ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে কম কথা হয় না, কসাই টার্মের ব্যবহারও এখান থেকেই। কিন্তু কেন এই প্রাইভেট প্র্যাকটিস? সব ডাক্তারই কি কসাই?

ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে আমজনতার ব্যাপক বিবমিষা আছে। হেন্স দ্য টার্ম কসাই। তারা রোগী জবাই করে, অনেক টাকা নেয়। তারা পছন্দের প্যাথলজি সেন্টারের সঙ্গে চল্লিশ পার্সেন্ট কমিশনে নানাধরনের টেস্ট দেয়, যা রোগী অপ্রয়োজনীয় মনে করে। অভিযোগ সবই একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো না। কিন্তু আপনি যখন বিষয়টাকে জেনারেলাইজ করে ফেলেন, তখন একটা মহৎ পেশা অপমানিত হয়।

আপনি কখন একজন ডাক্তারের কাছে যান? চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল আছে, সেখানেও প্রেসক্রিপশন দেয়া হয়, ওষুধ দেয়। মাথা ব্যথা থেকে শুরু করে চুলকানি পর্যন্ত। আপনি হয়তো ভিড়ভাট্টা এভয়েড করতে চান, কিংবা আপনার মনে হয় প্রাইভেটেই ডাক্তাররা ভালো রোগী দেখেন। যেমন আপনার অভিজ্ঞতায় স্কুল কলেজের চাইতে শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশনীতেই ভালো পড়ান।

আপনি কিন্তু দুই তিনশো টাকা ভিজিটের নরমাল এমবিবিএস দেখান না। আপনার দরকার ভালো ডাক্তার, প্রফেসর লেভেলের। মিনিমাম দুই হাজার টাকা ভিজিটের। কিন্তু আপনি দেখেন সেখানে ব্যাপক ভিড়। কয়েকদিন পর এপোয়েন্টমেন্ট পেলেন, ঢুকে দেখলেন আপনার প্রেশার মাপছে আরেকজন, প্রফেসর সাহেব ভালো করে আপনার গল্প শুনলেনই না, খসখস করে কাগজে ওষুধ নয়তো টেস্ট লিখে দিয়ে বেল বাজিয়ে বললেন- নেক্সট। আপনার মনে হবে- ধুর! টাকাটাই নষ্ট। দোষটা আসলে কার? আপনার মানসিকতার।

আপনার স্ট্যাটাস মেনটেইন করাটাকে আপনি প্রায়োরিটি দেন। আপনি ফ্রি চিকিৎসা শিবিরে যাবেন না। ওটা গরীবদের জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটিসহ বড় বড় হাসপাতালগুলোয় বিশেষজ্ঞরাই রোগী দেখেন। সেখানে আধুনিক সব চিকিৎসা আছে। আপনি জানেন না কিংবা ইগনোর করেন। আপনি ভাই-ব্রাদারদের জিজ্ঞেস করেন- এই রোগ হয়েছে, ভালো ডাক্তার কে, তিনি আপনাকে অমুকের নাম বলেন তমুকের নাম বলেন, ভিজিট বেশি, আপনার মনে হয় টাকা ব্যাপার না।

ডাক্তারদের দিকটাও দেখেন। রোগীদের সঙ্গে তার পরিচয় মেডিকেলে থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় থেকে। যখন সে ওয়ার্ডগুলোতে রোগীর হিস্টরি নেয়, ট্রিটমেন্ট আর ম্যানেজমেন্ট দেখে। এদের অনেকেই তখন থেকে কী লক্ষণে কী রোগ এবং তার ওষুধ সম্পর্কে জানতে থাকে, সময়ে সেই জ্ঞান আরও পরিপক্ক হয়, সে অভিজ্ঞ হয়। এবং একজন প্রফেসারের পর্যায়ে যখন তার বয়স হবে, তখন ওই এক মিনিটই তার জন্য যথেষ্ট আপনার রোগ অনুমান করার।

প্যাথলজি টেস্টটা কি একদমই অপ্রয়োজনীয়? অনেক রোগের উপসর্গ একই ধরনের। কিন্তু পার্টিকুলার কিছু টেস্ট করেই জানতে হয় তার সত্যিকার স্বরূপ। যেমন আপনার করোনা নাকি ইনফ্লুয়েঞ্জা কোনটা হয়েছে বুঝবেন কীভাবে? টেস্টের মাধ্যমে। আতিকা রোমা নামে একজন তার করোনা হয়েছে, চিকিৎসা করছে না সরকার বলে অক্সিজেন মাস্কসহ লাইভ টাইভ করে বিদিক করে ফেলেছিলেন ফেসবুক। পরে টেস্টে দেখা গেল তিনি করোনা নেগেটিভ। তো টেস্ট দরকার আছে।

আপনি ফ্রি চিকিৎসা শিবিরে যাবেন না, কারণ ওটা গরীবদের জন্য!

একজন নরমাল এমবিবিএস যখন জিপি করে, সে খুব কেয়ারিং হয়। সময় যত যায়, যত ব্যস্ততা বাড়ে, ততই তারে যান্ত্রিক হয়ে যেতে হয়। ব্যাংকে টাকা তোলার লাইনে দাঁড়ালে আপনি এটা বুঝবেন। যে মহিলা ক্যাশ গুনতেছেন, দুইবার তিনবার, তিনি নিশ্চিত হচ্ছেন কোনো ভুল না করার। আপনার মনে হচ্ছে তিনি আসলে স্লো। শুধু শুধু দেরি করতেছে। রোগী হিসেবে আপনি যখন বড় ডাক্তারের সিরিয়াল নিবেন, তখন আপনারও মনে হবে আপনারটা তাড়াতাড়ি আসে না কেন! ডাক্তারেরও তাড়া থাকে, সেটা যতটা না টাকার, তারও বেশী প্রতিটা রোগী যেন চিকিৎসা পায়। না পেলে তার কাছে আর রোগী আসবে না।

ডিগ্রি বাড়াতে ডাক্তারদের ইনভেস্টমেন্ট আছে। অনেকে এজন্য কোনো হাসপাতালে অনারারি করার পাশাপাশি এফসিপিএসে পড়াশোনা করেন। ওই বয়সে পড়াশোনা কঠিন, আয়রোজগারের চাপ থাকে। তারপরও তারা দুই পর্বের এই কঠিন পরীক্ষা পাশ করার জন্য জানপ্রাণ ঢেলে দেন। বিষয়টা একাডেমিক, কিন্তু প্রয়োজন। নইলে আপনার স্ট্যাটাস থাকবে না। প্রমাণ চান? কাউকে বলেন নরমাল একজন এমবিবিএস জিপি প্র্যাকটিশনারের কথা, ভালো ডাক্তার। উনি 'ধুর' বলে উড়িয়ে দিয়ে বলবেন, অমুক প্রফেসাররে দেখাও। তার মানে জনগনই বিশ্বাস করে প্রচুর ডিগ্রি না থাকলে ভালো ডাক্তার না। তো তিনি ফিস যদি বেশি নেন, এটা তার প্রাপ্য। আপনার না পোষালে নিচে নামেন।

তার মানে কি সব ডাক্তার আসলে ভালো? সব হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা হয়? তারা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলেন না নিশুতি রাতে এসো, ভাল করে দিব? সেই দাবি আমি কখনোই করবো না। আমি বেসিক একটা চিত্র দিলাম, যাতে আপনারা বোঝেন প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ব্যাপারটা, ডাক্তারদের দিকটা। কয়েকজনের জন্য ঢালাওভাবে সবাইকে গালি না দেন, বাকিরা দেয় সেইজন্য।

ফেন্সি খেতে খেতে রোগী দেখে এমন প্রচুর ডাক্তার আমি চিনি। আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি সেইসব ডাক্তারদের, যারা একটু বেশী পয়সার জন্য নরমাল ডেলিভারির বদলে সিজারিয়ান করতে বাধ্য করে, রোগীর কোনো কমপ্লিকেশন না থাকলেও। তো ভালো, খারাপ থাকেই সব পেশাতেই। আপেক্ষিক এই বিষয়টা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর।

আমি পার্সোনালি সব ডাক্তার খারাপ, তারা কসাই- এই জনমতের বিপক্ষে। কারণ যখনই কোনো ছেলে বা মেয়ে ডাক্তারি পেশায় পা রাখে, সে একজন ভালো ডাক্তারই হতে চায়। সবাই পারে না, অনেকেই পারে... 

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা