করোনার এই দুঃসময়ে অনেকে যখন চিকিৎসা সেবা দেয়া বন্ধ করে নিরাপদে থেকেছেন, ডা. রকিব তখন তার ক্লিনিক খোলা রেখেছিলেন, যাতে মানুষ চিকিৎসাটা পায়। সেটার প্রতিদান তাকে জীবন দিয়ে দিতে হলো!

খুলনায় গতকাল এক ডাক্তারকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে রোগীর স্বজনেরা। গর্ভবতী সেই রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন, এমন অভিযোগ তুলে রকিব খান নামের সেই চিকিৎসককে মারধর করেছিল রোগীর স্বজনরা। তাদের মধ্যে কেউ একজন ডা. রকিবের মাথায় ভোঁতা কোন অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছেন, মস্তিস্কের রক্তক্ষরণের কারণে আহত হবার বাইশ ঘন্টা পরে মৃত্যু হয়েছে ভদ্রলোকের। করোনার এই দুঃসময়ে অনেকে যখন চিকিৎসা সেবা দেয়া বন্ধ করে নিরাপদে থেকেছেন, ডা. রকিব তখন তার ক্লিনিক খোলা রেখেছিলেন, যাতে মানুষ চিকিৎসাটা পায়। সেটার প্রতিদান তাকে জীবন দিয়ে দিতে হলো। 

ডা. রকিবের ভাই সাইফুল ইসলাম খান জানাচ্ছেন, 'গত রোববার সকালে গল্লামারীর মুহাম্মদ নগর এলাকার সন্তানসম্ভবা এক নারীকে ওই ক্লিনিকে ভর্তি করেন স্বজনরা। ওই নারীর কিছু জটিলতা থাকায় ওইদিন বিকেলে সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা প্রসব করানো হয়। প্রথম দিকে বাচ্চা ও মা দুইজনই ভালো ছিলেন। কিন্তু রাতে মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। সকালে ওই রোগীকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির জন্য সুপারিশ করা হয়।'

‘সকালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন সেখানকার চিকিৎসকরা। দুপুরের দিকে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে ওই নারী মারা যান। এরপর রাত ৯টার দিকে ওই নারীর স্বজনরা মরদেহ নিয়ে ক্লিনিকের সামনে এসে ডা. রকীব খানকে মারধর করেন। এসময় ভারী কিছু দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়।’

‘মারধরের পর কয়েকবার বমি করেন ডা. রকীব খান। অবস্থা গুরুতর হতে থাকলে রাত ২টার দিকে তাকে গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সকালের দিকে সিটিস্ক্যান করে দেখা যায় তার মাথায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। সেখান থেকে দুপুরের দিকে তাকে শেখ আবু নাসের হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যার দিকে তিনি মারা যান’, 

ডা. রকিব খান

আমাদের একটা বদঅভ্যাস আছে। দুর্বলের ওপর ক্ষমতা দেখানোটা আমাদের ভীষণ পছন্দের কাজ। চিকিৎসা বিদ্যার 'চ'টাও না বুঝে রোগীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডাক্তারের অবহেলা, ভুল চিকিৎসা- এসব কারণ দাঁড় করিয়ে ফেলি আমরা। তারপর আইন তুলে নেই নিজেদের হাতে, শাস্তি দেয়ার কাজটা করে ফেলি তৎক্ষণাৎ। কারণ ডাক্তারকে মারলে প্রতিবাদ করার কেউ নেই। খোদ ডাক্তারেরাই তো করেন না অনেক সময়। মার খেতে খেতে অর‍্যাচারিত হওয়াটাকেই নিয়তি ধরে নিয়েছেন তাদের অনেকে। সিনিয়র স্যারদের ওপর হামলা হতে দেখেছেন তারা, নিজেদের গায়ে আঘাত এলেও সেটা নিয়ে খুব একটা সাড়াশব্দ করেন না তারা, ফেসবুকে হয়তো একটা আবেগী পোস্ট দেন, দুঃখটা শেয়ার করেন- এটুকুই। 

প্রতি বছর শয়ে শয়ে ঘটনা ঘটে চিকিৎসকদের ওপর হামলার, কয়টার বিচার হতে শুনেছেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সব ধামাচাপা দেয়া হয়, অল্প কিছু আপোষে মিটমাট করে দেয়া হয়। অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না। ডা. রকিবের ঘটনাটাতে থানায় অভিযোগও নেয়া হয়নি, চিন্তা করতে পারেন অবস্থাটা? একজন চিকিৎসককে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, অথচ মামলা নেয়া হচ্ছে না! চিকিৎসক সমাজ কতটা অবহেলার শিকার, সেটা তো এই ঘটনাতেই পরিস্কার।

 করোনাভাইরাসের এই সময়টায় ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র হয়ে লড়ছেন চিকিৎসকরা। সব ছুটি বাতিল করা হয়েছে তাদের, রোজা নেই, ঈদ নেই, পরিবারের কাছ থেকে দূরে থেকে মানুষকে একটানা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন। পুরো দেশ যখন ঘরবন্দী, কিছু অমানুষ ঘুরে বেড়িয়ে ভাইরাস ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তখন অক্লান্তভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে শুধু ডাক্তারেরাই। অথচ আমরা তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করে বরং ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে ডাক্তারকে পিটিয়ে মেরে ফেলছি! 

রোগী সুস্থ হলে ক্রেডিট স্রষ্টার, অথচ রোগী মারা গেলে দোষ ডাক্তারের!

খুলনার চিকিৎসকরা আন্দোলনে নেমেছেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, করোনা সেবা এবং হাসপাতালের জরুরী সেবা ছাড়া সব ধরণের চিকিৎসা সেবা দেয়া বন্ধ রাখবেন তারা। যে দেশে রোগীর স্বজনের হাতে ডাক্তার নিহত হয়, লাঞ্ছিত হয়, সেদেশের মানুষের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অধিকার নেই। করোনাকালে ডাক্তারের শ্রমে, সেবায় রোগী সুস্থ হয়ে উঠলে সবাই বলে হায়াৎ মউত স্রষ্টার হাতে, তিনিই বাঁচিয়েছেন। অথচ রোগী মারা গেলে কেউ স্রষ্টার দিকে না তাকিয়ে ডাক্তারকে পেটায়! এসব অমানুষদের চিকিৎসার দরকার নেই, তারা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করুক বরং। তাহলে আর কোন ডা. রকিবকে মরতে হবে না। 

ডা. রকিবের দুই সন্তান, এক মেয়ে, এক ছেলে। মেয়েটা এবছর এসএসসি পাশ করেছে। তার নিশ্চয়ই স্বপ্ন ছিল, মেডিকেলে পড়বে, বাবার মতো ডাক্তার হবে, বাবার চেয়েও বিখ্যাত কেউ হবে। মেয়েটা শুধু বাবাকে হারায়নি, তার স্বপ্নগুলোও ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই ভাববে, ডাক্তার না হয়ে অন্য কোন পেশায় থাকলে তার বাবাকে এভাবে মরতে হতো না আজ। আমরা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্দশা নিয়ে এত কথা বলি, বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা ডাক্তারদের কাছ থেকে চিকিৎসা সেবাটাই ডিজার্ভ করি না। যে দেশ ডাক্তারকে সম্মান আর নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেই দেশে ডাক্তারী নামের পেশাটারও থাকার কোন দরকার নেই। ডাক্তাররা যেহেতু ইচ্ছে করে রোগী মেরেই ফেলছেন, এখানে বরং তাবিজ আর হেকিমি চিকিৎসাই চলুক...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা