করোনার বিরুদ্ধে জিততে হলে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে ডাক্তার আর নার্সদের। দেশের এই সংকটময় মুহুর্তে ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল স্টাফ এই মানুষগুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র ঘৃণা ছড়াতে আমি রাজি নই।

কোন চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করছেন না সেই আলাপ পরে করেন। আগে বলেন যে যে চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের জন্য কী করছি আমরা? অন্যদের কথা বাদ দিলাম যেই ডাক্তার বা নার্সরা করোনা রোগী সামলাচ্ছেন দিন রাত তাদের জন্য কী করেছি আমরা? আপনারা কি জানেন এই ডাক্তার-নার্সদের খাওয়াটাও ঠিক মতো জুটছে না।

আমরা সবাই এখন জানি কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা শুরু থেকেই করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। করোনা একজনের কাছ থেকে আরেক জনের মধ্যে ছড়ায়। তাই যে চিকিৎসক বা নার্সরা সরাসরি রোগীদের সেবা দিচ্ছেন,তারা দায়িত্ব পালন শেষে সাধারণত বাড়িতে ফেরেন না। তাদের অনেকে থাকছেন একটি হোটেলে। সেখানেই তারা খাবার কষ্টে পড়েন।

শুনে অবাক হবেন, ওই হোটেলের রাঁধুনি ও ৩৬ জন স্টাফ সবাই পালিয়ে গেছে। তারা যে শুধু নিজে ভয় পেয়ে পালিয়েছে তাই নয়, আশপাশের মানুষজন তাদের ভয় দেখিয়েছে। বলেছে ডাক্তারদের জন্য রান্না করছো তোমরা আক্রান্ত হতে পারো। এসব কথা শুনে ভয় পেয়ে তারা পালিয়ে যায়। শুরু হয় ডাক্তার-নার্সদের খাবার কষ্ট। না খবরটা গোপন ছিল না। বিবিসির সহ দেশের অনেক গণমাধ্যমে খবরটি এসেছে।

কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালের নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া এক চিকিৎসক কয়েকদিন আগে বিবিসিকে বলেন, প্রায় তিনদিন খাবারের কষ্ট করার পর একদিন অনলাইনে তারা একটি পোস্ট দেখতে পান। ওই পোস্টে বলা হয়, চিকিৎসকদের স্বেচ্ছাসেবী একটি দল ঢাকা শহরের মধ্যে অবস্থানরত যেকোনো চিকিৎসকের জন্যে সুলভ মূল্যে খাবার সরবারহের ব্যবস্থা করছেন। এরপর অনলাইনেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা।

খুব অবাক হচ্ছেন তাই না? অথচ এটাই বাস্তবতা। এক চিকিৎসক বিবিসিকে বলেছেন, "একে তো আমরা হাসপাতালে অনেক চাপের মধ্যে কাজ করি, তার ওপর দিনের পর দিন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হয়না। এরপর হোটেলে ফিরে তিন বেলার সাধারণ খাবারটা যদি আপনি না পান, সেটা কতটা হতাশাজনক একটু ভাবেন‌। কেবল বিস্কুট আর পাউরুটি খেয়ে কত থাকা যায়?"

ভাবেন একবার। যেই ডাক্তার-নার্সরা এত কষ্ট করে সেবা দিচ্ছে তাদের খাবারের ব্যবস্থা টুকু করতে পারেনি আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। না রাষ্ট্র কোন ব্যবস্থা নেয়নি। স্বেচ্ছাসেবী এক ক্যাটারিং সার্ভিস তাদের খাবার সরবরাহ করেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল রাষ্ট্র কেন এই ডাক্তার-নার্সদের খাবারের ব্যবস্থাটুকু করবে না?

মানছি আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। মানছি পিপিই, মাস্কের সংকট। কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সদের ভালো খাবার ব্যবস্থা করা যায় না? ডাক্তার-নার্সদের যদি এই অবস্থা হয়, সেই হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের কী অবস্থা ভাবেন একবার? করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আমরা কি একেবারেই কম সময় পেয়েছি। অন্য অনেক দেশ কে কি করেছে ফ্রি আলাপ না হয় বাদ দিলাম। পাশের দেশ ভারতে তাকান।

ভারতের আইটিসি, ইন্ডিয়ান হোটেল সংস্থা, রেডিসন হোটেল, ইন্টারকন্টিনেন্টাল তারা সবাই বলেছে কলনার এই সময় যেকোন ডাক্তার নার্স চাইলে তাদের হোটেলে থাকতে পারবেন। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। শুনে অবাক হবেন ভারতের কোয়ারান্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে এই হোটেলগুলোতে। আর আমরা সারা ঢাকা শহর খুঁজে একটা জায়গা পাই না। আমি আগেও বলেছি ঢাকার একটা ঢাকার একটা দুটো খুব ভালো মানের হোটেল নেয়া যেতে পারত কোয়ারান্টিনে জন্য। প্রয়োজনে যিনি থাকবেন তার কাছ থেকে টাকা নেওয়া হতো।

ডাক্তারদের বিষয়ে আবার ফিরি। শুনলাম দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানানোয় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ছয়জন ডাক্তারকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত দুজন বলেছেন, তারা নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন। এই দুজনকে বহিষ্কার কারণ কী? আচ্ছা দায়িত্বে অবহেলার জন্য যদি ডাক্তারদের বহিষ্কার হতে হয়, তাহলে তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত? যারা যারা বলেছিলেন উন্নত বিশ্বের চেয়েও ভালো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া উচিত?

না আমি বলছি না, যে আমাদের দেশের সব ডাক্তাররাই ভালো। বলছি না সবাই খুব আন্তরিক। কিন্তু ভাবুন তো একটা দেশের নীতিনির্ধারকেরা খারাপ হবেন, সব পেশার খারাপ মানুষ থাকবে, আর সেখানে ডাক্তাররা সব ভালো হয়ে যাবে? এই দেশের সব পেশা যেমন ভালো-মন্দ রয়েছে চিকিৎসার ক্ষেত্রেও তাই।

আর এই দেশে যদি খারাপ ডাক্তার থেকে থাকে, ডাক্তাররা দায়িত্ব পালনে যদি আগ্রহী না হয়, তাদের মধ্যে অসৎ লোক থেকে থাকে, সেই দায়িত্ব শুধু ডাক্তারদের একার নয়। সে দায়িত্ব চিকিৎসকদের নেতাদের, সে দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। সে দায়িত্ব চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থার। সে দায়িত্ব গোটা রাষ্ট্রের।

এখন না হয়, খারাপের কথা বাদ দেন, যারা ভালো কাজ করছে, যারা রোগীদের সেবা দিচ্ছে, যারা করানোর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সেই মানুষগুলোকে তো আমাদের শ্রদ্ধা জানাতে হবে। গতকাল এক ডাক্তারের লেখায় পড়ছিলাম কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান সাজ্জাদ হোসেন মাসুমের কথা যারা সামনে থেকে এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

শুধু ডাক্তার কেন বলছি, নার্স, মেডিকেল স্টাফ প্রত্যেক এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ। শুনে অবাক হবেন কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নার্সদের খাবারের কষ্ট ভয়াবহ। গতকাল নাকি তাদের পচা খাবার খেতে হয়েছে। অনেকেই না খেয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। এগুলো চরম অব্যবস্থাপনা ছাড়া আর কী?

মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সব দেশে করোনা মোকাবেলায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডাক্তাররা। হ্যাঁ, আমাদের সেনাবাহিনী, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, স্বেচ্ছাসেবকসহ অনেকেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। অসাধারণ কাজ করছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে করোনার বিরুদ্ধে জিততে হলে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে ডাক্তার আর নার্সদের।

কাজেই তাদের পাশে থাকতে হবে। তাদের যে কোনো সঙ্কট অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে। শুধু আপনাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ এই সংকটময় মুহুর্তে কোন রোগীকে যেন বিনা চিকিৎসায় বাড়ি ফিরতে না হয়। আমি বিশ্বাস করি আপনাদের একটু সেবা পেলে অনেক মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে। আপনারা এটুকু নিশ্চিত করুন।

দেশের এই সংকটময় মুহুর্তে ডাক্তার নার্স মেডিকেল স্টাফ এই মানুষগুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র ঘৃণা ছড়াতে আমি রাজি নই। বরং করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের ডাক্তার নার্স মেডিকেল স্টাফসহ যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের প্রত্যেকের জন্য শ্রদ্ধা। আমি বিশ্বাস করি আপনাদের আন্তরিক লড়াই আর আমাদের সবার দায়িত্বশীলতায় করোনায় বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা জিততে পারবো। আল্লাহ আমাদের রহম করুন। 

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা