এই যে আপনি একজনের বিচ্ছেদের খবর শুনে নিউজফিড গরম করে ফেলছেন, ট্রল করছেন, বিমলানন্দ পাচ্ছেন, ওই মানুষ দুটো কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করেছেন একবার? আপনাদের কি মনে হয়, একটা সম্পর্ক শেষ করে যারা আলাদা হয়, তারা খুব খুশিমনে কাজটা করে?

“Life is far too short to spend it immersed in an unhealthy relationship.”

জীবন খুবই ছোট, এই সংক্ষিপ্ত জীবনের বড় একটা সময় আমাদের চলে যায় মানিয়ে চলতে। সমাজের সাথে মানিয়ে চলা, বন্ধুবান্ধবদের সাথে মানিয়ে চলা, প্রেমিকার সাথে মানিয়ে চলা, জীবনসঙ্গীর সাথে মানিয়ে চলা - এভাবেই কেটে যায় একেকটা সংক্ষিপ্ত জীবন।

কিন্তু কখনো কখনো এমন হয় যে, মনের বিরুদ্ধে আর মানিয়ে চলা যায় না। দূর থেকে যা ভাল কাছে আসলেই তার নানানরকম খুঁত চোখে পড়তে থাকে। যে বন্ধুটির সাথে প্রতিনিয়ত আমাদের দেখা হয়, তার অনেক অভ্যাস বদঅভ্যাসের গল্পই আমাদের জানা থাকে। প্রথম দিকে অনেক কিছু হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে এড়িয়ে যাওয়াই যায়, পরের দিকে গিয়ে কখনো আপনার বন্ধুর বাজে কোনো অভ্যাস, কোনো আচরণ আপনার কাছে বিরক্তির ঠেকতেই পারে। ফলে যেটা হয় যে আড্ডায় আপনি আগে ছয় দিন যেতেন এখন সেখানে দুই-তিন দিন যান বড়জোর। গেলেও বেশিক্ষণ কাটান না। কাছের মানুষদের কুৎসিত রুপ একবার ধরা পড়ে গেলে সম্পর্কগুলো মনের বিরুদ্ধে টেনে নেয়া কঠিন। বিবাহিত জীবনের ক্ষেত্রেও এই কথা কারো কারো জন্য ভীষণভাবে সত্য। 

সবার বিবাহিত জীবন যে সুন্দর হয় তা তো না। বাইরে থেকে দেখলে প্রত্যেকটা বাড়িকেই একরকম মনে হয়, একইরকম জানালা, একই রকম দরজা, একই রকমের বেলকনিতে ঝুলে থাকা হলুদ রঙয়ের জামা আর চেক লুঙ্গি। কিন্তু আপনি কখনোই জানবেন না বাড়িগুলোর ভেতরের চেহারা কি। যে দম্পতিকে আপনি রাস্তায় দেখছেন পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে, আপনি হয়ত টেরও পাবেন না নিজেদের ভুবনে তারা কি ভয়ানক একা, একই ছাদের তলায় থেকেও আলাদা, একই গ্রহের নিয়মের আবর্তে জড়িয়ে কি করুণ নিয়মরক্ষার জীবনে তারা অভ্যস্থ। আপনি কখনোই জানবেন না। আমরা খুব সহজেই কেন যেন মানুষকে বিচার করে ফেলি। আমরা কেন যেন শুধু মানুষের সিদ্ধান্তগুলোকেই মনে রাখি। কখনো ভেবেই দেখা হয় না সিদ্ধান্তগুলোর পেছনের গল্প। 

কিছুদিন আগেই প্রথম আলোর লিড নিউজ ছিল বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে। ঢাকায় প্রতি ঘন্টায় অন্তত একটি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে। আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে দিনে গড়ে ১৪ টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। প্রতিবেদনে বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, মেয়েদের বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলো হলো- যৌতুকের জন্য নির্যাতন, অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক বা দ্বিতীয় বিয়ে, মতের বনিবনা না হওয়া, শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্ব, স্বামীর মাদকাসক্তি। আর ছেলেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্য পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক, সংসারে মানিয়ে না চলা, স্বামীর কথা না শোনা। 

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটা প্রভাবও থাকে এখনকার বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাগুলোতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রিয় মানুষটা কার সাথে কিরকম যোগাযোগ রাখছে, কি কথা বলছে এসব জানার একটা অনেকের মধ্যেই থাকে। কারো কারোটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে সন্দেহবাতিকগ্রস্থ হয়ে পড়ে সে। এছাড়া নিউজফিডে বিভিন্ন মানুষের জীবনের হালছাল, এডিট করা হাসি হাসি মুখের ছবি দেখতে দেখতে মানুষগুলো ভাবে সে বোধহয় খুব সুখে নাই। কারণ, জীবন সম্পর্কে তার একটা অদ্ভুত এক্সপেকটেশন তৈরি হয়, অন্যের ভালবাসার ছবি, গল্প দেখে সে এইকইরকমের ব্যাপার নিজের জীবনেও ঘটুক এমন একটা আশা পোষণ করে অবচেতন মনে। ফলে নিজের জীবনের সম্পর্কগুলোতে সে একধরণের হীনমন্যতায় ভুগে।

ডিভোর্স কেউ শখ করে নেয় না, নিতে বাধ্য হয়

এছাড়া এই সময়ের ডিভোর্সের আরেকটি অন্যতম কারণ বলা হয়েছে- নারীরা আগের চেয়ে শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, ফলে তারা আগের চেয়ে বেশি অধিকারবোধ সম্পর্কে সচেতন, তারা শুধু তথাকথিত স্ত্রী হয়েই থাকতে চান না, সংসারে সিদ্ধান্তগুলোতেও ভূমিকা রাখতে চান। 

একদম স্পষ্ট করে যদি বলি, বিবাহবিচ্ছেদের এই পরিসংখ্যান কোনোভাবেই ইতিবাচক কোনো খবর নয় আমাদের জন্য। অন্তত আমরা যারা একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছি, সম্পর্ককেন্দ্রিক মূল্যবোধ আমাদের মাঝে বেশ গভীরই। এই ধরণের সংবাদ আমাদের বিচলিত করে। তবে বিবাহবিচ্ছেদকে সমাজের প্রচলিত যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটিও আমাদের বিচলিত করে। 

বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার পর নারীদের উপর বেশি প্রভাব পড়ে। নারীদের বাঁকা চোখেই দেখা হয়। একজন নারী বিবাহবিচ্ছেদের পর সামাজিকভাবে খানিকটা কোনঠাসাই হয়ে পড়েন, এমনকি নিজের পরিবারের কাছেও হতে হয় অপরাধী। কিন্তু, খেয়াল করে দেখবেন, নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের কারণগুলো কি? নারী স্বাবলম্বী হচ্ছে এটি স্বামীর মেনে নিতে না পারা, যৌতুক, নির্যাতন, স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, মাদকাসক্তি। এখানে মেয়েটির কি করবার থাকে, শুধুই দিনের পর দিন মেনে নেয়া ছাড়া? যত যা-ই হোক, বাঙ্গালি নারীরা খুব সহজে ভাঙ্গণ চায় না। কতটা বাজে অবস্থায় পড়লে নারীকে বিচ্ছেদে যেতে হয় সেটি অনেকেই অনুধাবন না করেই তাকে অপরাধী করে ফেলতে চান। 

একই রকম অবস্থায় পড়তে হতে পারে একটি পুরুষকেও। পারিবারিক টানাপোড়েন যদি এমন অবস্থায় পৌঁছায় যখন সে বুঝতে পারে একসাথে থাকাটা সমস্যা কমাচ্ছে না, বরং বাড়াচ্ছে তখন জোর করে সম্পর্ক আরো তিতকুটে না করে সে যদি বিচ্ছেদে যায় তাহলে সেটাকে বাঁকা চোখে দেখার সুযোগ কোথায়?, হ্যাঁ, এটা ঠিক বিবাহবিচ্ছেদের ফলে সন্তানের উপর তার একটা নেতিবাচক প্রভাব তো পড়েই। তবে কোনো দাম্পত্য সম্পর্ক যদি খারাপ হয় এবং সেই অবস্থায় দিনের পর দিন চলতে থাকে সেইসব পরিবারের সন্তানদের উপরও ভীষণভাবে মানসিক চাপ পড়ে। পরিবারের বাবা-মায়ের সমস্যা ভুলে থাকতে অনেক ঘরের সন্তানেরাই মাদকাসক্তি কিংবা বাইরের জগতে বেশি সময় দিতে শুরু করে। আপনার আশেপাশেই এমন ছেলেমেয়ে চোখে পড়বে। এটাকে অস্বীকার করবেন কি করে? 

শখ করে কেউ বিচ্ছেদ চায় না। আমরা কেউই বিবাহবিচ্ছেদ সমর্থন করি না এটাও সত্য। কিন্তু, তার মানে কি এই, কোনো নারী স্বাবলম্বী হতে চায়, নিজের মত প্রকাশ করতে চায় এবং পরিবার থেকে সেটা মেনে নেয়া না হয়- সেটাকে সমর্থন করব? একটি নারী যৌতুকের কারণে দিনের পর দিন নির্যাতিত হবে, মাতাল হয়ে স্বামী তাকে আঘাত করবে এবং সে এটা মুখ বুঝে মেনে নিবে আমরা কি সেটাকেই মেনে নিব? কিংবা কোনো পুরুষ স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ নিয়ে দিনের পর দিন সম্পর্ক টেনে নিয়ে একটা অস্বাভাবিক জীবন পার করবে শুধু সমাজ কি ভাববে এই ভয়ে সেটাও কি ঠিক হবে? 

কোনো পরিবারের কারো বিচ্ছেদ হলে সেই পরিবারের সন্তানেরা বাইরে এই কথা কারো সাথে বলতে পারে না। সম্পর্কবিচ্ছেদের ফলে সন্তানের উপর যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় সেটা আসলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরই ফলাফল। যে ছেলেটা ব্রোকেন ফ্যামিলি থেকে আসে তাকে সবাই একটু অন্যচোখে দেখে, কেউ কেউ আবার বোকার মতো পারিবারিক প্রশ্ন করে বিব্রত করতে সুখ পায়। 

আবার নারীদের ক্ষেত্রেও একই রকম, বিচ্ছেদের ফলে তাকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। তাকে কিছু হেলাফেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়। নতুন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো নারীর অতীতে বিচ্ছেদের কথা যদি জানাজানি হয় সমাজ মেনে নিয়ে চায় না। ভাবটা অনেকটা এরকম যে, এই মেয়ে কুমারী না, তার চরিত্র ভাল না, তার চলাফেরা ভাল না ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে হলো, মানসিক চাপটা কিন্তু সমাজেরই তৈরি। সমাজই আসলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বাধা হয় পদে পদে। আমরা যারা বিচ্ছেদ নিয়ে খুব আশংকা প্রকাশ করছি, আমাদের নিজেদের কাছে আসলে আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত, আমরা নিজেরা আসলে সম্পর্কগুলোর প্রতি কতটা সৎ? 

প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজেদের খুঁজতে হবে। নিজেদের প্রয়োজনেই। কারণ, পৃথিবী খুবই জটিল। অনেক মানুষ ভালবাসা-বাসি করে, প্রেমময় সম্পর্ক নিয়ে স্বপ্ন দেখে কিন্তু তাদের কখনোই একটা ছাদের নিচে থাকা হয় না। একই আকাশের নিচে দুইটা মানুষের অসীম ভালবাসার সম্পর্ক সমাজের বিভিন্ন বোধের বেড়াজালে আটকে পূর্ণতা পায় না বলে তাদের একই ছাদের তলায় থাকা হয় না। আবার কেউ কেউ ভাগ্যবান, তারা একই ছাদের নিচে আসতে পারে ঠিকই, তবে কোথাও কোথাও ভালবাসাটার ঘাটতি পড়ে যায়। ভালবাসাহীন সম্পর্ক ঝুলে থাকে একটা কাগজের বিশ্বাসে, কেউ কাউকে মেনে নিতে পারছে না, ছেঁড়ে যেতেও পারছে না। হায়! বিচ্ছেদের ব্যাথার রঙ কি তবে ক্ষণে ক্ষণে বদলায়! কখনো কখনো বিচ্ছেদই শুদ্ধতম প্রণয়ের আগমণবার্তা? কে জানে!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা