ভুল যে কেউই করতেই পারে, ভুল করাটা অপরাধ নয়। কিন্ত ভুল স্বীকার না করে ভুলটাকে জাস্টিফাই করাটা অপরাধ, সেই ভুলের সূত্র ধরে অন্যকে হুমকি দেয়াটা অপরাধ- জাকির সেটা করেছেন।

গোঁয়ারগোবিন্দ টাইপের লোকজনের সাথে ডিল করাটা খুব ঝামেলার। এরা নিজেদেরকে মহাপণ্ডিত মনে করে, ভাবে, দুনিয়ার সবকিছু বোধহয় তারাই জানে, বাকীরা সব বোকার স্বর্গে বাস করছে। চোখে আঙুল দিয়ে, তথ্য-উপাত্ত হাজির করে এদের ভুল ধরিয়ে দিলেও এদের দম্ভ কমে না, এরা ভুল স্বীকার করতে চায় না, উল্টো ভাব নিয়ে বেড়ায়, কিছু ক্ষেত্রে তো প্রভাবশালী আত্মীয়-স্বজনের রেফারেন্স টেনে হুমকিও দেয়। সেসবের পরিণতিতে যে মাঝেমধ্যে বেকায়দায় পড়তে হয়, সেটা এদের মাথায় থাকে না। ডা. জাকিরের অবস্থা এখন হয়েছে এমনই। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকদিন আগেও দারুণ আলোচিত এক চরিত্র ছিলেন ডা. জাকির। করোনা নিয়ে ভিডিওবার্তায় কথা বলতেন তিনি, ফেসবুক লাইভে এসে জাতিকে জ্ঞান দেয়ার 'মহৎ' কাজ চালাচ্ছিলেন। কিন্ত পেশাদার চিকিৎসক হয়েও করোনা নিয়ে ভুল কিছু তথ্য দিয়ে বসেছিলেন তিনি। মানুষ ভুল করতেই পারে, সেটা সমস্যা না। সমস্যা বাঁধে তখন, যখন গোঁয়ার্তুমি করে ভুলটাকেই শুদ্ধ হিসেবে দাবী করা হয়। ডা. জাকির সেটাই করেছিলেন। 

তেইশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে করোনা ছড়ায় না- দুনিয়া বদলে দেয়া এই যুগান্তকারী ফর্মূলা তারই আবিস্কার। বাংলাদেশে করোনার কোন ভয় নেই, করোনাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন তিনি- এরকম দাবীও ডা. জাকির করেছিলেন ভিডিওতে। করোনার সময়ে ঘরে বসে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন, বাতলে দিয়েছেন বিশেষ একটি কোম্পানীর ঔষধের নামও, একজন চিকিৎসকের জন্য যেটা এথিক্যাল ভায়োলেন্সের শামিল। 

ভিডিওতে ঔষধের নাম বাতলে দিচ্ছেন ডা. জাকির

ডা. জাকিরের সেসব ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, তার কথাবার্তা শুনে, ডাক্তারের পোষাক এবং গলায় ঝোলানো স্টেথেস্কোপ দেখে মানুষজন বিশ্বাস করেছে কথাগুলো। হাজার হাজার শেয়ার হয়েছে ভিডিওগুলো, অথচ যারা শেয়ার দিয়েছে, যারা অন্ধের মতো ডা. জাকিরের কথা বিশ্বাস করেছে, তারা জানতেও পারেনি যে তিনি ভুল তথ্য দিচ্ছেন। 

পরে যখন অন্যন্য চিকিৎসক এবং করোনাভাইরাস সম্পর্কে জ্ঞান রাখা মানুষজন জাকিরের এসব ভিডিও দেখেছেন, তারা প্রতিবাদ জানিয়েছেন এই মিথ্যাচারের। তথ্য-উপাত্ত হাজির করে অনেকেই দাবী করেছেন যে ডা. জাকির ভুল ইনফরমেশন দিয়েছেন। কিন্ত শুরুতেই বলেছি, আমাদের এই ডাক্তার জাকির গোঁয়ারগোবিন্দ টাইপের লোক, তিনি কি আর এসব প্রতিবাদে পাত্তা দেন? উল্টো তার ভক্ত-আশেকান-মুরিদরা জাকিরের ভুল ধরতে আসা লোকজনকেই ধুয়ে দিলো, প্রশ্ন তুললো, আপনারা কি জাকির স্যারের থেকে বেশি জানেন? আপনার এপ্রন আর স্টেথোস্কোপ কই? জাকির সাহেবও এমন মুরিদদের দেখা পেয়ে উড়তে শুরু করলেন, ডাহা মিথ্যে এবং ভুল তথ্য দেয়া ভিডিওগুলো সরানোর নাম মুখেও আনলেন না। 

যাই হোক, সেসব ঘটনার পরে প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গেছে। করোনাভাইরাস এখন বাংলাদেশেও মূর্তিমান আতঙ্কের নাম, আজ পর্যন্ত প্রায় সতেরো জন মারা গেছেন কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে, করোনা পজিটিভ হিসেবে ধরা পড়েছেন ১৬৪ জন। একের পর এক এলাকা লকডাউন করে দেয়া হচ্ছে, সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে পুরো দেশজুড়ে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অসহায় চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

এই দুর্দিনে আমাদের জাকির সাহেব কোথায়? যিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশে করোনা আক্রমণের কোন সুযোগ নেই, তাকে এখন দেখা যাচ্ছে করোনা থেকে বাঁচতে পিপিই পরে চেম্বারে কাজ করছেন! এই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেরী হয়নি। ডা. জাকিরের ভিডিও থেকে করোনাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর অংশটুকুর স্ক্রিনশট নিয়ে তার পিপিই পরা ছবিটার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে অনেকেই মিম বানিয়েছেন, ট্রল করছেন। উল্টোপাল্টা কথা বললে এদেশে মন্ত্রী-এমপিদের নিয়েও অহরহ হাসিঠাট্টা হয়, তাহলে জাকিরকে নিয়ে হবে না কেন? কিন্ত ডা. জাকির তো সামান্য ভুল ধরাটাই মেনে নিতে পারেন না, সমালোচনা বা ট্রল কি করে মেনে নেবেন? তাই আরও একবার মঞ্চে আবির্ভূত হলেন তিনি, আর সেটা করতে গিয়েই নোংরামিতে জড়ালেন। 

ডা. জাকিরকে ট্রল করে বানানো এই ছবি ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে

জাকিরের সেই ছবিটা ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছে অজস্র মানুষ। এদেরই একজন রম্য লেখক এবং শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রোমেন রায়হান, যিনি কিনা পদাধিকার বলে ডা. জাকিরের সিনিয়র। ছবিটা শেয়ার দেয়ার পরে ফেসবুকের ইনবক্সে ডা. জাকির তাকে হুমকি দিয়েছেন, নিজেকে একজন বিচারপতির জামাতা এবং আইনমন্ত্রীর আত্মীয় দাবী করে তিনি বলেছেন, এই পোস্ট যেন সরিয়ে নেয়া হয়। সেই মেসেজের স্ক্রিনশট রোমেন রায়হান শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। 

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। বিষয়টা নিয়ে ফেসবুকে আলোচনা-সমালোচনা হবার পরে সেটা আইনমন্ত্রীর চোখেও পড়েছে, পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে মন্ত্রী কিছুই জানতেন না। তার নাম ব্যবহার করে কেউ একজন পাওয়ার প্র‍্যাকটিস করছে, অন্যকে হুমকি দেয়ার চেষ্টা করছে- ব্যাপারটাতে তিনি প্রচণ্ড বিরক্ত এবং বিব্রতবোধ করেছেন। তাই তিনি নির্দেশ দিয়েছেন ডা. জাকিরের বিরুদ্ধে যেন অবিলম্বে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে দেখে ডা. জাকির সুবোধ বালকটি হয়ে গেছেন, রোমেন রায়হানের কাছে কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা চেয়েছেন, তবে ভুল তথ্য দেয়া ভিডিওগুলো এখনও সরিয়ে নেননি। ডা. জাকির শিক্ষিত মানুষ, সেন্সিবল আচরণ তিনি করতেই পারতেন, অথচ সেই পথে হাঁটার চেষ্টাটাও তিনি করলেন না!

ডা. জাকিরের এই ঘটনা থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই। 'পিপিলিকার পাখা গজায়' বলে একটা বাংলা প্রবাদ আছে, জাকির সাহেব সেই পিপিলিকার মতোই আচরণ করেছেন, ফেমসিকার এই ভদ্রলোক খ্যাতির মোহে অন্ধ হয়ে গিয়েছেন, ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন, নিজের আত্মীয়-স্বজনের নাম ব্যবহার করে মানুষকে হুমকি ধামকি পর্যন্ত দিয়েছেন। ভুল যে কেউই করতেই পারে, ভুল করাটা অপরাধ নয়। কিন্ত ভুল স্বীকার না করে ভুলটাকে জাস্টিফাই করাটা অপরাধ, ভুলকে শুদ্ধ দাবী করে কাউকে হুমকি দেয়াটা অন্যায়- জাকির সেটা করেছেন। আইনমন্ত্রীর তরফ থেকে এমন প্রতিবাদ এবং কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার বার্তাটা না এলে তার আত্মগরিমা কোথায় গিয়ে থামতো, সেটা আমরা জানিনা... 

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা