ভাইরাল হওয়া এই ছবির পেছনের গল্পটা আসলে কী ছিল?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
করোনায় আক্রান্ত রোগী মৃত্যুর এক ঘন্টা আগে 'দাঁড়িয়ে' চুমু খাওয়ার শক্তি কোথায় পেলেন- এই প্রশ্ন কারো মাথায় আসেনি।
চকবাজার ট্র্যাজেডির কথা মনে আছে? পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে মানুষ, নিখোঁজ অনেকে, স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত; ঠিক তখন ফেসবুকে একটা গল্প ভাইরাল হলো। গর্ভবতী স্ত্রী বিল্ডিং থেকে নামতে না পারায় নামেননি স্বামীও, তাই দুজনেই নাকি সহমরণের পথ বেছে নিয়েছেন! রিয়া আর রিফাত নামের কাল্পনিক দুই চরিত্রকে নিয়ে বানানো এই গল্পটা পাবলিক খুব শেয়ার করলো, কয়েকটা নামীদামী মিডিয়াতেও ছাপা হলো বিয়োগাত্মক এই প্রেমগাঁথা। ফেসবুক জুড়ে এই দম্পতির শোকে স্তব্ধ সবাই।
কিন্ত মজার ব্যাপার হলো, পরদিন থেকেই রিয়া-রিফাতের কোন স্বজনকে খুঁজে পাওয়া গেল না, পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া লাশের দাবী করতে এসে রিয়া বা রিফাত নামের কাউকে খুঁজলো না কেউ। কয়েকটা মিডিয়ার অনুসন্ধানে উঠে এলো, পুরো ঘটনাটাই ছিল গুজব, ফেসবুকে কয়টা লাইকের আশায় কাল্পনিক একটা গল্প বানিয়েছে কেউ, সেটা ভাইরাল হয়েছে, এমনকি কয়েকটা মিডিয়াও সেটাকে রংচং মাখিয়ে পরিবেশন করেছে!
করোনায় প্রকম্পিত পুরো ইতালি, শয়ে শয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। একদিনে সর্বোচ্চ আটশো মানুষ মারা যাওয়ার রেকর্ডও হয়েছে! সেই ইতালি নিয়েই একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। একটা ছবি ভাইরাল হচ্ছে, সেই ছবিতে দুজন তরুণ-তরুণী পরস্পরকে চুমু খাচ্ছেন, দুজনের গালের নিচের অংশে ঝুলছে মাস্ক। বলা হচ্ছে, এটি নাকি ইতালির এক ডাক্তার দম্পতির ছবি। এই দম্পতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অজস্র রোগীর সেবা করেছেন, এক পর্যায়ে তারা নিজেরাই করোনাভাইরাসে সংক্রামিত হন। ছবিটি তাদের শেষচুম্বনের। এই ঘটনার এক ঘন্টার মধ্যেই নাকি মারা যান তারা!
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া পোস্টে লেখা আছে- ফেসবুক পোস্টটির ক্যাপশন লেখা হয়েছে, 'ছবিটি কোন ভ্যালেন্টাইনের ছবি নয় বন্ধুরা। ছবিটি ইতালির এক বিখ্যাত হসপিটালের ছবি। এই দুইজন হলেন ইতালির প্রথম সারির বিখ্যাত দুই ডক্টর। এরা হলেন স্বামী স্ত্রী ও। এরা 20 দিন ধরে দিন রাত পরিশ্রম করে, ১৩৪ জন নোভেল করোনা আক্রান্ত মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। কিন্তু, ঘটনা হল- ঐ ২০ দিনের মধ্যেই ওরা দুই ডাক্তার দম্পতি করোনার করালগ্রাসে চলে এসেছেন। মানে ওরাও করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়েন। আর মৃত্যু নিশ্চিত জেনে গতকাল ওরা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসার শেষচুম্বনটুকু করেন। আর তার ঠিক একঘন্টার মধ্যেই দুজনেরেই মৃত্যু ঘটে। (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)''
লেখাটায় অজস্র বানান ভুল। এরকম আবেগী গল্পগুলো মানুষকে দুর্বল করে ফেলে, এখানেও সেরকমই ঘটনা ঘটেছে। করোনায় আক্রান্ত রোগী মৃত্যুর এক ঘন্টা আগে 'দাঁড়িয়ে' চুমু খাওয়ার শক্তি কোথায় পেলেন- এই প্রশ্ন কারো মাথায় আসেনি। তারা দুজন কি কাল্পনিক রিয়া-রিফাতের মতো একসঙ্গে একই সময়ে মারা গেছেন কিনা, সেটাও আমরা জানিনা। জানার কোন উপায় নেই, কারণ এই ছবির সাথে ইতালিরই দূরতম কোন সংযোগ নেই। এরা কেউই ইতালিয়ান নন, এই ছবিটিও ইতালিতে তোলা হয়নি।
ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট বুম রিসার্চ এই ছবির উৎস খুঁজে বের করেছে। স্পেনের বার্সেলোনা বিমানবন্দরে ২০২০'র ১২ মার্চ ছবিটি তোলা হয়েছিল। ছবিটি তুলেছিলেন ইমেলিও মরেনাতি নামের এক চিত্রগ্রাহক। এপি ইমেজেসের এই ওয়েবসাইটে গেলে ছবিটি দেখতে পাবেন। ভাইরাল হওয়া এই ছবি নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টও একটা সংবাদ প্রকাশ করেছে, সেখানেও বলা হয়েছে, আমেরিকান এই তরুণ এবং তরুণী স্পেনে বেড়াতে গিয়েছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ইউরোপ থেকে আমেরিকায় ঢোকার সব ফ্লাইট বাতিল করলেন, তখন তারা আটকা পড়েছিলেন বার্সেলোনা বিমান বন্দরে, তাদের ফ্লাইট বাতিল হয়ে গিয়েছিল। ছবিটি সেই সময় তোলা।
না বুঝে অনেক কিছুই আমরা ভাইরাল করে ফেলি, আবেগের ডিব্বা ঢেলে দেই অপাত্রে। আবেগ জমিয়ে রাখুন, সেটা যত্রতত্র খরচ করার দরকার নেই, ফেক নিউজ বা গুজবে আবেগ নষ্ট করার তো কোন মানেই হয় না। ইতালিতে প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছেন, প্রত্যেকটা মানুষের সঙ্গে সঙ্গে অজস্র গল্প ফুরিয়ে যাচ্ছে চিরতরে। সম্ভব হলে গুজবে কান না দিয়ে নিজ নিজ ধর্মমতে তাদের জন্যে প্রার্থনা করুন, নিজের সাবধান আর সতর্ক থাকুন। সেটাই বেশি দরকারী।