দীপনপুর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। করোনাকালীন বন্ধ হয়ে যাওয়া পরিচিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে সবার আগে দীপনপুরের নাম জানা গেল। কারণ এটি বইয়ের দোকান।

দীপনপুর কিন্তু শুধু এই তিন মাসের করোনার ধাক্কায় মরেনি। গত তিন বছর ধরে যুদ্ধ করে করে তার কোমড় এমনিতেই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছিলো। করোনার আঘাতে সেই কোমড় ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে গেছে। 

দীপনপুর বইয়ের দোকান। বই পড়ার জায়গা। শিল্পসাহিত্য সিনেমার আয়োজকও ছিল তারা। দীপনপুরে গিয়ে মানুষ আড্ডা দিত। একা বা গ্রুপ ধরে পড়ালেখা করত। চা নাস্তা খেত। বসে থাকতো। বাচ্চারা মা বাবার হাত ধরে বই কিনত, রঙপেন্সিল কিনত।

দীপনপুর টিকে নাই, কারণ বাঙালির জীবনে এখন বই সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। বই কেউ পড়ে না। যারা পড়ে, তাদের সংখ্যা এত কম যে সেটাতে ধর্তব্যে ধরে লাভ হয় না। 

আচ্ছা, পুরো ঢাকা শহরে কয়টা ভাল বইয়ের দোকান আছে?

শাহবাগের আজিজে আগে অসংখ্য বইয়ের দোকান, প্রকাশনা সংস্থার অফিস ও বই বিপনন কেন্দ্র ছিল। গত ১৫ বছরে সেই আজিজ শাড়ি জামা পাঞ্জাবী আর লেস ফিতার দোকান হয়েছে। বইয়ের দোকান চারটা না পাঁচটা। আজিজে গেলে হা করে তাকিয়ে থাকি! এও হয়? এও সম্ভব?!

আজিজে এখন বেশিরভাগই জামা-কাপড়ের দোকান  

উল্টোদিকে পাঠক সমাবেশ গড়ে উঠেছে। কনকর্ড আর্কেডিয়ায় সম্ভবত কিছু বইয়ের দোকান আছে। নিউমার্কেটে যুগ যুগ ধরে ৮/১০টা বইয়ের দোকান। এদের সংখ্যা বাড়ে না। বইয়ের ভ্যারাইটিও নাই। 

বাংলাবাজারে বই আছে। কিন্তু সেটি শহরের কেন্দ্র থেকে এত দূর যে সেখানে খুব কম মানুষ যেতে পারে। নীলক্ষেতে পাইরেটেড বই পাওয়া যায়। বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আছে, বাতিঘর আছে। 

জাহাঙ্গীর গেটের কাছে একটা বইয়ের দোকান ছিল। বুক ওর্ম। জানি না এখন আছে কি না। বেইলি রোডে কয়েকটা দোকান কোনমতে টিকে আছে। 

গুলশান বনানী বারিধারার দিকে সেকরম কোন বইয়ের দোকান নাই। আগে একটা দোকানে যেতাম ভাল ইংরেজি বইগুলো পাওয়া যেত, এখন সম্ভবত সেটা আর নাই।

পুরো ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, মোহম্মদপুর, মিরপুরের জন্য আছে সবেধন নীলমণি বেঙ্গল বুক। সেখানেও আজকাল বইয়ের চেয়ে ফটোশুটের ভিড় এত বেশি যে বইপাঠকের বসার জায়গা থাকে না। এছাড়া এসব এলাকায় আর কোন বইয়ের দোকান নাই।

বেঙ্গল বইয়ে ছবি তোলার জন্যই ভিড় বেশি হয়  

মোহম্মদপুরে চর্চা নামে একটি ভাল বইয়ের দোকান আছে। তবে সেটি এতই ভিতরের দিকে গলিতে যে অনেকেই এর কথা জানেন না, খুঁজে পাওয়াও বেশ শক্ত। তবু আছে, সেও অনেক। কতদিন থাকবে, জানি না। যাত্রাবাড়ি, বাসাবোতে তেমন কোন বইয়ের দোকান নাই। কি অবাক ঘটনা, তাই না?

একটা শহরে ৩/৪ কোটি মানুষ আছে। শিশু কিশোর তরুণ আছে। কিন্তু বই নাই। বই ছাড়া আর সবই আছে। কোটি কোটি মোবাইলের দোকান আছে। ইলেক্ট্রনিক গেজেট আছে। জামা শাড়ি জুতা পাঞ্জাবীর দোকানে প্রতিটা এলাকা গিজগিজ করে। পাড়ায় পাড়ায় ফার্নিচারের দোকান, পর্দা বিছানার চাদর, কুশান কাভারের দোকান। মানুষের ভিড় উপচে উপচে পড়ছে। কি নিদারুন এক শহর আর কি নিদারুন এক জাতি তৈরি হয়েছে, তাই না?

যে দেশ, যে শহর, যে সমাজ, যে রাষ্ট্র বইকে ভালোবাসতে ভুলে গেছে, বইকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছে, সেই দেশ সেই রাষ্ট্র, সেই জাতির আসলে শেষ পর্যন্ত কোন ঠিকানা নাই।

যে দেশে শিল্পের স্বার্থে দেয়া প্রনোদনা শিল্পপতির পেটে যায়, সেই দেশে প্রকাশনা শিল্পে প্রনোদনা আসলে আকাশকুসুমই। বই নিয়ে এ দেশ, এই সমাজের কোন মাথা ব্যথা নাই। নাই বলেই দীপনপুর প্রনোদনা পাবে না। প্রকাশকরা পাবে না। বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। নতুন কোন বইয়ের দোকান তৈরির প্রয়োজন দেখা দেবে না। কারণ কেই বা যাবে বইয়ের দোকানে? কেই বা কিনবে বই? কার এত দায় পড়েছে বই পড়ার? বই পড়ে কি পুঁজি ও পেটের কোন আয়তন বৃদ্ধি হয়? 

না, হয়না। এই দেশে বই পড়ুয়া মানুষের ভাত নেই। ভাত আছে তাদের, যারা বইয়ের দোকান তুলে দিয়ে সেই জায়গায় রঙবেঙয়ের শাড়ি জামার দোকান সাজায়, তাদের। 

আর কিছু নিয়েই কোন প্রত্যাশা রাখি না।

আপডেট: দীপনপুর এখনো বন্ধ হয়নি, বন্ধের পথে। আসুন সম্মিলিতভাবে এটি বন্ধ হয়ে যাওয়াটা ঠেকিয়ে দিই।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা