আহমদ শফী সামান্য অসুস্থ হলেও তার জন্যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স হাজির হয়ে যায়, অথচ করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়রকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় আসতে হয় অনেক কষ্টে অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করে- এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে?
হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীকে গতকাল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। বার্ধক্যজনিত জটিলতায় অনেকদিন ধরেই ভুগছেন আহমদ শফী। চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি, গতকাল দুপুরে এমএ আজিজ স্টেডিয়াম থেকে তাকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি উড়ে এসেছে ঢাকায়, শফী সাহেবকে ভর্তি করা হয়েছে যাত্রাবাড়ির আজগর আলী হাসপাতালে। চট্টগ্রামে যে ডাক্তারের অধীনে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন, তিনি জানিয়েছেন, আহমদ শফীর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল, রিপোর্টের ফলাফলও বয়স অনুযায়ী ভালো, তিনি সুস্থ আছেন। তবুও উন্নত চিকিৎসার জন্যে তাকে ঢাকায় আনা হয়েছে।
ডা. মঈনের জন্যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ছিল না। হেলিকপ্টার ছিল না। একটা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে কয়েকজনকে বলেছিলেন তিনি, ফেসবুকে এক বন্ধুকে মেসেজও দিয়েছিলেন ডা. মঈন, লিখেছিলেন- ‘আমার জন্য কি একটা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা যায়? কুয়েত মৈত্রীতে যাব…’
না, সেই আধুনিক অ্যাম্বুলেন্সটাও পাওয়া হয়নি মঈন সাহেবের। এমনকি তাকে সিলেট থেকে ঢাকায় নেয়ার জন্যে কোন অ্যাম্বুলেন্সই পাওয়া যাচ্ছিল না। ডা. মঈন করোনায় আক্রান্ত রোগী হওয়ায় কেউই তাকে বহন করতে রাজী হচ্ছিল না। পরে পরিবারের সদস্যরা অনেক কষ্টে সাধারণ একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছেন, নিজেদের উদ্যোগেই তাকে নিয়ে গেছেন ঢাকায়, ভর্তি করেছেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। এই রাষ্ট্রে আহমদ শফীরা সামান্য অসুস্থ হলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স হাজির হয়ে যায়, অথচ করোনার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ডা. মঈনরা আক্রান্ত হলে, মৃত্যুমুখে পতিত হলেও একটা অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ হয় না!
করোনার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নিজেই আক্রান্ত হয়েছিলেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন, কোন এক রোগীর দেহ থেকে ভাইরাসটা সংক্রমিত হয়েছিল তার মধ্যেও। এই রাষ্ট্র তার অক্লান্ত এক যোদ্ধার পাশে সময়মতো দাঁড়াতে পারেনি, তাকে সর্বোচ্চ সাহায্যটা করতে পারেনি। করোনার বিরুদ্ধে অসম লড়াইটাতে হেরে তিনি আজ পাড়ি জমিয়েছেন অন্য ভূবনে, যাওয়ার আগে দেখে গেছেন, সূর্যসন্তানদের প্রতি রাষ্ট্রের অসীম অবহেলার উৎকট এক নিদর্শন।
ঢাকা মেডিকেলের মেধাবী ছাত্র ছিলেন ডা. মঈন। কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে, সেখানে মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন, গরীব রোগীদের কাছ থেকে নাকি ফি-ও নিতেন না। সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় জন্ম নেয়া মানুষটা পরিবার নিয়ে থাকতেন সিলেটের হাউজিং এস্টেট এলাকায়।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে, সিলেটেও করোনার প্রকোপ গিয়ে পৌঁছেছে। এই ক্রান্তিকালে চিকিৎসক-নার্স সহ স্বাস্থ্যকর্মীরাই লড়ছেন সামনে দাঁড়িয়ে, ডা. মঈনও তাদের একজন ছিলেন। প্রাণঘাতি ভাইরাসের ভয়ে পালিয়ে যাননি তিনি, রোগী দেখা বন্ধ করেননি। যথাযথ প্রোটেকশন নেই, পিপিই নেই, নিজের টাকায় কেনা হ্যান্ড গ্লাভস আর মাস্ক দিয়ে চালিয়ে গিয়েছেন কাজ। আর সেই কাজ করতে গিয়েই বিপদ ডেকে এনেছেন নিজের।
এপ্রিলের ৫ তারিখে করোনা টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট আসে ডা. মঈনের। অবস্থায় অবনতি ঘটলে ৭ এপ্রিল ডা. মঈনকে নগরীর শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে করোনা ইউনিটে আইসোলেশনে নেওয়া হয়। সেখান থেকে পরবর্তীতে পরিবারের সিদ্বান্ত অনুযায়ী তাকে এ্যম্বুলেন্সযোগে দ্রুত ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। করোনার সংক্রমণ ডা. মঈনের হার্টে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাকে রাখা হয়েছিল ভেন্টিলেশনে। গতকাল রাত থেকেই শারীরিক অবস্থা খুব বেশি খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। শেষমেশ লড়াইটা আর জারী রাখতে পারলেন না তিনি, চলে গেলেন চিরতরে। যে মানুষটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন, সুস্থ করে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন, তার জীবন সংশয়ের সময়টায় আমরা কেউ তার পাশে দাঁড়ালাম না, এই রাষ্ট্র তার পাশে দাঁড়ালো না!
আমরা বারবার বলে যাই, করোনার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে ডাক্তার-নার্সরা হচ্ছেন আমাদের ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র। প্রধানমন্ত্রী ডাক্তারদের জন্যে লাখ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবীমার ঘোষণা দেন, নিজের ভাষণে তাদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান। অথচ এতসবের পরেও গুরুতর অসুস্থ একজন সিনিয়র ডাক্তারকে ঢাকায় আনার জন্যে অ্যাম্বুলেন্স খুঁজে পাওয়া যায় না, একজন সূর্যসন্তানের বিপন্ন সময়ে রাষ্ট্র তার খোঁজ রাখে না, তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। কথায় আর কাজে মিল না থাকলে, জীবনটাই না বাঁচলে এত গালভরা প্রশংসা আর উপাধি নিয়ে কি করবেন ডাক্তাররা, বলুন তো?
এই দেশের জন্য আহমদ শফীর অবদান কী? নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির দাবীতে দেশজুড়ে গণ্ডগোল তৈরী করা ছাড়া তিনি কি এমন উপকারী কাজ করেছেন? আহমদ শফী আর তার হেফাজতে ইসলামের উত্থানের কারণেই মৌলবাদীরা একের পর এক ব্লগারকে কুপিয়ে হত্যার সাহস পেয়েছে, এসব আমরা ভুলে যাইনি, ভোলা সম্ভব না। ধর্মকে ব্যবহার করে, সাধারণ মানুষের আবেগকে বিক্রি করে তিনি নিজের আখের গুছিয়েছেন, রেলওয়ের জমি বাগিয়ে নিয়েছেন।
একসময় জোরেশোরে সরকার পতনের আন্দোলন করেছেন, শাপলা চত্ত্বরে লাখো মানুষ ডেকে এনেছেন, আওয়ামী লীগকে ভ্যানিশ করে দিতে চেয়েছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন দিনের পর দিন। পরে আবার সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকেই বাহবা দিয়েছেন, বিশাল সমাবেশ করে শেখ হাসিনাকে খেতাব দিয়েছেন ‘কওমি জননী’ হিসেবে। হাওয়া যেদিকে, আহমদ শফী সেদিকে- এই অবস্থান তিনি ধরে রেখেছেন গত কয়েক বছর ধরেই।
সেই আহমদ শফী সামান্য অসুস্থ হলেও তার জন্যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স হাজির হয়ে যায়, অথচ করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়রকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় আসতে হয় অনেক কষ্টে অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করে- এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে? এই দেশে ডা. মঈনদের মতো সূর্যসন্তানদের দাম যে আহমদ শফীর মতো লোকেদের নখের সমানও নয়, এই ঘটনায় সেটাই প্রমাণ হলো আরও একবার…
আরও পড়ুন-