ফেসবুকে কাকে যেন মেসেজ দিয়েছিলেন ডা. মঈন, লিখেছিলেন- ‘আমার জন্য কি একটা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা যায়? কুয়েত মৈত্রীতে ভর্তি হবো…’
করোনার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নিজেই আক্রান্ত হয়েছিলেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন, কোন এক রোগীর দেহ থেকে ভাইরাসটা সংক্রমিত হয়েছিল তার মধ্যেও। এই রাষ্ট্র তার অক্লান্ত এক যোদ্ধার পাশে সময়মতো দাঁড়াতে পারেনি, তাকে সর্বোচ্চ সাহায্যটা করতে পারেনি। আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স জোটেনি তার কপালে, তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনার কথাও কেউ ভাবেনি। ডা. মঈন ঢাকায় এসেছেন সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সে করে, ভর্তি করা হয়েছিল কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে। করোনার বিরুদ্ধে অসম লড়াইটাতে হেরে তিনি আজ পাড়ি জমিয়েছেন অন্য ভূবনে, যাওয়ার আগে দেখে গেছেন, সূর্যসন্তানদের প্রতি রাষ্ট্রের অসীম অবহেলার উৎকট এক নিদর্শন।
ঢাকা মেডিকেলের মেধাবী ছাত্র ছিলেন ডা. মঈন উদ্দিন। কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে, সেখানে মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন, গরীব রোগীদের কাছ থেকে নাকি ফি-ও নিতেন না। সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় জন্ম নেয়া মানুষটা পরিবার নিয়ে থাকতেন সিলেটের হাউজিং এস্টেট এলাকায়।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে, বিদেশ থেকে এসেছেন অনেকে, সিলেটেও করোনার প্রকোপ গিয়ে পৌঁছেছে। এই ক্রান্তিকালে চিকিৎসক-নার্স সহ স্বাস্থ্যকর্মীরাই লড়ছেন সামনে দাঁড়িয়ে, ডা. মঈনও তাদের একজন ছিলেন। প্রাণঘাতি ভাইরাসের ভয়ে পালিয়ে যাননি তিনি, রোগী দেখা বন্ধ করেননি। যথাযথ প্রোটেকশন নেই, পিপিই নেই, নিজের টাকায় কেনা হ্যান্ড গ্লাভস আর মাস্ক দিয়ে চালিয়ে গিয়েছেন কাজ। আর সেই কাজ করতে গিয়েই বিপদ ডেকে এনেছেন নিজের।
এপ্রিলের ৫ তারিখে করোনা টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট আসে ডা. মঈনের। তখন থেকেই তার পরিবারসহ সিলেট নগরীর হাউজিং এস্টেট এলাকা লকডাউন ঘোষণা করা হয়। অবস্থায় অবনতি ঘটলে ৭ এপ্রিল ডা. মঈনকে নগরীর শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে করোনা ইউনিটে আইসোলেশনে নেওয়া হয়। সেখান থেকে পরবর্তীতে পরিবারের সিদ্বান্ত অনুযায়ী তাকে এ্যম্বুলেন্সযোগে দ্রুত ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। করোনার সংক্রমণ ডা. মঈনের হার্টে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাকে রাখা হয়েছিল ভেন্টিলেশনে। গতকাল রাত থেকেই শারীরিক অবস্থা খুব বেশি খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। শেষমেশ লড়াইটা আর জারী রাখতে পারলেন না তিনি, চলে গেলেন চিরতরে।
এর আগে ঢাকায় স্থানান্তরের জন্য একটা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলেন ডা. মঈন। পরিচিত কয়েকজনকে বলেওছিলেন, ফেসবুকেও কাউকে মেসেজ করেছিলেন। শারীরিক অবস্থা খুব বেশি খারাপ হওয়াতেই আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলেন, আয়েশ করার জন্য নয়। অথচ সেটা তার ভাগ্যে জোটেনি। পরে অনেক কষ্টের পরে সাধারণ একটা অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করে তাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন পরিবারের সদস্যরা, করোনা রোগী হওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সও তাকে বহন করতে রাজী হচ্ছিল না! যে মানুষটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন, সুস্থ করে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন, তার জীবন সংশয়ের সময়টায় আমরা কেউ তার পাশে দাঁড়ালাম না, এই রাষ্ট্র তার পাশে দাঁড়ালো না!
আমরা বারবার বলে যাই, করোনার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে ডাক্তার-নার্সরা হচ্ছেন আমাদের ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র। প্রধানমন্ত্রী ডাক্তারদের জন্যে লাখ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবীমার ঘোষণা দেন, নিজের ভাষণে তাদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান। অথচ এতসবের পরেও গুরুতর অসুস্থ একজন সিনিয়র ডাক্তারকে ঢাকায় আনার জন্যে অ্যাম্বুলেন্স খুঁজে পাওয়া যায় না, একজন সূর্যসন্তানের বিপন্ন সময়ে রাষ্ট্র তার খোঁজ রাখে না, তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। কথায় আর কাজে মিল না থাকলে, জীবনটাই না বাঁচলে এত গালভরা প্রশংসা আর উপাধি নিয়ে কি করবেন ডাক্তাররা, বলুন তো?
লাখ লাখ টাকার বীমার চেয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স কখনও কখনও অনেক বেশি জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। বাসা-বাড়ি-পরিবার ছেড়ে যে মানুষগুলো দিন-রাত হাসপাতালে পড়ে আছেন, তাদের জন্যে তিন বেলার খাবারটা বাহারী প্রশংসার চেয়ে অনেক বেশি দরকারী। পিপিই, গ্লাভস, মাস্ক- এগুলো তাদের অস্ত্র, ‘ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র’ খেতাব দেয়া এই যোদ্ধাদের সবার কাছে আছে তো সেটা? ডা. মঈন মারা গেছেন, সেই মৃত্যুতে নিজেদের অবহেলার দায় রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারবে না। প্রশ্ন একটাই- এই উদাসীন আচরণ কি অব্যহত থাকবে? এই মিছিলে আরও শত শত নাম কি যোগ হবে? সেটা রাষ্ট্রই ভালো বলতে পারবে। তবে ডা. মঈনের কাছে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমরা ক্ষমা চাইব না, কারণ ক্ষমা চাওয়ার জন্যেও একটা যোগ্যতা লাগে- সেটা আমাদের নেই। আমাদের ক্ষমা করবেন না ডা. মঈন, ক্ষমা পাওয়ার অধিকার আমাদের নেই...
আরও পড়ুন-