একজন নারী কেন নারী বিদ্বেষ মেনে নিচ্ছে? নারী বিদ্বেষ প্রচার ও প্রসারে অংশ নিচ্ছে? জানতে হলে এ বিষয়গুলো আগে বুঝতে হবে...

আচ্ছা ভাবুন তো, আজ পর্যন্ত এমন কোন মেয়েকে দেখেছেন, যে মেয়ে নিজের সাথে হওয়া অন্যায় মেনে নিয়ে, ঐ অন্যায় থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে ?

কোন দিন শুনেছেন? জেনেছেন? যে সব মেয়েরা রোজ স্বামীর হাতে মার খেয়ে চুপ থাকে, সেই সব মেয়েদের স্বামীরা একদিন জাদু বলে বাংলা সিনেমার নায়ক আলঙ্গীরের মত ভুল বুঝতে পেরে, বৌকে সম্মান করা শুরু করেছে?

জি না, এই ঘটনা বাস্তবে ঘটে না। বরং যে সব বৌয়েরা অন্যায় মেনে না নিয়ে প্রতিবাদ করে, চড় খেয়ে উলটা চড় দেয়, সেই সব স্বামীরা বুঝতে পারে, এই মেয়ের মেরুদণ্ড ভাঙতে গেলে, নিজের মেরুদণ্ডের হাড্ডি আস্ত থাকবে না। অথচ সব জেনে, দেখেও কেন আমাদের নারীদের একটা বড় অংশ, নিজেরা নারীবিদ্বেষী হয়ে উঠছে? আশেপাশের নারীদের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না ?

চোখের সামনে এত এত নারী নির্যাতন দেখেও তাদের চোখ খোলে না, উলটা বিভিন্ন ধরণের নারী বিদ্বেষী আর্টিকেল, বক্তব্যের নিচে সহমত প্রকাশ করে। আজকাল নারীবাদীদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করাদের দলের একটা অংশও নারী! কেন তারা বোঝে না, নারীবাদীরা পুরুষের বিপক্ষে না বরং নারীর উপরে হওয়া অন্যায়ের বিপক্ষে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের উপরে হওয়া অন্যায়েরও বিপক্ষে।

এখন প্রশ্ন হল, একজন নারী কেন নারী বিদ্বেষ মেনে নিচ্ছে? নারী বিদ্বেষ প্রচার ও প্রসারে অংশ নিচ্ছে? উত্তর দেবার আগে খুব ভিন্ন একটা বিষয়ে আলোচনা করি। ছোট বেলা থেকেই যে কথাগুলো নিয়মিত শুনে আসছেন সেগুলো মনে করিয়ে দেই, মনে করে দেখুন তো এগুলো আপনি শুনেছেন কিনা ?

-স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত।

-স্বামীর সন্তুষ্টি ছাড়া বেহেস্তে যাওয়া যাবে না।

-স্বামী যখনই সেক্সের জন্য স্ত্রী কে ডাকবে, স্ত্রীর অবশ্যই সাড়া দিতে হবে -না হলে ফেরেশতারা লানত বর্ষণ করবে।

-স্বামী হচ্ছে মেয়েদের জীবনে সব।

-পতি পরমেশ্বর ইত্যাদি , ইত্যাদি ।

একবার ভাবুন তো, জ্ঞান বুদ্ধি হবার পর মানে শিশু বয়স থেকে এই ধরণের কথা মুরুব্বিদের কাছে শুনে বড় হওয়া মেয়েটার কাছে তার স্বামী ঈশ্বরের মত পূজনীয় হবে না কেন? সে যদি ধর্ম মানে, সমাজ মানে, তাহলে যা জেনে বড় হয়েছে তাই মেনে নিয়েছে। সে মেনে নিয়েছে নারী আর পুরুষ কখনো এক না, নারীকে বানানো হয়েছে পুরুষের পাঁজরের হাড় দিয়ে!

অথচ তার মনে প্রশ্ন জাগে না, যদি কোন মেয়ের দ্বিতীয়বার কিংবা তৃতীয়বার বিয়ে হয়, তাহলে কোন স্বামীর পাঁজরের হাড়ে সে তৈরি হয়েছে? খাদিজার তো তৃতীয় স্বামী ছিলেন মুহাম্মাদ, তাহলে কার হাড়ে খাদিজা তৈরি হয়েছিল? কিংবা স্বামী তাকে ছাড়া অন্য নারীকে বিয়ে করতে পারে, সে কেন পারবে না? কেন বলা হয়েছে নারীরা স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাইরে যেতে পারবে না কেন বলা হয় নাই যে স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া স্বামী বাইরে যেতে পারবে না ? ইত্যাদি ইত্যাদি ।

এখানে সেই সব মেয়েদের দোষ না দিয়ে বরং যে সামাজিক, ধর্মীয় এবং পারিবারিক শিক্ষা ব্যবস্থা কে দায়ী করা যায়। নিজের অধিকার বিষয়ে প্রশ্ন করতে যে সাহস লাগে, যে চিন্তা লাগে, সেই জায়গাটাই এই সিস্টেমে গড়ে ওঠে না। আর যারা প্রশ্ন করতে চায়, তাদের কে আস্তাগফিরুল্লাহর মত ভয়ানক শব্দ দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়া হয়। এখানে শুধু বিশ্বাস করতে হবে, প্রশ্ন করাই যাবে না, টাইপ মানসিকতা গড়ে তোলা হয়। প্রশ্ন করার পথ বন্ধ করে দেবার পরেও যদি মেয়েরা কোন ভাবে প্রশ্ন করে বসে, সেক্ষেত্রে উত্তর পাবার আগে কাফির, নাস্তিক মুরতাদ বলে জাহান্নামে অনন্তকাল পোড়ার ভয় দেখানো হয়। কে চায় কতগুলা প্রশ্নের কারনে অনন্তকাল আগুনে পুড়তে ? তার চেয়ে প্রশ্ন না করে মেনে নেয়াটাই ভালো ভেবে নেয় তারা ।

এই তো গেল ধর্মীয় দিক, এবার আসি সমাজ কীভাবে মাইন্ড সেট তৈরি করে। কিছু শব্দের দিকে লক্ষ্য করুন। এই যেমন, লাখপতি, কোটিপতি এই শব্দগুলোর মানে হল, লক্ষ টাকার মালিক, কোটি টাকার মালিক। পতি শব্দের অর্থই হল মালিক। অথচ কেউ কিন্তু বলে না লাখ পত্নী, কোটি পত্নী । মানে স্ত্রীর মালিক হল তার স্বামী। এটা তো গেল একটা সামাজিক ম্যানুপুলেশন উদাহরণ। আর একটা উদাহরণ দিচ্ছি, ধর্ষণ হলে ইজ্জত চলে যায় মেয়েটার! অথচ ইজ্জত যাবার কথা ছিল ধর্ষকদের! আবার এই সমাজে মেয়েদের ব্রার ফিতায় থাকে সম্মান, কোন ভাবে দেখলেই মেয়েদের সম্মান চলে যায়! আবার মেয়ে মানে কিন্তু মানুষ না মেয়ে মানে হল খাবার। আবার মেয়ে মানে নরম কোমল, ফুলের মত, আর ছেলে মানে বাঘের মত, ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত শক্তিশালী। এমন অসংখ্য তত্ত্ব এবং ধারনাগুলো সামাজিক ভাবে মেয়েদের মানসিকতা ম্যানুপুলেট করার অব্যর্থ অস্ত্র ।

এবার আসি পারিবারিক শিক্ষায়।

রান্নাটা মেয়েদের কাজ। মেয়েদের বুক ঢাকতে হয়, ছেলেদের না। মেয়েদের সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে, ছেলেদের না। ভাইয়েরা মাঠে ক্রিকেট খেলতে পারে, বোনেরা না। মাছের মাথা , মুরগির রান বাবার জন্য, মায়ের জন্য না। মা কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক। বাসার যাবতীয় বিল, বাড়ি ভাড়া, এসব কাজ শুধু বাবা ভাইয়ের। সম্পত্তির দুই ভাগ ভাই এর, এক ভাগ বোনের। বোন বোরখা পরবে, ভাই না। এই শিক্ষায় বেড়ে ওঠা মেয়েটা কি করে নিজেকে একজন পূর্ণ মানুষ ভাবতে শিখবে ?

এই মানসিকতা পাকাপোক্ত করতে শেষ পেরেকটা ঠুকে, আমাদের ধর্মজীবীরা। কীভাবে? বলছি শুনুন। গত কয়দিন ধরে দেখলাম একটা হাদিস খুব প্রচার হচ্ছে তার আগে বলে নেই , একজন নারীর জীবনে তার স্বামী কে নিয়ে সব চেয়ে বেশি ভয়ের বিষয় হল, তার স্বামীটি অন্য নারীর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। মেয়েরা এই বিষয়টা একদম মানতে পারে না। আর এই ভয়টাকে কাজে লাগিয়ে নারীর মানসিকতা নিয়ন্ত্রণ করা হয় এই ধরণের হাদিসগুলো দিয়ে-

''যখনই কোনো স্ত্রীলোক দুনিয়াতে তার স্বামীকে কষ্ট দেয়, তখনই জান্নাতের ওই স্বামীর জন্য নির্ধারিত হুর বলতে থাকেন, হে নারী! তুমি তাকে কষ্ট দিও না। আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন! তিনি তো তোমার কাছে (কয়েক দিনের) মেহমান। অচিরেই তিনি তোমাকে ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসবেন। (তিরমিযী শরীফ, হাদিস নং-১১৭৪)''

খেয়াল করে দেখেন, হুরেদের সাথে স্ত্রীর কম্পিটিশন করিয়ে দেয়া হচ্ছে এখানে! এখানে স্বামী তো বন্ধু না, প্রভু আর প্রভু কেই একমাত্র কষ্ট দেয়া যায় না, কিন্তু বন্ধু কে যায়, রাগ অভিমান করা যায়, এক সাথে পথ চলতে গিয়ে কষ্ট দেয়া নেয়া টাইপের স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখা যায়, কিন্তু প্রভুকে শুধুই খুশি রাখতে হয়, তার দেয়া সব কিছু মেনে নিতে হয়। এখন যদি স্ত্রী তার স্বামীকে প্রভু হিসেবে মেনে না নেয়, তাহলেই হুর, মানে স্বামীর জন্য বরাদ্দ বেশ্যারা তাকে অভিশাপ দেবে!

কি ধরণের নোংরা কৌশলে একটা মেয়েকে স্বামীর বন্ধু হবার বদলে, দাসী বানিয়ে ফেলা হয়। অথচ এখানে সম্পর্ক হচ্ছে দুটো মানুষের মধ্যে, তাদের মধ্যে ভালোবাসা থাকবে, বোঝাপড়া থাকবে, সম্মান থাকবে, কষ্ট পাওয়া না পাওয়ার জন্য দু পক্ষের আলোচনা থাকবে অথচ সেখানে স্বামীকে দেখানো হচ্ছে বেশ্যাদের লোভ আর স্ত্রী কে দেখানো হচ্ছে ভয় ! আর এই ভয় এর কারনে স্ত্রী শত নির্যাতনেও কখনো প্রতিবাদ করবে না।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা