তাই অনেকেই তাকে মুসলিমদের এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিত। অথচ মুসলমানদের কাছ থেকে দেখার পর, তাদের সঙ্গে মেশার পর ড্রিউ বিনস্কির ধারণাই পাল্টে গেছে...
লোকটার নাম ড্রিউ বিনস্কি। ধর্মমতে একজন ইহুদী। তিনি মুসলমানদের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন। কেন তার মন্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছি? তা হলো, তিনি এযাবতকালে ১৫০টিরও অধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন। এই ভ্রমণ করাটাই তার পেশা। ঘুরতে ঘুরতে তিনি মিশেছেন এবং দেখেছেন বিভিন্ন দেশের কালচার। তার কাজ এসব দেশকে নিয়ে ভিডিও করা। তিনি একজন ভিডিও কন্টেন্ট মেকার এবং ট্রাভেল ভ্লগার। গলফ তার প্রিয় খেলা। ১৯টি দেশে তিনি গলফ খেলেছেন। ভারতে তিনি সলো ট্রিপ দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও কাটিয়েছেন অনেকদিন। ইউরোপকে দেখেছেন কাছ থেকে। ফলে তার অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে সমীহ না করে উপায় নেই।
সেই ড্রিউ বিনস্কি সাত মাসে ৩৯+ মুসলিম প্রধান দেশ ভ্রমণ করার পর কি ভাবছেন, মুসলিমদের সম্পর্কে তার ধারণা কি? সেই ধারণা নিয়েই তিনি একটি ভিডিও বানিয়েছেন। ভিডিওতে তিনি বলেছেন, ইসলাম পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম যার অনুসারীর সংখ্যা ১.৬ বিলিয়ন। তিনি এতোগুলো দেশ ঘুরবার পর মুসলিম কালচারকে ভালবেসে ফেলেছেন। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাকে ইসলাম সম্পর্কে ভীতিকর মন্তব্য শুনে শুনে বড় হতে হয়েছে৷ যেহেতু তিনি ইহুদী, তাই তাকে অনেকেই মুসলিমদের এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিত। বলতো, মুসলিমরা হলো দুষ্টু লোক। কিন্তু, ড্রিউ বিনস্কি যতই মিশতে শুরু করেছেন মুসলিমদের সাথে, ততই নাকি প্রেমে পড়ে যান মুসলিম কালচারের।
ভিডিও'র এই পর্যায়ে তিনি তার প্রিয় কিছু কারণ বলেন যার কারণে তিনি মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত হন। যে পাঁচটি কারণে মুসলিম কালচার পছন্দ করেছেন ড্রিউ বিনস্কি-
১। মাটিতে বসে খাবার খাওয়ার ব্যাপারটি তিনি পছন্দ করেন। বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশে এই সংস্কৃতি আছে। ইনফ্যাক্ট বাংলাদেশেও গ্রামাঞ্চলে গেলে আমরা দেখতে পাই, আত্মীয় স্বজন সবাই শীতল পাটি বিছিয়ে মাটিতে বসেই খাবার খাচ্ছে। এর পাশাপাশি মুসলিমরা বেশিরভাগ সময়ই হাত দিয়েই খাবার খায়। ট্রেডিশনাল মুসলিম খাবারগুলো একটা বিশাল থালায় দেয়া হয় এবং সবাই সেই এক থালা থেকেই খাবার খায়। এই ব্যাপারটিও নাকি ভাল লেগেছে বিনস্কির। তার মতে হাত দিয়ে খাবার খাওয়াটা নাকি খাবারের সাথে একটা আত্মিক যোগাযোগ তৈরিতে সাহায্য করে।
২। মুসলিমদের চা খাওয়ার ঐতিহ্যকেও তিনি উল্লেখ করেছেন তার প্রিয় কালচার হিসেবে। প্রত্যেকটা মুসলিম দেশে চা খাওয়ার একটা আলাদা স্টাইল আছে। আলাদা হলেও চায়ের প্রত যে একটা আবেগ সেটা প্রায় সবারই একরকম। গরম গরম চা খাওয়ার জন্য যে আয়োজন সেই ব্যাপারটাই বিনস্কিকে মুগ্ধ করে।
৩। বিনস্কি তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছেন, মুসলিমরা ভীষণ পরিবারকেন্দ্রিক হয়। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে যেখানে পারিবারিক বন্ধনগুলো ঠুনকো সেখানে মুসলমানদের মধ্যে পরিবারপ্রীতি তুলনামূলক বেশি। বিশেষ করে মুসলমানরা যে তাদের বাবা, মা এমনি দাদা দাদীর সাথেও মধুর সম্পর্ক রক্ষা করে, তাদের দেখাশুনা করে এই কালচারটাই বিনস্কিকে প্রভাবিত করেছে অনেক। তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছেন এটা দেখে যে, কোনো মুসলমানের সাথে পরিচয় হওয়ার পর মুসলমানরা "ভাই" বলে ডাকে। এ যেন একেবারে আত্মীয়তার মতো একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
৪। মসজিদের বৈচিত্র্যময়তা এবং সৌন্দর্য একজন ইহুদী বিনস্কিকে মুগ্ধ করেছে ভীষণ। তিনি বিভিন্ন দেশের মসজিদের স্থাপত্যশৈলী দেখেছেন। মুসলমানরা তাদের প্রার্থনা ঘরকে এতো সুন্দর করে বানায় যে, বিনস্কি প্রত্যেকটা দেশে গেলেই মসজিদকে আলাদাভাবে লক্ষ্য করেন। বিভিন্ন শেপের স্থাপত্য, বিভিন্ন রঙয়ের মসজিদ এবং মসজিদের পরিষ্কার পরিছন্ন প্রাঙ্গণ, মসজিদের ভেতরকার টাইলস, মোজাইক, মেঝের দৃষ্টিনন্দন শৈলী ইত্যাদি দেখে তার ভাল লেগেছে। মসজিদের ভেতরকার নিরবতা মনের মধ্যে অদ্ভুত একধরণের শান্ত ভাব নিয়ে আসে যা বিনস্কিকে বেশ প্রশান্তি দিয়েছে।
৫। এই পয়েন্টটা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে বহিঃবিশ্বে মুসলিমদের একটা ট্যাগ আছে, এরা জঙ্গী, সন্ত্রাসী, মুসলিম দেখলেই একটা অবজ্ঞার ভাব দেখানোর প্রয়াস আছে সেখানে একজন ইহুদী বিনস্কি বলেছেন, মুসলিমদের আতিথেয়তার দিক থেকে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে। তিনি হিসাব করে শেষ করতে পারেননি, কতবার তিনি মুসলমানদের বাড়িতে চা, কফি খেতে যাওয়ার দাওয়াত পেয়েছেন। কেউ কেউ তাকে বাড়িতে থাকারও নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। মুসলমানরা কাউকে আপ্যায়ন করা শুরু করলে খাবার খাওয়ার জন্য জোর করতেই থাকে, অবশ্যই ভালবাসা থেকে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মুসলমানদের এই আপ্যায়ন ভীষণ রকম উপভোগ করেছেন!
ড্রিউ বিনস্কি জানিয়েছেন, এখনো এগারোটি মুসলিম দেশে ঘোরা তার বাকি আছে। ইতিমধ্যে মুসলিমপ্রধান দেশগুলো ঘুরে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে আর তর সইছে না তার। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর চারভাগের একভাগ জনসংখ্যা মুসলমান। এতোগুলো দেশ ঘুরে তার উপলব্ধি, যারা বলে মুসলমানরা সন্ত্রাস, ভায়োলেন্স এসবে জড়িত তাদের কথা একদমই প্রোপাগান্ডা ছাড়া কিছু নয়। যদি তেমনটাই হতো মানে মুসলিমরা রক্তপাতে বিশ্বাসী হতো, তাহলে পৃথিবীতে কোনো মানুষই থাকত না। সন্ত্রাসীরা সত্যিকারের কোন ধর্মের অনুসারী হতে পারে না। ধর্মকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে কেউ যদি ক্ষতি করতে চায় পৃথিবীর, তাতে ধর্মের দায় থাকবে কেন?
ছোটবেলায় যারা তাকে বোঝাতো, মুসলিমরা খারাপ লোক, যারা মুসলিম সম্পর্কে ভয়ংকর পারসেপশন দিয়ে তাকে ব্রেইনওয়াশ করেছে, তাদের কথা এখন আর বিশ্বাস করেন না তিনি। বরং, নিজের চোখ দিয়ে মুসলিম কালচার দেখার পর তার মনে হয়েছে, মুসলমানরা সত্যিই অনেক উদার, অতিথিপরায়ণ এবং ভীষণ শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাই, শীঘ্রই তিনি বাকি মুসলিম দেশগুলো ভ্রমণ করা শেষ করতে চান! তখন নিশ্চয়ই মুসলমানদের কালচার সম্পর্কে তিনি আরো কিছু পয়েন্ট যোগ করতে পারবেন!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন