সারা দুনিয়াকে বলি, আমাদের সাফল্য আর কতকাল তোমরা অপরকে দিয়ে দেবে? তার আগে চলুন আমরা আমাদের প্রতিভার মর্যাদা দেই। মরে গেলে ভালো ভালো কথা বলার বদলে বেঁচে থাকতেই চলুন আমরা সবাই বলি, স্যালুট ডাক্তার সায়েবা আক্তার!
আমার খুব অপরাধবোধ হচ্ছে। কেনিয়ার সব গণমাধ্যম তাদের ধাত্রী অ্যানি মুনজেলাকে নিয়ে নিউজ করতে পারলে। বিবিসি তাকে নিয়ে নিউজ করতে বাধ্য হলো। সারা দুনিয়া তাকে চিনলো। আর আমরা আমাদের গণমাধ্যম অধ্যাপক সায়েবা আক্তারকে নিয়ে কোন নিউজ করতে পারলো না। আন্তর্জাতিকভাবে তো দূরের কথা আমাদের নিজ দেশের লোকজনই তাকে চেনে না।
১৫ বছর সাংবাদিকতা করেছি। যদিও স্বাস্থ্য বিট করিনি কিন্তু আমারও নিশ্চয়ই দায় আছে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য বিটের সাংবাদিকরা কী করলেন? কেন আমরা পারলাম না অধ্যাপক সায়েবা আক্তারের কথা আমাদের গণমাধ্যমে তুলে ধরতে? কেন আমরা সবাই তাঁর কথা জানি না? আমাদের ডাক্তাররা যারা নানা বিষয়ে ফেসবুকে সরব তারা কী করলেন? তারা কেন তাদের একজন সহকর্মীর খবর দেশবাসীকে জানাতে পারলেন না? কেন বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাতে তাকে কোন পদক দিলো না? সারাক্ষন পরশ্রীকাতরতায় মেতে থাকা আমরা কেন পারি না আমাদের প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ণ দিতে?
যারা এখনো অধ্যাপক সায়েবা অাখতারকে চেনেন না তাদের জন্য বলি ৩০-৪০ বছর আগেও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল প্রসব পরবর্তী রক্তপাত। ডা: নাজিরুম মুবিন লিখেছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় পোস্ট পারটাম হেমোরেজ বা পিপিএইচ। পিপিএইচের চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল বেশ ব্যয়বহুল। বাংলাদেশসহ অন্যান্য অনুন্নত দেশের জনগণের জন্য যা বহন করা সম্ভব ছিল না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যেত মায়েরা সন্তান জন্মদানের সময় মারা যেত। মৃত মায়ের সন্তানরাও বেশিদিন বাঁচত না। কখনো কখনো মাকে বাঁচাতে গিয়ে জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হতো। সেক্ষেত্রে ওই মহিলা চিরদিনের জন্য মা হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো।
ভয়াবহ এই চিত্রটি ২০০০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েবা আকতার ম্যাডামকে খুব ভাবিয়েছিল। ম্যাডাম পিপিএইচের জন্য স্বল্প খরচে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি খুঁজছিলেন। রক্তপাত বন্ধের প্রধান উপায় হলো প্রেশার বা চাপ দেয়া। কোন ভাবে জরায়ুর ভেতরে কোন কিছু দিয়ে চাপ দিলে হয়তোবা রক্তপাত বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু চাইলেই তো যেকোন বস্তু মানবদেহের ভেতরে প্রবেশ করানো যায় না। স্টেরিলিটির ব্যাপার আছে। মেডিকেল ইথিক্সের ব্যাপার আছে।
হঠাৎ ম্যাডামের মনে হলো বাচ্চারা তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর ফ্রি কনডম দিয়ে বেলুন বানিয়ে খেলে। কনডম একটা এফডিএ অনুমোদিত মেডিকেল ডিভাইস। ম্যাডাম কনডমের ভিতরে পানি ঢুকিয়ে এর স্থিতিস্থাপকতা পরীক্ষা করলেন। এটা জরায়ুর ভেতরে প্রবেশ করিয়ে যদি পানি দেয়া যায় তাহলে একসময় সেটা জরায়ুর দেয়ালে চাপ দিবে ফলে রক্তপাত বন্ধ হবে। ম্যাডাম পরের দিন সকালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে দেখেন একজন মহিলাকে টোটাল হিস্টেরেকটমির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। অর্থাৎ তার জরায়ু কেটে ফেলে দেয়া হবে। কারণ তার প্রসব পরবর্তী রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না।
ম্যাডাম তখন প্রথমবারের মতো কনডম টেম্পোনেড ব্যবহার করলেন। আশ্চর্যজনকভাবে ১৫ মিনিটের মধ্যেই রক্তপাত বন্ধ হয়েছিল। রোগিটি তার জরায়ুসহ সুস্থভাবে বাড়ি ফিরেছিল। ২০০১-২০০২ সাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। অধ্যাপক ডা. সায়েবা আকতারের নেতৃত্বে ২৩ জন রোগিকে এই চিকিৎসা দেয়া হয় এবং তাদের প্রত্যেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেন।
২০০৩ সালে ম্যাডামের এই আবিষ্কার ও গবেষণা কর্মটি মেডস্কেপ মেডিকেল জার্নালে “Use of condom in the control of massive postpartum hemorrhage. Medscape General Medicine 2003; 5(3): 38." শিরোনামে প্রথম পাবলিশ হয়। পরবর্তীতে এটি অরিজিনাল রিসার্চ পেপার হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব গাইনি অ্যান্ড অবসেও পাবলিশ হয়। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে রিভিউ আর্টিকেল হিসেবে পাবলিশ হয়। বিশ্বজুড়ে এটি সায়েবা'স মেথড হিসেবে পরিচিতি পায়।
আন্তর্জাতিক জার্নালে পাবলিশ হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে ম্যাডামকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় সায়েবা'স মেথড সম্পর্কে তাদের দেশের ডাক্তারদের প্রশিক্ষিত করার জন্য। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ম্যাডামের এই মেথড নিয়ে এফসিপিএস ডিজার্টেশন, এমএস থিসিস, পিএইচডি থিসিস হয়েছে। ম্যাডামকে রয়্যাল কলেজ অব অবস অ্যান্ড গাইনোকলজিস্ট থেকে অনারারি ফেলোশিপও দেয়া হয়েছে।
অথচ ২০১৭ সালের ২ আগস্ট বিবিসি একটি ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে। সেখানে দেখানো হয় অ্যানি মুঞ্জেলা নামে কেনিয়ার একজন মিডওয়াইফ কনডম দিয়ে প্রসব পরবর্তী রক্তপাত বন্ধ করছেন। তিনি তার ক্লিনিকে এই পদ্ধতিতে ৬ জন মায়ের জীবন বাঁচিয়েছেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে অনুন্নত দেশগুলোর আরো অনেক মায়ের জীবন বাঁচবে বলে আশা করা হয়। বাংলাদেশের কয়েকটি পত্রিকা সেটি বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করে দেশবাসীকে জানিয়েছে। অথচ শুধু ছয় জন না গত ১৭ বছরে বাংলাদেশের একজন ডাক্তারের পদ্ধতি যে লক্ষাধিক মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে সেটা আমরা জানাতে পারলাম না।
দিনভর এ নিয়ে আত্মসমালোচনার পর সন্ধ্যায় প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির দার সাথে কথা বললাম যিনি স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিবদেন করেন। শিশিরদা জানালেন, তিনি ইতিমধ্যে সায়েবা আক্তারের সাথে কথা বলেছেন। ম্যাডাম বিদেশে যাচ্ছেন। ফিরে এলেই তাকে নিয়ে নিউজ করবেন। এরপর কথা বললাম ঢাকয় বিবিসির এক সাংবাদিক বড় ভাইয়ের সাথে। তিনি আমাকে বললেন, একটা দেশের গণমাধ্যম যে বিষয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় সেখানকার বিবিসি ওই নিউজটা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক রুপ দেয়।
কেনিয়া যদি তাদের একজন ধাত্রীর খবর তাদের সব গণমাধ্যমে প্রকাশ করে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কেন সায়েবা আক্তারকে নিয়ে ধারাবাহিক নিউজ করলো না? অামি কোন জবাব দিতে পারিনি। অামার শুধু মনে হচ্ছে অামাদের সবার উচিত সায়েবা অাক্তারের কাছে ক্ষমা চাওয়া। ম্যাডাম আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন। অার সব গণমাধ্যমের কাছে অনুরোধ চলুন অামরা সায়েবা অাক্তারকে নিয়ে প্রতিবেদন করি। সারা দুনিয়াকে বলি, অামাদের সাফল্য অার কত কাল তোমরা অপরকে দিয়ে দেবে? তার আগে চলুন আমরা আমাদের প্রতিভার মর্যাদা দেই। মরে গেলে ভালো ভালো কথা বলার বদলে বেঁচে থাকতেই চলুন আমরা সবাই বলি, স্যালুট ডাক্তার সায়েবা আক্তার।
বিঃ দ্রঃ- লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ৭ই আগস্ট ২০১৭ সালে, ডা. সায়েবাকে নিয়ে আমাদের মিডিয়া খানিকটা মনযোগ দেখিয়েছে এরপরে, তাকে নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে, দেরীতে হলেও সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন তিনি।