দীপু মনি: রাজনীতির অন্ধকার জগতে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ওয়ার্ড লেভেলের পাতি নেতাদের ক্ষমতার দম্ভে যেখানে টেকা যায় না, সেখানে মন্ত্রী হয়েও দীপু মনি বাজারের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, একা একা বিদ্যানন্দে চলে যাচ্ছেন, স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ দেখছেন, রান্নাঘরে ঢুকে পড়ছেন...
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গতকাল বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনে গিয়েছিলেন। স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটিয়েছেন, তাদের কাজকর্ম দেখেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, চলে আসার আগে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী দান করে এসেছেন, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে বিশাল যুদ্ধে বিদ্যানন্দ লড়ছে, তাতে শামিল হবার সামান্য চেষ্টা করেছেন তিনি। স্বেচ্ছাসেবকরা তাকে পেয়ে ছবি তুলতে চেয়েছিল, তিনি প্রথমে রাজী হননি, প্রকাশ্যে আনতে চাননি নিজের অবদানের কথা। পরে তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন, অক্লান্ত এই যোদ্ধাদের অনুরোধ ফেলতে পারেননি।
বিদ্যানন্দের ফেসবুক পেজ থেকেই বলা হয়েছে দীপু মনির এই আচমকা সফরের গল্পটা। বিদ্যানন্দের ঢাকা ব্রাঞ্চে একাই এসেছিলেন তিনি, সঙ্গে প্রটোকল অনুযায়ী নিরাপত্তার বহর ছিল না। নিজের বাড়িতে যেভাবে ঘোরাফেরা করে সবাই, সেভাবেই ঘুরে বেড়িয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী, প্রত্যক্ষ করেছেন আয়োজনের বিশালতা। নারীসুলভ চপলতাকে সঙ্গী করে পৌঁছে গেছেন বিদ্যানন্দের রান্নাঘরে, যেখানে রান্না করা হচ্ছিল অসহায় মানুষের জন্যে। সেই খাবার প্যাকিং হয়ে চলে যাবে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে, করোনার প্রকোপে দুর্গত অসহায় মানুষ, যাদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে, তারা পেট ভরাবেন এসব খাবারে।
ফেসবুকে ছবিগুলো দেখলাম। রান্নাঘরে উঁকি দিচ্ছেন শিক্ষামন্ত্রী, চোখে চশমা, মুখে মাস্ক, পরনে আটপৌরে একটা শাড়ি। পেছনে সৈন্য-সান্ত্রীরা নেই, মিডিয়ার ক্যামেরার ঝলক নেই। বিয়ের পর মেয়েরা নতুন নতুন বাবার বাড়ি এলে যেমন কৌতুহল নিয়ে বদলে যাওয়া পরিবেশটা দেখে, সেরকমই যেন বিদ্যানন্দে ঘুরে দেখছেন শিক্ষামন্ত্রী, যেন এটা তারই ঘর, তিনি দূরের কেউ নন। বিদ্যানন্দেরই কোন স্বেচ্ছাসেবী হয়তো দূর থেকে ক্যামেরাবন্দী করেছেন মুহূর্তগুলোকে।
বিদায় নেয়ার আগে বিদ্যানন্দের ফান্ডে দান করেছেন মন্ত্রী। স্বেচ্ছাসেবীরা এসে দীপু মনির সঙ্গে ছবি তুলতে চেয়েছেন। রোজ রোজ তো আর মন্ত্রীর দেখা পান না তারা। তাছাড়া তরুণ প্রজন্মের কাছে দীপু মনি ভীষণ প্রিয় একজন মানুষ। শুরুতে অবশ্য তিনি রাজী হননি। এমনিতেই দীপু মনি প্রচারবিমুখ মানুষ, তার বিদ্যানন্দে আসা বা দান করা নিয়েও খবর হোক- এটা তিনি চাননি হয়তো। পরে স্বেচ্চাসেবকদের ক্লান্ত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে মায়া হয়েছে তার, পরিবার-পরিজন ফেলে যে ছেলে-মেয়েগুলো পড়ে আছেন মানুষকে সাহায্য করবে বলে, তাদের সঙ্গে হাসিমুখেই তিনি ছবি তুলেছেন, পূরণ করেছেন তাদের আবদার। তারপর বিদায় নিয়েছেন।
দানের নামে প্রচারণার আসর বসাতে দেখেছি অজস্র মানুষকে। তাদের মধ্যে রাজনীতিবিদও আছেন। দীপু মনি রাজনীতিবিদ হয়েও সেই স্রোতে গা ভাসাননি। বরাবরই নিজেকে পঙ্কিলের বাইরে রেখেছেন। কিছুদিন আগে মীনা বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন তিনি। সরকারের একজন মন্ত্রী, তিনি আদেশ দিলে মীনা বাজার থেকে তার বাসায় জিনিসপত্র দিয়ে যাওয়ার কথা। অথচ সেটা না করে তিনি নিজে বাজার করতে গেছেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে বাইরে লাইনে দাঁড়িয়েছেন, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একজন একজন করে ঢোকানো হচ্ছিল সেখানে, দীপু মনি অপেক্ষা করেছেন, সিরিয়াল ভাঙেননি।
চাইলেই তিনি পাওয়ার প্র্যাকটিস করতে পারতেন, এটা কোন ব্যাপারই ছিল না তার জন্যে। মীনা বাজার কর্তৃপক্ষও এসে তাকে বলেছে, তাকে লাইনে দাঁড়াতে হবে না, তিনি যেন ভেতরে চলে আসেন। দীপু মনি তাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন, তার আগে এসে যে মানুষগুলো লাইনে দাঁড়িয়েছেন, অপেক্ষা করছেন, তাদের আগে গিয়ে তিনি তাদের ওপর অবিচার করতে চাননি। সভ্য সমাজে এটাই নিয়ম। কিন্ত বাংলাদেশের কয়টা এমপি-মন্ত্রী এটা মানেন? এত ওপরে যাওয়ার দরকার নেই, সামান্য ওয়ার্ড এলাকায় আঁতি-পাতি নেতাদের ক্ষমতার দাপটেই তো বাংলাদেশের মানুষ অতিষ্ট হয়ে যায়! সেখানেই দীপু মনি উজ্জ্বল এক ব্যতিক্রম।
তিনশো জন সাংসদের বিশাল বহর, মন্ত্রীসভার কেবিনেটটাও ছোটখাটো নয়। এর বাইরে সংরক্ষিত আসনের এমপিরা আছেন। আছেন সিটি কর্পোরেশনের মেয়ররা, যাদের কারো কারো পদমর্যাদা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সমান। যদি প্রশ্ন করা হয়, এত এত জনপ্রতিনিধির মধ্যে সবচেয়ে সেন্সিবল আর সৎ মানুষের সন্ধান করা হয়, সেখানে দীপু মনিকে পাওয়া যাবে সবার আগে। শিক্ষিত, মার্জিত আর রুচিশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই ভদ্রমহিলাকে উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যতিক্রম বলেই মনে হবে যে কারো কাছে। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার প্রথম বছরেই তিনি প্রশ্নফাঁসের লাগাম টেনে ধরেছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সমুদ্রজয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বরাবরই তিনি নিজেকে প্রচারের আলোর বাইরে রেখেছেন। খবরের শিরোনাম হবার জন্য বিতর্কিত বক্তব্য দেননি, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে বিরোধী দলকে অযথা দোষারোপ করেননি। রাজনৈতিক শিষ্টাচার কি জিনিস, সেটা তাকে দেখেই শেখা যায়। দীপু মনির মতো অল্প কয়েকজন মানুষ আছেন বলেই হয়তো রাজনীতির এই নোংরা কাদার মধ্যেও পদ্মফুল ফোটে, আমাদের মৃতপ্রায় আশারা বেঁচে থাকে ধিকিধিকি করে। অন্ধকার স্টেশন প্ল্যাটফর্মে দীপু মনি যেন অনুপ্রেরণার ফুলকি নিয়ে এগিয়ে আসা ট্রেনের উজ্জ্বল কোন আলো, যে আলোয় উদ্ভাসিত হয় চারপাশ...