
এই হাসপাতালের বিশেষ কিছু নিয়মের একটি হচ্ছে সকালের প্রার্থনা। আপনি যদি কোনোদিন সকালে হাসপাতাল খোলার আগে সেখানে যান, দেখবেন তিন ধর্মের মানুষ তিন ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করছে, আশেপাশে রোগী থেকে শুরু করে হাসপাতালের স্টাফেরা সবাই সেখানে উপস্থিত।
বাবা ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, নিজে ছিলেন ডাক্তার। ছোটবেলা থেকেই অঢেল ধনসম্পদের মাঝে বড় হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার এই জীবনখানা পছন্দের ছিল না। চাইতেন বিত্তবানের চিরচরিত বৃত্ত ভেঙ্গে নিজেই ভিন্ন কিছু করবেন। সেই ভিন্ন কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে বেছে নেন মাতৃভূমি থেকে বহুদূরের দেশ বাংলাদেশ। বলছিলাম নিউজিল্যান্ডের মাদার তেরেসাখ্যাত ডাক্তার এড্রিক বেকারের কথা। পাঠক, জানেন এই মহামানবের কথা?
ডাক্তার এড্রিক বেকার বাংলাদেশে আসেন আশির দশকে। উদ্দেশ্য ছিল গরীব-দুঃখী মানুষের জন্যে কাজ করবেন। প্রথমে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর সহ বিভিন্ন জেলাতে কাজ করেন। পরে টাঙ্গাইলের মধুপুরে এসে তিনি এখানকার মানুষের দুর্দশা দেখে এখানে হাসপাতাল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময়ে দুর্গম মধুপুরে না ছিল কোন পাকা রাস্তা, না ছিল বিদ্যুৎসুবিধা। আদিবাসী গারোসহ এই এলাকার অন্যান্য গরীব-দুঃখী মানুষদের কাছে ধীরে ধীরে আশা ও ভালোবাসার এক নাম হয়ে যান ডাক্তার বেকার ও তার কাইলাকুরি হাসপাতাল। মধুপুরবাসী ভালোবেসে এই ভিনদেশী ডাক্তারের নাম দিয়ে দেন ‘কাইলাকুরির ডাক্তার ভাই’।
ডাক্তার বেকারের হাসপাতালখানা কেমন? জানলে আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না। এখানে নামমাত্র মূল্যে আউটডোরে সেবা ও ভর্তি করা সহ এই এলাকার ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে ইনসুলিন প্রদান করা হয়। মোটামুটি টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুরের হতদরিদ্র মানুষের জন্যে আশাভরসার একমাত্র স্থান এই কাইলাকুরি হাসপাতাল। টাকার অভাবে কোনো রোগী কোনদিন সেবা না পেয়ে ফিরে যাবে না- এই হলো কাইলাকুরি হাসপাতালের মূলনীতি।

এই হাসপাতালের বিশেষ কিছু নিয়মের একটি হচ্ছে সকালের প্রার্থনা। আপনি যদি কোনোদিন সকালে হাসপাতাল খোলার আগে সেখানে যান, দেখবেন তিন ধর্মের মানুষ তিন ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করছে, আশেপাশে রোগী থেকে শুরু করে হাসপাতালের স্টাফেরা সবাই সেখানে উপস্থিত। বর্তমানে সিরিয়া, মায়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুর মাঝে কাইলাকুরি হাসপাতালের অসাম্প্রদায়িকতার এই চিত্র দেখে আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না। কি সুন্দরভাবেই না ধর্মকে সম্প্রীতির মূলভিত্তি করে গেছেন ডাক্তার ভাই!
ডাক্তার ভাই নিজে ছিলেন প্রচারবিমুখ। ক্রিস্টমাসে নিউজিল্যান্ডে যখন যেতেন, পরিবারকে সময় দিতে পারতেন না। হাসপাতালের জন্যে তহবিল তুলতেই তাঁর সময় কেটে যেত। বাংলাদেশেও তিনি নিজের কাজের প্রচারণা করতে চাইতেন না। ইত্যাদিতে ২০০৯ সালের দিকে এক ডকুমেন্টরিতে তাঁর এই হাসপাতালের কথা দেশবাসী জানতে পারেন। তখন তৎকালীন সরকার মধুপুর থেকে দুর্গম কাইলাকুরি পর্যন্ত একটি পাকা রাস্তা তৈরী করে দেন।

সবাইকে কাঁদিয়ে এই মহামানব ১লা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ তে চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কাইলাকুরিতে তাঁর বাসভবনেই সমাধিস্থ করা হয়। আজও কাইলাকুরির মানুষ শ্রদ্ধাভরে তাঁদের ‘ডাক্তার ভাই’কে স্মরণ করে। ভাবুন তো, বিত্তশালী এক পরিবারের সন্তান, নিজের যৌবনের সুন্দরতম সময় কাটিয়ে দিয়েছেন পরিবার থেকে বহুদূরের এক দুর্গম জনপদে। আমরা হলে কি পারতাম? ওপারে ভালো থাকবেন, ডাক্তার ভাই। অনেক অনেক দোয়া রইল আপনার জন্যে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন