যাকে দিয়েছিলেন আশ্রয়, তার দেওয়া তথ্যেই নিভে গিয়েছিল জীবনপ্রদীপ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

নিয়তির কি অদ্ভুত বিধান! ডা. আলীম ঘুর্নাক্ষরেও টের পেলেন না এই মৌলানা আবদুল মান্নান আসলে জামায়াতের আলবদর হায়েনাদের গুপ্তচর! এবং শেষ পর্যন্ত এই মান্নানের রেকি করে দেওয়া তথ্যেই তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদরের হায়েনারা।
"এই দিবসটিতে কথা বলা আসলে খুব কষ্টকর, আজ আমরা যখন এখানে বসে আছি, ১৯৭১ সালের এই দিনে একটি কাদালেপা মাইক্রোবাস আমাদের বাসাগুলোতে ঘুরছে, দেশের সর্বোচ্চ মেধার অধিকারী কিছু মানুষ, তাদেরকে চোখে গামছা গিয়ে বেঁধে হাত বেঁধে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। পেছনে পড়ে থাকছে তাদের স্ত্রী, ছোট ছোট সন্তান। একটা সুন্দর সোনার বাংলা দেখবো বলে আমরা কিন্তু আমাদের এই ত্যাগ হাসিমুখে মেনে নিয়েছি। আমাদের বাবারা মাথা উঁচু করে চলে গেছেন,আমাদের মায়েরা রয়ে গেছেন, তারা কিন্তু কোন অভিযোগ ছাড়াই, অনুযোগ ছাড়া চোখের জল গোপন করে দীর্ঘ ৪৫ বছর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
আমি আমার বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিলাম। আমার ঠিক এক বছরের বড় একটা বোন আছে। আমি যেহেতু ঠিক এক বছর পরেই হয়ে গিয়েছিলাম, আমার মা আমার বোনটাকে ঠিক সময় দিতে পারতেন না। আমার বোনটা একটু অসুস্থও ছিল।মা’র অজান্তে আমি বাবার বুকের উপর গিয়ে পরে থাকতাম। এতো ব্যস্ত একজন ডাক্তার, রাতের বেলা ফিরে এসে ওইটুকু মেয়েকে নিয়ে বুকের মধ্যে করে ঘুমোতেন। পাশ হতে পারতেন না, কাত হতে পারতেন না। আমার এই বাবাটাকে ধরে নিয়ে যাবে ১৫ই ডিসেম্বর বিকেলবেলা, ধরে নিয়ে গিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে তাদেরকে রাখা হত, এই অংশটা চিন্তা করতে চাই না। ওখানে কি করা হত সেটাও ভাবতে চাই না। শুধু এটুকু বলি, ১৮ তারিখে আমার বাবার লাশটা যখন আমরা পাই, বুকটা ঝাঁজরা ছিল গুলিতে, তার কপালে বেয়নেট চার্জ করা ছিল।
আপনাদের কাছে যখন আসি, অনেক আবেগতাড়িত হয়ে যাই, হতে চাই না, কিন্তু হয়ে যাই, কারণ আপনাদের দিকে যখন তাকাই, আমার সবসময় মনে হয়, আপনারা কি বোঝেন কিনা যে আমাদের বাবারা হাসিমুখে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিল এই আত্মবিশ্বাসে যে আপনাদের হাতে দেশটা দিয়ে গেলে দেশটা ভালো থাকবে..."
কয়েক বছর আগে বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে একটি টেলিকম কোম্পানির তৈরি এক ট্রিবিউটের কল্যাণে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাক্তার এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরীর কন্যা ডাঃ নুজহাত চৌধুরীর এই কথাগুলো বেশ নাড়া দিয়ে গেছে সবাইকে। ২০১৬ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অসম্ভব আবেগস্পর্শী এই কথাগুলো বলেন ডাঃ নুজহাত চৌধুরী। অনেকেই প্রচণ্ডভাবে আপ্লুত হয়েছেন তার কথাগুলোতে, অনেককেই ছুঁয়ে গেছে কথাগুলো।
কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সন্তান তানভীর হায়দার চৌধুরী দ্বিমত পোষণ করে লিখেছেন, তাঁরা 'হাসিমুখে' মৃত্যুকে বরণ করেননি। তারাও রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন, আকাঙ্খা ছিল তাঁদের, অনুরাগ ছিল, এই পৃথিবীর প্রতি মায়া ছিল। এক উদার, অসাম্প্রদায়িক, সংস্কৃতিমনা দেশের স্বপ্ন দেখা এই মানুষগুলোর বর্বর আর বীভৎস মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণের কথা ভেবে তাদের আক্ষেপ আর হাহাকারকে ছোট করা উচিৎ নয়। তানভীর ভাইয়ের কথাগুলো পড়বার পর আমি আবার নুজহাত আপুর বক্তব্যটা দেখতে বসলাম। মানুষটা তার বাবা সম্পর্কে বলছেন।
অসম্ভব ভালবাসার একজন মানুষ, প্রবল প্রতিভাবান যে মানুষটা ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাশ করবার পর ১৯৬১ সালে রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিসিয়ান’স অফ লন্ডন এবং রয়্যাল কলেজ অফ সার্জন’স অফ ইংল্যান্ড থেকে ডি.ও শেষ করেছিলেন। খুব অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম সেই পাকিস্তানী আমলে, যখন ২৪ বছরের শোষণ আর বঞ্চনার নাগপাশে নিষ্পেষিত করে যাওয়া পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের পায়ের তলে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। যখন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের কোথাও সুযোগ দিত না পাকিস্তানীরা, তখন কতটা অসামান্য প্রতিভাবান হলে একটা মানুষ তৎকালীন সময়ের সর্বোচ্চ মানদন্ড বিলেত থেকে ডাক্তারিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন!
চাইলেই তিনি পারতেন বর্তমান সময়ের মত প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিতেই সন্তুষ্ট থেকে “আই হেইট পলিটিক্স” স্লোগান আউড়ে পাকিস্তানীদের অধীনতা মেনে নিতে, কিন্তু তিনি ছিলেন একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ, যার জীবনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শ্রেণীহীন শোষণ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা এবং জাতীয় মুক্তির জন্য আন্দোলন করে যাওয়া। ছাত্রজীবনে ডাঃ আবদুল আলীম চৌধুরী সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি নিয়েছিলেন এবং একটা সময় তিনি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকার সাব-এডিটর ছিলেন। এরপর তিনি ‘যাত্রিক’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখায় শ্রেণীহীন শোষণ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার কথাসহ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কথা প্রকাশ পেয়েছে।
ছাত্রাবস্থায় তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন এবং কারাবরণও করেছেন। ১৯৫৪, ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন (ভি.পি)। ১৯৫৮ সালে সেই সময়কার সরকারের বিরোধিতার কারার কারণে দেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে যান। বিদেশে থেকেও ডা. আবদুল আলীম দেশের জন্য কাজ করেছেন। ১৯৬২ সালে লন্ডনে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ছিলেন এর আহবায়ক ও প্রতিষ্ঠিতা সম্পাদক। লন্ডনে থাকা অবস্থায় ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ভাষণে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের স্বৈরাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহবান জানিয়েছিলেন।
সবচেয়ে অসাধারণ ছিল তার পেশাগত জীবনে অসামান্য নীতি ও আদর্শ বজায় রাখা! আমাদের ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থার আজীবন বিরোধিতা করে গেছেন এই মানুষটা। সমাজের শোষণ, বঞ্চনা, দুর্র্নীতি, অন্যায় ও অত্যাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাঁদের বিরোধিতা করেছেন আজীবন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমালোচনা করেছেন সবার সামনেই। ডাক্তাররাও যেন এই দুর্নীতির প্রশ্রয় না দেন সেজন্য তিনি ডাক্তারদের ‘নন প্র্যাকটিসিং জব’ করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলন করেছেন। এজন্যে তাঁকে অনেক সহকর্মীর কাছে বিরাগভাজনও হতে হয়েছিল।
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী মুটে, মজুর, দারোয়ান, শ্রমিক জেলে এবং দরিদ্র রোগীর কাছ টাকা-পয়সা কখনো নেন নি। বরং তাঁদের চোখে ছোট-বড় অপারেশন করতেন বিনা পারিশ্রামিককে। তিনি বলতেন‘ ওদের ভাতই জোটে না, তার ওপর আবার ১৬ টাকা ভিজিট!’
১৯৭০ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের ত্রয়োদশ পুনর্মিলনী উৎসবে সাবেক সভাপতি হিসেবে প্রদত্ত ভাষণ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এই শহীদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসকের আদর্শনিষ্ঠ জীবন-লক্ষ্যের পরিচয়টি। তিনি বলেছিলেন,
“আমি শুধু সমস্যাগুলো তুলে ধরেছি এবং সমাধান সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছি। তরুণ বন্ধুরা যদি সমস্যাগুলো বুঝবার চেষ্টা করেন এবং সমাধান সম্পর্কে চিন্তা করেন, তা হলেই আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে। সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আমি বিশ্বাস করি সমাজ পরিবর্তনের যে জোয়ার এসেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অজস্র নতুন প্রাণ একে ত্বরান্বিত করবে। আজকের এই উৎসবমুখর দিনে, আসুন আমরা দুঃস্থ মানবতার সেবার আত্মোৎসর্গ করি ও সংকল্প গ্রহণ করি যে, আমরা এমন একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা কায়েম করবো, যা প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা এনে দেবে। আমরা ছাত্রজীবনে দুস্থ মানবতার সেবা করার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, গণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবায়নের মাধ্যমে যে স্বপ্ন সার্থক হোক।”
অনেকের হয়তো মনে হচ্ছে, আরে এমন ডায়লগ তো অনেকেই দেয়, কাজের সময় আর কয়জনকে পাওয়া যায়! ডাঃ আবদুল আলীম ঠিক এখানেই স্পষ্ট করে গিয়েছিলেন বাকিদের সাথে তার পার্থক্য! একাত্তরে যখন নিরীহ নিরপরাধ বাঙ্গালীদের উপর পাকিস্তানী বর্বরেরা ঝাঁপিয়ে পড়লো, নির্বিচারে শুরু হলো গণহত্যা, সেই ভয়ংকর দুঃসময়ে শত্রুর নাকের ডগায় অসম দুঃসাহসী ডাঃ আলীম জীবনটা হাতে নিয়ে শুরু করেছিলেন তার যুদ্ধ। কারফিউ উঠে গেলে আলীমের কাজ আরম্ভ হতো। গাড়ির বনেট ভর্তি করে ওষুধ সংগ্রহ করতেন বিভিন্ন ফার্মেসি আর ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে। এগুলো আবার মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটিতে পৌঁছে দিয়ে আসতেন তিনি।
এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার জন্য একটি গোপন হাসপাতাল ছিল। সেখানে গিয়ে ডাঃ আলীম, ডাঃ ফজলে রাব্বি এবং এদের মতো আরো অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তারেরা নিজের এবং তাদের পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, সুস্থ করে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে। ডা. আলীমের মৃত্যুর পর একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেছিল, “আলীম ভাইয়ের দেয়া আমার চোখের ব্যান্ডজটি এখানো আছে। কিন্তু আলীম ভাই নেই। আলীম ভাইকে কোথায় হারালাম?” সারাটা জীবন যে মানুষটা আত্মমানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে এসেছেন, তিনি যে পরম শত্রুকেও তার বিপদে সাহায্য করতে ছুটে যাবেন, তাতে আর বিস্ময়ের কি!
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জুলাই মাসের শেষ দিকে বৃষ্টিমুখর এক সন্ধ্যায় ডাঃ আবদুল আলীমের পাশের বাসার মতিন নামে এক ভদ্রলোক মৌলানা আবদুল মান্নান নামের একজনকে তার পরিবার সহ নিয়ে আসেন। নিজেকে অসহায় হিসেবে পরিচয় দেওয়া আবদুল মান্নান আলীমের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, আর খুব স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের সময় বিবেচনায় আলীম আশ্রয় দেন মৌলানা মান্নানকে। বাসার নিচতলায় খালি জায়গায় স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করতে শুরু করে মান্নান। নিয়তির কি অদ্ভুত বিধান! আলীম ঘুর্নাক্ষরেও টের পেলেন না এই মৌলানা আবদুল মান্নান আসলে জামায়াতের আলবদর হায়েনাদের গুপ্তচর! এবং শেষ পর্যন্ত এই মান্নানের রেকি করে দেওয়া তথ্যেই আল-বদর বাহিনী জানতে পারে আলীমের গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার ঘটনা।
১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটায় মৌলানা মান্নানের দেওয়া তথ্যে বাসা থেকে আলীমকে ‘হ্যান্ডস আপ’ করা অবস্থায় বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদরের হায়েনাগুলো। ডা. রাব্বিকেও নেয়া হয়েছিলো ঐ একই দিনে বিকেল সাড়ে চারটায়। সারারাত নির্যাতনের পর ভোররাতে মেরে ফেলা হয় অসামান্য মানবদরদী ডাঃ আলীমকে। চিরকালের মতো নিভিয়ে দেয়া হয় তাঁর প্রাণের প্রদীপ। এর তিনদিন পর ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ডা. আবদুল আলীমের ক্ষত-বিক্ষত লাশটির সন্ধান পাওয়া যায়। বুকটা ঝাঁজরা ছিল অনেকগুলো গুলিতে, সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। কপালের বা-দিকে এবং তলপেটে ছিল বেয়নেটের গভীর ক্ষত। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছিল তাকে। আলবদরের এক্সিকিউশনার বা প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামান এতটাই নির্মম সারকাস্টিক ছিল যে, জানোয়ারটা উপড়ে তুলে নিয়েছিল চক্ষুবিশেষজ্ঞ আবদুল আলীমের চোখ দুটো!
না, তানভীর হায়দার ভাই ভুল বলেননি। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও যখন এই প্রজন্মের সন্তানেরা এই জাতির সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কীর্তিতে গর্ববোধ করে না, অন্যায়ভাবে বড় অসময়ে বর্বরতম পৈশাচিক মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া আমাদের সুর্যসন্তানদের যন্ত্রণাটুকু, কষ্টটুকু, একটা স্বাধীন উদার অসাম্প্রদায়িক দেশকে নিজেদের মেধা আর মননে গড়ে না তুলতে পারবার আক্ষেপটুকু উপলব্ধি করবার চেষ্টা করে না, মা-বাবা, আদরের সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রীকে ছেড়ে হঠাৎ করেই হারিয়ে যাওয়ার অকল্পনীয় হাহাকারটুকু বোঝার চেষ্টা করে না, স্রেফ নিয়মরক্ষার “শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস” পালন করেই দায়িত্ব সারে, সেই প্রজন্মের সামনে দাঁড়িয়ে নুজহাতের মতো শহীদ সন্তানেরা আর তাদের ৪৫ বছর ধরে আপনজনের বিভীষিকাময় পৈশাচিক মৃত্যুর যন্ত্রণাটুকু তুলে ধরতে চাননি, প্রগাঢ় অভিমানে চুপচাপ সেই বিভীষিকা বুকের ভেতর আগলে রেখে ‘ভায়োলেন্স আর খুন-জখম’ নিতে না পারা এই 'শান্তিপ্রিয়' প্রজন্মের সামনে স্রেফ তাদের বাবাদের রেখে যাওয়া বাংলাদেশটার কথা বলতে চেয়েছেন! বলতে চেয়েছেন, এই মানুষগুলোকে ভুলে গেলেও এই প্রজন্ম যেন তাদের রক্তের দামে কিনে দিয়ে যাওয়া এই বাংলাদেশকে ভালো রাখতে না ভোলে! তাদের বাবাদের মুখোমুখি হওয়া যন্ত্রণা আর বিভীষিকার গল্প যে “বছরে একদিন বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ” করা প্রজন্ম নিতে পারবে না!
শহীদ সন্তান ডাঃ নুজহাত চৌধুরী, সম্ভব হলে এই আধুনিক প্রজন্মকে ক্ষমা করে দেবেন। আমরা এ প্রজন্মের কয়েকজন সন্তান, সংখ্যায় অতি অল্প হলেও আমরা কখনো ডাঃ আবদুল আলীমের যন্ত্রণাটুকু ভুলতে দেবো না, তাকে হারাতে দেবো না, অপ্রাসঙ্গিক হতে দেবো না। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, আমাদের সৃষ্টিতে, তার রেখে যাওয়া এই বাংলাদেশকে আমরা ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবো! কথা দিলাম!