ডা. কফিল খান: দেশদ্রোহী, অথবা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার এক সাধারণ নাগরিক
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মরণাপন্ন শিশুদের জীবন বাঁচিয়ে তিনি জেল খাটলেন, সরকার উঠেপড়ে লাগলো তাকে দমন করতে। ভারতে রাষ্ট্রবাদের নামে সংখ্যালঘু ও বিরুদ্ধ মতের লোকজনের ওপর যে পাশবিকতা চলছে, সেটারই এক জ্বলন্ত নজির ডা. কফিল খান...
তিনি একজন চিকিৎসক, হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটে যখন শিশুরা মারা যাচ্ছে, তখন তিনি নিজের গাড়ি নিয়ে ছুটে গিয়েছেন বাইরে থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার আনতে, তার আনা অক্সিজেন প্রাণও বাঁচিয়েছে অনেক রোগীর। পুরস্কৃত হবার পরিবর্তে তিনি পরিণত হলেন সরকারের টার্গেটে, বলির পাঁঠা বানিয়ে তার চাকরিটা কেড়ে নেয়া হলো, মিথ্যা মামলায় তাকে পাঠানো হলো জেলে, একের পর এক অভিযোগ উঠলো, প্রপাগাণ্ডা চালানো হলো তার বিরুদ্ধে, পরে সেগুলো ভুয়া বলেও প্রমাণীত হলো। এতকিছুর পরেও সরকারের ক্ষোভ মেটেনি, তার ওপর আজীবন নজরদারী চালানো হবে বলে জানিয়েছে সরকার, তাকে বাঁচতে হবে দাগী আসামীদের মতো পুলিশের নজরবন্দী হয়ে।
তিনি একজন সচেতন নাগরিক। গোটা ভারত যখন নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে উত্তাল, তখন তিনি নিজের অবস্থান পরিস্কার করেছিলেন, এই আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, কথা বলেছেন; একটা গণতান্ত্রিক দেশে যেটা প্রত্যেক নাগরিকের ন্যায্য অধিকার। কিন্ত জনসংখ্যার অংকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির সরকারের সেটা সহ্য হয়নি, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি আখ্যা দিয়ে লোকটাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে, দেশদ্রোহীতার মামলা করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। সাত মাস বন্দী থাকার পরে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আনা চার্জের কোন যৌক্তিকতা নেই।
ডা. কফিল খান নামের এই মানুষটা এত অত্যাচারেও ভেঙে পড়েননি, বরং আরও শক্ত হয়েছেন, মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছেন, কথা বলছেন দৃঢ় গলায়। ভারতে রাষ্ট্রবাদের নামে সংখ্যালঘু ও বিরুদ্ধ মতের লোকজনের ওপর যে পাশবিকতা চলছে, সেটারই এক জ্বলন্ত নজির হয়ে টিকে আছেন ডা. কফিল খান।
কফিলের গল্পটা জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ২০১৭ সালে। উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর শহরের বাবা রাঘব দাস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন কফিল। জুলাই মাসে সেখানে বড়সড় একটা দুর্ঘটনা ঘটলো, অক্সিজেনের অভাবে হাসপাতালে মারা গেল ভর্তি থাকা তেইশটি শিশু। সেদিন নিজের তাগিদে বাচ্চাগুলোর প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন ডাক্তার কফিল, এক বন্ধুর ক্লিনিক থেকে নিজের গাড়িতে করে বারোটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এসেছিলেন তিনি, এর বাইরেও আড়াইশো সিলিন্ডার জোগাড় করেছিলেন একদিনের মধ্যে, সেগুলো না পেলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারতো।
পরে জানা গেল, উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকার প্রায় তিন বছর ধরে অক্সিজেনের বিল পরিশোধ না করায় অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি তাদের সঞ্চালন লাইন বন্ধ করে দিয়েছিল, সেকারণেই মারা গেছে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি থাকা ২৩টি বাচ্চা। হাসপাতালটি ছিল সরকারী, বিল দেয়ার দায়িত্ব ছিল উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকারের। মিডিয়াতে এসব চাউর হতেই ক্ষেপে উঠলেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, ডা. কফিলকে ফোনে তিনি বললেন, 'তুমি কি ভেবেছো, কয়েকটা অক্সিজেন সিলিন্ডার এনে আর মিডিয়ার সামনে কথা বলেই হিরো হয়ে যাবে? আমি এটার শেষ দেখে ছাড়ব!'
হ্যাঁ, আদিত্যনাথের সরকার এরপর আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছিল ডা. কফিলের পেছনে। তদন্তের নামে তাকে বলির পাঁঠা বানানো হলো, দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তার চাকরি কেড়ে নিলো রাজ্য সরকার, বলা হলো, সেদিন নাকি কফিল হাসপাতালে ছিলেনই না, বরং প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ব্যস্ত ছিলেন, তার অবহেলার কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে! নিজেদের দায় এড়াতে উত্তরপ্রদেশ সরকার কফিল সহ আটজন চিকিৎসককে বরখাস্ত করলো, তারপর আটক করা হলো কফিলকে, বিনা।অপরাধে সাত মাস জেল খাটলেন এই চিকিৎসক।
কফিলের ব্যাপারটাকে অনেকটা ব্যক্তিগত শত্রুতা হিসেবেই নিয়েছিলেন যোগি আদিত্যনাথ। শিশু মৃত্যুর ঘটনার পরে কফিল মিডিয়ার সামনে যেভাবে হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরেছিলেন, সেটা তার সরকারের জামা-কাপড় খুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আর তাই কফিলকে 'উপযুক্ত শাস্তি' দিতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন তিনি। কফিল জেলে গেলেন, এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজেপির আইটি সেল তার বিরুদ্ধে শুরু করলো অপপ্রচার- কফিলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নাকি কোটি কোটি টাকা ট্রানজেকশন হয়, কফিল নাকি অসুস্থ এক রোগিনীর শ্লীলতাহানি করেছেন- এমন মুখরোচক গুজব ছড়ানো শুরু হলো। অথচ কফিল জেলে থাকার সময় তার পরিবার নিদারুণ আর্থিক কষ্টে দিন কাটিয়েছে।
এলাহাবাদ হাইকোর্ট এর মাঝে জানালো, তিন মাসের মধ্যে যাতে ঘটনার তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট জমা দেয়া হয়। সেই রিপোর্টে উঠে এলো, আসলেই অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে মৃত্যুগুলো ঘটেছে, কফিলের কোন অপরাধই ছিল না সেদিন, বরং তিনি অনেকগুলো নিষ্পাপ জীবন বাঁচিয়েছেন! হাইকোর্ট রায় দিলেন, ঘটনার সঙ্গে কফিলের কোন সংযোগ নেই, তাকে বেকসুর খালাসও দেয়া হলো। যদি ভেবে থাকেন গল্পে হ্যাপি এন্ডিং ঘটে গেছে, তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। কফিলের গল্পটা তো কেবল শুরু হলো মাত্র।
চাকরি তো হারিয়েছেন, সাতটা মাস কেটেছে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, নায়কের কাজ করলেও রাজ্য সরকার তাকে খলনায়ক বানানোর সব চেষ্টাই করেছে। জেল থেকে বেরিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করলেন কফিল, কিন্ত তার ওপর আদিত্যনাথের আক্রোশ কমেনি তখনও। তার চেম্বারে হুমকি আসা শুরু হলো, তার ভাইয়ের ওপর হামলা হলো। এসবের মধ্যে ২০১৯ এর ডিসেম্বর এলো, এনআরসি আর সিএএ নিয়ে তখন গোটা ভারত উত্তাল। কফিলকে তখন ডাকা হলো আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে, বক্তৃতা দেয়ার জন্য।
সেখানে গিয়ে ডা. কফিল কথা বললেন এনআরাসি এবং সিএএ- এর বিরুদ্ধে। বললেন, এই আইন জারী হলে ভারতে মুসলমানদের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে, তাদের সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন বানিয়ে রাখা হবে। নরেন্দ্র মোদির সরকার যে দেশকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প দিয়ে বিভক্ত করতে চাইছে, সেটাও বললেন তিনি, বললেন, "মোটা ভাই (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ) ভোটের রাজনীতির জন্য আমাদেরকে হিন্দু-মুসলমান বানাতে চায়, কিন্ত সবাইকে মানুষ বানানোর কোন ইচ্ছা তাদের নেই। ভারতের পঁচিশ কোটি মুসলমানের একজনও এই কালো আইন মেনে নেবে না, এনআরসি ও সিএএ'র বিরোধিতা আমরা করব।"
এই বক্তব্য দেয়ার তিনদিন পরেই মুম্বাই থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো আবার, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়ানোর অভিযোগে! কফিলের আইনজীবী সেদিনই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করে তার মক্কেলের জামিন চাইলেন, ম্যাজিস্ট্রেট কফিলকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশও দিলেন। কিন্ত উত্তরপ্রদেশ পুলিশ তাকে ছাড়লো না, বরং এর তিনদিন পরে কফিলের ওপর দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে চাপিয়ে দেয়া হলো ন্যাশনাল সিকিউরিট অ্যাক্টের বোঝা। ভারতের আইন অনুযায়ী, সরকার যদি কাউকে রাষ্ট্রের জন্য হুমকি বলে মনে করে, তাহলে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের চার্জ আনতে পারে। এই আইনে এক বছর পর্যন্ত যে কাউকে সরকার গ্রেপ্তার করে রাখতে পারে, এমনকি তাকে ন্যুন্যতম আইনী সুবিধাও দেয়া হয় না।
কফিলকেও এই আইনে জোর করে আটকে রাখা হলো মথুরা কারাগারে। মার্চে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়লো, ডা. কফিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে একটা চিঠি লিখলেন, অনুরোধ করলেন, তাকে যাতে মুক্তি দেয়া হয়, তিনি যেহেতু ডাক্তার, এই প্যান্ডেমিকে তিনি মানুষের সেবা করতে পারবেন। কিন্ত তার আবেদনে সাড়া দিলো না ভারত সরকার। কফিল বন্দী রইলেন জেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, দেড়শো বন্দীর জন্য একটা বাথরুম, প্রচণ্ড গরম, সেখানে সাতটা মাস কাটিয়ে ফেললেন কফিল। এই সময়ে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসার কথা ভাবেননি একবারও, মাথা নত করার চিন্তাও মগজে আসেনি।
বম্বে হাইকোর্ট এরপর কফিল খানের বিরুদ্ধে আনা ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট থেকে তাকে রেহাই দিয়েছে। হাইকোর্ট বলেছে, আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে দেয়া কফিলের বক্তব্যের কোথাও ধর্ম বা দেশের প্রতি অবমাননাকর বা ষড়যন্ত্রমূলক কোন বাক্য ছিল না। এই দফায় মাস জেল খেটে থেকে মুক্তি পেয়েছেন কফিল। মোট তিন দফায় জেল খেটে (এর মাঝে আরও একবার ৪৫ দিনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাকে) তার মানসিকতা বদলে গেছে পুরোপুরি। মৃদুভাষী চিকিৎসক থেকে প্রতিবাদী এক ভাবমূর্তিতে পরিণত হয়েছেন তিনি। জেল থেকে বেরিয়েই বলেছেন, যত মামলাই আসুক, আবার জেলে নেয়া হোক- এসবের পরোয়া তিনি করেন না। ডাক্তারীর পাশাপাশি তিনি মানুষের অধিকার, অনিয়ম আর অবিচার নিয়েও কথা বলতে চান। কিন্ত তার কণ্ঠরোধ করার সব অপচেষ্টাই করছে যোগী সরকার। তারা কফিল খানকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে 'আজীবন নজরদারীতে রাখা হবে' বলে ঘোষণা দিয়েছে গতকাল। দাগী আসামীর মতোই বাকি জীবনটা কাটাতে হবে কফিলকে, সইতে হবে পুলিশি উৎপাত।
একটা রাষ্ট্র যখন আদাজল খেয়ে শুধুমাত্র মত প্রকাশের কারণে একজন নাগরিকের পেছনে লাগে, একজন সরকার প্রধান যখন সামান্য একজন চিকিৎসককে ব্যক্তিগত শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করেন, তখন রাষ্ট্রের বা সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রটা পরিস্কার হয়ে ওঠে। শুধু ভারত নয়, উপমহাদেশের অনেক দেশেই এমন নজির আছে। কফিলের ঘটনায় সেটারই আরেকটা উদাহরণ তৈরি হলো মাত্র। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এত অত্যাচার-নির্যাতন করে বিজেপি বরং বিরোধী কণ্ঠস্বরে আরেকজন তারকাকেই যুক্ত করেছে, তিন বছর আগে যে কফিলকে কেউ চিনতো না, তিনিই এখন মিডিয়া সেনসেশন হয়ে উঠেছেন। একজন ডা. কফিলকে 'তৈরি করার' মাশুল দলটাকে ভবিষ্যতে দিতে হবে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন