দুটো মানুষ যদি একসাথে ভালো না থাকতে পারে, কিংবা একসাথে থাকতে না চায়- ডিভোর্স সেখানে সবচেয়ে সভ্য সমাধান। হ্যাঁ। ডিভোর্স সমস্যা নয়, দুটো মানুষ এবং দুটো পরিবারের সমস্যার সমাধান
নওরীন পল্লবী:
(১)
আমার বাসা থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে একটা বস্তি আছে। সেখানকার একটা পরিবারের কথা বলি। সংসারে দুজন মানুষ। বর-বউ। মেয়েটার বয়স ১৪/১৫ হবে। মেয়েটাকে প্রায়দিনই মার খেতে হত। ধরেন তরকারিতে একটু লবণ কম, কিংবা রান্না হতে একটু দেরী হয়েছে। ব্যাস! মার শুরু। মারার সময় কখনো কখনো বারান্দার খুঁটিতে হাত বেঁধে রাখতো। মেয়েটা কাঁদতো, মেয়েটা মুক্তি পেতে চাইতো। কিন্তু আপনাদের ভদ্রপল্লীর চোখরাঙানি উপেক্ষা করার সাহস তার ছিল না। আজ মেয়েটা বাসায় এলো অনেকদিন পর। ডিভোর্স নিয়েছে বছর দু'য়েক আগে। এখন সে মানুষের বাসায় কাজ করে। নিজের মত বাঁচে।
(২)
বস্তির আরেকটা পরিবার। স্বামী-স্ত্রী আর ছোট ছোট দুটো ছেলে। এই লোকটা মারপিট করে না। কিন্তু মাদকাসক্ত। মেয়েটা ৪-৫বাসায় কাজ করতো, অত্যন্ত বিনয়ী। যা রোজগার করতো, পুরোটাই দিতে হত স্বামীর হাতে। না দিলেই ডিভোর্স দেওয়ার হুমকি দিত। ছেলেগুলোকে কাজে দিতে চাইতো, মেয়েটার ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করানোর। একদিন মেয়েটা সাহস করে নিজেই ডিভোর্স দিয়ে দিলো। বাচ্চাগুলো এখন স্কুলে পড়ে। বাবা কোনো ভরনপোষণ দেয় না। হোক পরিশ্রম, ওরা সুখে আছে।
(৩)
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আমার স্কুলের শিক্ষক। আবার প্রতিবেশীও। দুজন একই সমান পরিশ্রম করে বাইরে, কিন্তু ঘরে এসে সব কাজগুলো একা হাতে সামলাতে হয় ম্যামকে। এভাবেই চলছিল। বছর দু'য়েক আগে স্যার পরকিয়া শুরু করলেন। মধ্যবিত্তের ঘরের পরকিয়া শেষ পর্যন্ত পরকিয়া থাকে না, নারী নির্যাতনে রূপ নেয়। ওনার সাথেও তাই হল। একদিন মেরে মাথা ফাটিয়ে দিলো ম্যামের। ম্যাম ডিভোর্স নিলেন, আরও আগেই চেয়েছিলেন, লোক-লজ্জ্বার ভয়ে দেরি করছিলেন। ওনার মেয়ে এখন নার্সিংয়ে পড়ে। খরচ একাই চালান। ওরা মা-মেয়ে ভালো আছে। সম্ভবত স্যারও!
(৪)
আমার কাজিন। পরিবারের বড় মেয়ে। বিয়েটা বেশ ধুমধাম করেই হয়েছিল। বিয়ের পর জানতে পারলো দুলাভাই ঢাকায় লিভটুগেদার করে বান্ধবীর সাথে। বাড়িওয়ালা জানে স্বামী-স্ত্রী! সবাই বললো ডিভোর্স করতে। আপু সময় নিচ্ছিল, যদি পাল্টায় মানুষটা! ভালোবাসতো খুব। শেষ অবধি কিছুই বদলায় নি। ডিভোর্স হল। আপু এখন হাইস্কুলে চাকুরি করেন। বিয়ের পর সবাই বলেছিল, জামাই ভালো চাকুরি করে, তোমার আর পড়ার দরকার কী! ভাগ্যিস এসবে কান দেন নি! আপু এখন ভালো আছেন।
(৫)
আমার প্রতিবেশীর ছেলের বউ। মাসে অন্তত দুবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। মানসিক নির্যাতন সবসময়ের সঙ্গী। মেয়ে মুক্তি চায়, মেয়ে ডিভোর্স চায়। মেয়ের পরিবার ধৈর্য্য ধরতে বলে। ওরা ডিভোর্স চায় না। মেয়েটা ভীতু। পরিবার, সমাজ, সন্তানের কথা চিন্তা করে মাটি কামড়ে পড়ে আছে। প্রথমত যাওয়ার জায়গা নেই, দ্বিতীয়ত সে স্বাবলম্বী না। ওর সংসারটা টিকে আছে।
আমার জানামতে এমন অসংখ্য পরিবার আছে, যেখানে ডিভোর্সই একমাত্র সমাধান। হয় পেটের দায়ে, নয়তো সমাজের চোখ রাঙ্গানির ভয়ে মেয়েরা এই সংসারগুলো করে যাচ্ছে। কখনো নিছক মায়ায়, কখনওবা সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে। কেউ শারীরিক নির্যাতন সইছে, কেউ মানসিক, কেউ আবার দুটোই। কিছু পরিবারে ছেলেরাও নির্যাতনের শিকার। শারীরিক না হোক, মানসিক অন্তত। সংখ্যায় কম বলে এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে পার্থক্য এটুুকু যে, তারা স্বাবলম্বী, মুক্ত হওয়া তাদের জীবিকার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। ডিভোর্সের পর সমাজ তাদের হেনস্তা করে না, নারীকে যতটা করে। তবে একপাক্ষিক আইনের জটিলতা অন্য কোনো সময় আলোচনা করা যেতে পারে।
দুটো মানুষ যদি একসাথে ভালো না থাকতে পারে, কিংবা একসাথে থাকতে না চায়- ডিভোর্স সেখানে সবচেয়ে সভ্য সমাধান। হ্যাঁ। ডিভোর্স সমস্যা নয়। ডিভোর্স দুটো মানুষ এবং দুটো পরিবারের সমস্যার সমাধান। আপনারা হয়তো সন্তানাদির সমস্যার কথা বলবেন। আমি মনে করি, বাবা-মায়ের অশান্তির মাঝে বেড়ে ওঠার চেয়ে সিঙ্গেল মাদার/ফাদারের কাছে বেড়ে উঠতেই শিশুরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সুস্থ্য মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়।
মাঝেমাঝে পত্রিকায় দেখি অমুক সেকেন্ডে তমুক লক্ষকোটি ডিভোর্স হয়েছে। আমি উদ্বিগ্ন হই না। ডিভোর্সকে আমি পজেটিভভাবেই দেখি। ডিভোর্স হওয়া সহজ নয়। সমস্যা চরম মাত্রার না হলে ডিভোর্স হয় না। অন্তত বাংলাদেশে না। আমি বিশ্বাস করি না।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন