মুকওয়েগের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হতো ধর্ষিতা নারীদের। সরকারের বিপক্ষে কথা বলে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, তাকে দেশে ফেরানোর জন্য রাজপথে নেমেছে জনগন, তিনি যেদিন ফিরে এলেন, সেদিন তাকে বরণ করার জন্য ভিড় জমেছিল বিশ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে!

২০১৫ সালে 'দ্যা ম্যান হু মেন্ডস উইমেন’ নামে একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিলো। আইএমডিবির ৭.৮ রেটিং পাওয়া এ সিনেমার মূল গল্প একজন ডাক্তারের জীবনকে কেন্দ্র করে। যে ডাক্তারের নাম ডেনিস মুকওয়েগে। কঙ্গোর স্ত্রী'রোগ বিশেষজ্ঞ এই ডাক্তার নিজদেশে পরিচিত 'জাদুকরী ডাক্তার' নামে। ২০১৮ সালে পেয়েছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। কঙ্গোর এই সর্বজনবিদিত ডাক্তারকে চেনে সবাই। ভালোবাসে সবাই। কেন তাকে ভালোবাসে সবাই? কেন তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো শাসকদল? কেন তিনি গড়লেন পেনজি হাসপাতাল? জানা যাক আজ সবকিছু নিয়েই।

মুকওয়েগে ছিলেন বড় পরিবারের নয় ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়জন। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিলো, ডাক্তার হবেন। প্রথমদিকে ইচ্ছে ছিলো, যেকোনো ডাক্তার হলেই হবে। সোজা কথা, ডাক্তার হয়ে মানুষকে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু যখন বড় হলেন, দেখলেন এই গরীব দেশের নারীরা না পাচ্ছে শিক্ষা, না পাচ্ছে চিকিৎসা। এসব নারীদের গর্ভধারণের পর দেখা দিচ্ছে নানারকম জটিলতা। তিনি ভাবলেন, তাকে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই হতে হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা শুরু করেন ইউনিভার্সিটি অব বুরুন্ডিতে। এখান থেকে মেডিক্যাল ডিগ্রী নিয়ে বের হওয়ার পর বুকাবু শহরের পাশে লিমরা হাসপাতালে একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয় তার। তবে লিমরা হাসপাতালে  বেশিদিন থাকেন না তিনি। স্ত্রীরোগ বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্যে ফ্রান্সের অঁজের বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তিনি এবং সেখানে থেকে ডিগ্রি নিয়ে বের হন।

ফ্রান্স থেকে ফিরে তিনি আবার লিমরা হাসপাতালে যোগ দেন। প্রথম কঙ্গো যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সহিংসতার কারণে সেখানে থাকা আর সম্ভব হয় না। তিনি চলে আসেন বুকাবুতে। এবং সেখানে পেনজি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এই পেনজি হাসপাতাল স্থাপনের পেছনে রয়েছে এক অদ্ভুত গল্প। কঙ্গোতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে তিনি তো ফিরে এলেন বুকাবুতে। সেসময়ে যুদ্ধে ধর্ষিত এক মহিলাকে তিনি পেয়ে যান ঘটনাচক্রে। সেই মহিলার অপারেশন করেন তিনি এবং তাকে সুস্থ করেন। মুকওয়েগের ভাষ্যমতে, ধর্ষণের পরে এই মহিলার জননাঙ্গ ও উরুতে বুলেটও ছোড়া হয়েছিলো। আহত মহিলা যখন পুরোপুরি সুস্থ হন, এই ঘটনা মুকওয়েগের জীবনে আনে বিশাল পরিবর্তন। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেন, এই ধর্ষিত নারীদের জন্যেই একটা হাসপাতাল করতে হবে। এরপরই আত্মপ্রকাশ করে 'পেনজি হাসপাতাল।'

পেনজি হাসপাতাল, স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত অসাধারণ সেবা দেওয়ার জন্যে খুব অল্পসময়েই নাম করে। এখানে যেসব মহিলা চিকিৎসা নিতে আসতেন, তার ষাট শতাংশই ছিলেন যৌন নিপীড়নের স্বীকার। কঙ্গো যুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীরা এখানে চিকিৎসার জন্যে আসতেন। প্রতিদিন গড়ে দশটিরও বেশি অপারেশন করতে হতো মুকওয়েগে'কে। এখনো হয়। মুকওয়েগের হাসপাতালে এখন বছরে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩ হাজার ৫শ’রও বেশি নারী। তাবু খাঁটিয়ে শুরু হয়েছিলো এই হাসপাতালের যাত্রা। একটি অপারেশন থিয়েটার আর একটি জেনারেল ওয়ার্ড নিয়ে যাত্রা শুরু করা হাসপাতাল এখন হয়ে গিয়েছে দেশের গৌরবেরই অংশ।

এই নিঃস্বার্থ ডাক্তারকেই একসময়ে এসে পালাতে হয়েছিলো দেশ ছেড়ে। কঙ্গোয় অন্যায়-যুদ্ধ এবং প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা সরকারের তীব্র সমালোচনা করার জন্য শাসকদলের রোষানলে পড়েন তিনি। পরিবার নিয়ে সপরিবারে পালিয়ে যেতেও তখন তিনি বাধ্য হন৷ পরে অবশ্য আবার দেশে ফিরেছিলেন। তবে এই সাময়িক বাস্তুহারা হওয়াতে মুকওয়েগে থামেনওনি, ভয়ও পান নি। এর প্রমান পাই আমরা জাতিসংঘ ভাষণে। জাতিসংঘের এক ভাষণে তিনি কঙ্গো-যুদ্ধের উপর্যুপরি সমালোচনা করেন। নারীদের উপর নির্যাতনের জন্যে এই যুদ্ধের পক্ষদের তীব্র নিন্দা করেন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে শাসক দল এবার তার বাড়িতে আবার হামলা চালায়। তার মেয়েকে জিম্মি করে রাখা হয় ঘরের মধ্যে। সন্ধ্যায় ডাক্তার যখন হাসপাতালের কাজ সেরে ফিরে বাসায় ঢুকছেন,  তখন তাকে গুলিও করা হয়। কিন্তু দৈবাৎ বেঁচে যান তিনি। তার দেহরক্ষী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি সবসময়েই ছিলেন সরব

এরপর আর তিনি দেশে থাকেননি। চলে যান সুইডেনে। সেখান থেকে বেলজিয়ামে। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারেন নি। দেশবাসী রীতিমতো আন্দোলন করে আবার তাকে ফিরিয়ে আনে। তার প্লেনের টিকেটের দামও দিয়ে দেয় এই মানুষেরা। এতই ভালোবাসতেন মুকওয়েগেকে সবাই। তিনি যেদিন দেশে ফিরলেন, তার ফেরার পথে বিশ কিলোমিটার দীর্ঘ লাইন ছিলো মানুষের! সবাই খুশি, ডাক্তার যে আবার বাড়ি ফিরছেন।

এরপর থেকে মুকওয়েগের দায়িত্ববোধ যেন বেড়েছে আরো কয়েকগুণ। তবে স্বাভাবিকভাবে খোলামেলা জীবনযাপন আর করা হয়নি তার। নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্য দিয়েই কাজকর্ম, জীবন সব চলেছে এরপর। যেদিন নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা আসে, সেদিন হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে ছিলেন তিনি, অপারেশন করছিলেন। অপারেশন শেষ করে যখন বাইরে বের হয়ে এলেন, শুনলেন, মানুষজনের চিৎকার চেঁচামেচি। এরপরেই পেলেন সংবাদটা। মানুষের এই তীব্র ভালোবাসায় সেদিন কী চোখে জল এসেছিলো ডাক্তারের? হয়তো। হয়তো না৷

অপারেশন টেবিল থেকে বের হয়েই শুনেছিলেন 'নোবেল-প্রাপ্তি'র খবর! 

এই মানুষটি সারাজীবনে পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার, খেতাব, সম্মান। পেয়েছেন তো নোবেল পুরস্কারও। তবে মানুষের ভালোবাসার যে 'পুরষ্কার' তিনি পেয়েছেন, তার সাথে তুলনা হবে না আর কোনোকিছুরই। মানুষের ভালোবাসা ফিরে এসেছে বারেবার। বিদেশ থেকে প্লেনের টিকেট, বিশ মাইল দীর্ঘ লাইন, নোবেল প্রাপ্তির পর মানুষজনের সম্মিলিত উল্লাস... ভালোবাসার নানা রূপান্তরই দেখেছি আমরা। সময়ে। অসময়ে। অবশ্য তিনিও কী কম ভালোবাসেন মানুষকে? মৃত্যুভয়ের মুখে থেকেও সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষের জন্যে কথা বলা, দিনে দশটারও বেশি ধর্ষিত নারীর অপারেশন করে এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক নারীর জীবনকে আবার সুস্থ করে দেওয়া... ভালোবাসা কী একতরফা? মোটেও না।

দুইদিকেই আমরা তাই দেখি এক সুন্দর ভালোবাসারই জয়গান।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা