দিলারা জামান: অভিনয় যার বেঁচে থাকার অক্সিজেন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মেয়েরা রাগ করেন, কেন তিনি এই বয়সেও রাত পর্যন্ত কাজে ডুবে থাকবেন, এটা তো বিশ্রামের বয়স, নাতী-নাতনীদের নিয়ে অবসর সময় কাটানোর বয়স। দিলারা জামান হাসেন, জবাব দেন...
বাংলাদেশের জন্ম হয়নি তখনও, সময়কাল ১৯৬২-৬৩ সাল। ডাকসুতে মঞ্চ নাটক হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে। নির্দেশনা দেবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরী। প্রধান নারী চরিত্রের জন্যে এক ছাত্রীকে খুব মনে ধরলো তার, কিন্ত ছাত্রীর পরিবার একটু সঙ্কোচ করছিল, ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে নাটক করবে, লোকে কি বলবে! যে সময়টার কথা বলছি, তখন ঘর থেকে বেরিয়ে শিক্ষাদীক্ষা অর্জন কিংবা চাকুরীতে নারীদের অংশগ্রহনের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত, প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম, অফিস-আদালতে কোন মহিলাকে চাকুরী করতে দেখলেও চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হতো লোকজনের।
মুনীর চৌধুরী একটা চিঠি লিখলেন সেই ছাত্রীর বাবাকে। অনুরোধ করলেন, মেয়েটাকে যেন নাটকে অভিনয়ের অনুমতি দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গুণী শিক্ষক চিঠি লিখে অনুরোধ করছেন, ভদ্রলোকের কাছে এটা বিশাল একটা ব্যপার ছিল। তিনি আর অমত করলেন না। কার্জন হলে মঞ্চস্থ হওয়া 'মায়াবী প্রহর' নামের সেই নাটকে অভিনয় করেছিলেন ড. ইনামুল হক, আবদুল্লাহ আল মামুনের মতো ডাকসাইটে অভিনেতারা, ওরা তখনও ছাত্র। ওদের সঙ্গেই অভিনয় করেছিলেন বাংলা বিভাগের সেই ছাত্রী, নাম তার দিলারা জামান।
টেলিভিশনে তার আগমনটাও মুনীর চৌধুরীর হাত ধরেই। ১৯৬৬ সাল, তখন টেলিভিশনে নাটক সম্প্রচারিত হতো সরাসরি, আগে থেকে রেকর্ড করে রাখা হতো না। 'ত্রিধরা' নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন দিলারা জামান, তার মায়ের চরিত্রে ছিলেন মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী, আরও অভিনয় করেছিলেন বরেণ্য অভিনেতা আহসান আলী সিডনি। সেখান থেকেই শুরু, অভিনয়ের প্রতি অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করতো আগে থেকেই। মুনীর চৌধুরী তাঁকে বলেছিলেন- "এই মেয়ের জন্ম হয়েছে অভিনয়ের জন্যে।" তার অভিনীত প্রথম ধারাবাহিক নাটক ছিল 'সকাল-সন্ধ্যা'।
বিয়ে হয়েছিল রক্ষণশীল একটা পরিবারে, সংসারী এই মহিলা কিন্ত অভিনয়টা ছেড়ে দেননি একেবারে। রেডিওতে নাটক করতেন, ভয়ে থাকতেন, শ্বশুর যদি তার কন্ঠস্বর চিনে ফেলেন! তবে স্বামীর সমর্থন ছিল তাঁর কাজের ব্যাপারে, সেই সমর্থনেই দিলারা জামানের পথচলায় সাহস যুগিয়েছে নিরন্তর। তার জন্ম হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে, ১৯৪৩ সালে। কিছুদিন পরে দেশভাগ হলে তার পরিবার চলে আসে পূর্ব পাকিস্তানের যশোরে। তবে বাবার বদলীর চাকুরীর কারণে সেখানেও খুব বেশীদিন থাকতে পারেননি তারা, চলে এসেছিলেন ঢাকায়। তিনি ছাত্রী ছিলেন বাংলাবাজার সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের, স্কুলেই অভিনয়ের হাতেখড়ি তার, সেখানেই প্রথম মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছিলেন কিশোরী দিলারা জামান। টিভি পর্দায় মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি পেয়েছেন তিনি, ১৯৫৮ সালে সেই মঞ্চনাটকেও তিনি মায়ের চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন!
ইডেন কলেজে পড়ার সময়ে তিনি ছিলেন ছাত্রী সংসদের সাহিত্য সম্পাদিকা, ভিপি ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি, সরাসরি অংশগ্রহন করেছিলেন বিক্ষোভ কর্মসূচীতে। যে দিলারা জামানকে আমরা টেলিভিশনের পর্দা কাঁপাতে দেখি, সেই অমায়িক চেহারার মানুষটাই একদিন গণমানুষের ন্যায্য দাবীতে কাঁপিয়েছিলেন রাজপথও! তাঁকে আমি প্রথম দেখি মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর 'একান্নবর্তী' নাটকে। দারুণ সব তারকা অভিনেতা অভিনেত্রীতে ঠাসা এই নাটকে স্বকীয় মহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন দিলারা জামান। সংসারের কর্ত্রীর চরিত্রটা তাঁর মতো করে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারতো, এটা বিশ্বাসই হয় না।
মাহফুজ-অপি করিম-শহীদুজ্জামাম সেলিম বা ফজলুর রহমান বাবুর মতো তারকা অভিনেতাদের ছাপিয়ে নাটকের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন তিনি, স্ক্রীপ্টের সেই গৃহকর্ত্রীর মতোই, সংসারের চাবিকাঠি যার হাতে জমা থাকে, এই নাটকের প্রাণপাখিটাও তেমনই দিলারা জামানের মধ্যেই জমা ছিল। যারা চ্যানেল আইয়ের পর্দায় 'একান্নবর্তী' দেখেছেন, তাদের কেউ তাঁর সেই সহজাত অভিনয় ভুলতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এর আগে তিনি শিক্ষকতা করেছেন, চট্টগ্রামে ছিলেন অনেক বছর, সেখান থেকেই ঢাকায় চলে আসতেন নাটকের শুটিং করতে। এইসব দিনরাত্রি, অয়োময় কিংবা আজ আমাদের ছুটি'র মতো দারুণ জনপ্রিয় সব নাটকে তাঁর দুর্দান্ত অভিনয়ের সাক্ষী হয়েছেন বিটিভির দর্শকেরা।
১৯৯৩ সালে মোরশেদুল ইসলামের স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র 'চাকা'তে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রজগতে তাঁর আগমন, পরের বছর অভিনয় করলেন হুমায়ূন আহমেদের 'আগুনের পরশমনি' সিনেমায়। এরপরে ব্যাচেলর, মেড ইন বাংলাদেশ, চন্দ্রগ্রহণ, মনপুরা'র মতো চলচ্চিত্রে দেখা গেছে তাঁকে, ২০০৮ সালে চন্দ্রগ্রহণ সিনেমায় দারুণ অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। মনপুরা সিনেমাতেও দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল তাঁর অভিনয়, ১৯৯৩ সালে শিল্পকলায় অবদানের কারণে একুশে পদকে ভূষিত হন এই গুণী অভিনয়শিল্পী। তৌকির আহমেদের সিনেমা 'হালদা'তেও স্বমহিমায় ভাস্বর ছিলেন দিলারা জামান।
তাঁর দুই মেয়ে থাকেন দেশের বাইরে, আমেরিকা আর কানাডায়। স্বামী গত হয়েছেন বেশ কয়েকবছর আগেই। মেয়েরা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল তাদের কাছে, কিন্ত দেশের জন্যে তাঁর মন কাঁদে, অভিনয় ব্যপারটা তাঁর জীবনে অক্সিজেনের মতো, সেই অক্সিজেন ছাড়া তো তিনি বাঁচতে পারেন না। তাই তিনি ফিরে এসেছেন নিজের কাজের জায়গায়, ভালোবাসার কাছে। মেয়েরা রাগ করেন, কেন তিনি এই বয়সেও রাত পর্যন্ত কাজে ডুবে থাকবেন, এটা তো বিশ্রামের বয়স, নাতী-নাতনীদের নিয়ে অবসর সময় কাটানোর বয়স। দিলারা জামান হাসেন, জবাব দেন-
"দেখো, কাজ করে আমি যে পয়সাটা পাই, সেটা যে ভরণপোষনের জন্যে, ব্যপারটা ঠিক তা নয়। একটা মানসিক তৃপ্তি আছে, তাছাড়া কিছু মানুষের জীবন আমার ওপর নির্ভর করে আছে, তাদের সংসার বা পড়াশোনার খরচ চলে এই টাকায়, সেটা তো আমি তোমাদের কাছ থেকে নিতে পারি না।"
যাদের সঙ্গে অভিনয় করেন, তাদেরকে নিয়েই এখন তাঁর পরিবার, ওরাই তাঁর সন্তানের মতো। তাদের কাছেও তিনি পরিবারের সদস্য, তাদের আরেক মা। অভিনেতা অপূর্ব হুট করেই কোন এক রাতে হাজির হয়ে যান, শীতের সময় আবদার করেন তার হাতে বানানো গুড়ের পায়েশ খাবার। অপূর্ব নিজেই হয়তো ফ্রিজ খুলে খুঁজে বের করেন কোথায় কি রাখা আছে। এসব ছোট ছোট গল্প খুব আনন্দ নিয়ে মেয়েদের বলেন দিলারা জামান। অভিনয় করতে গিয়ে পরিবারকে তিনি বঞ্চিত করেছেন, স্বামী বা মেয়েদের হয়তো শতভাগ সময় দিতে পারেননি, এই আক্ষেপটা অল্পবিস্তর পোড়ায় তাঁকে। আবার অভিনয়ে ডুবে গিয়েই ভুলে থাকেন এসবকিছু।
জীবনের সাতাত্তরটা বসন্ত পার করে ফেলেছেন, অভিনয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তাও প্রায় পঞ্চাশ বছরের বেশী হয়ে গেল। এখনও এই মানুষটা অসম্ভব বিনয়ী। তিনি ইংরেজ আমলে জন্মেছেন, পাকিস্তান দেখেছেন, দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বিটিভির জন্মের সময়টা থেকে নাটকের চেনা মুখ তিনি, কাজ করেছেন ডাকসাইটে সব অভিনেতা আর গুণী সব নির্মাতার সঙ্গে। সময় আর অভিজ্ঞতা তাকে সমৃদ্ধ করেছে, অহঙ্কারী করে তুলতে পারেনি। নিজেকে এখনও আনকোরা একজন অভিনেত্রী হিসেবে ভাবতেই পছন্দ করেন। জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন মনে করেন মানুষের ভালোবাসা প্রাপ্তিটাকেই। এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন-
"আমি যে কাজটা করবো, সেটা শতভাগ সততার সঙ্গে করবো এবং আমার কাজ দিয়ে মানুষের মনে এতটুকু জায়গা যেন করে নিতে পারি, সেই চেষ্টাটা থাকে সবসময়। মানুষ যাতে আমাকে ভালোবাসে এবং মনে রাখে যে, উনি দিলারা জামান ছিলেন। এজন্যে আমাকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে আমার কি অর্জন এতবছরের জীবনে, আমি সোজাসুজি বলি, আমি যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছি দু'বার, সেগুলো আমার কাছে কাজের স্বীকৃতির বেশী কিছু না। কিন্ত সবচেয়ে বড় পুরস্কার তো মানুষের কাছে পাওয়া ভালোবাসাটা। যেখানে যাই, পথে ঘাটে মানুষ যখন তাদের পরিচিত মুখটা দেখে, তারা এমনভাবে কথা বলে যেন আমি তাদের আপন কেউ। আমার মনে হয় এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। গ্রামে যখন যাই, কারো ক্ষেতে টমেটো দেখে হয়তো আমি জিজ্ঞেস করলাম টমেটো কত করে, কিছুক্ষণ পরে দেখি সে ঝাঁকা ভরে টমেটো নিয়ে এসেছে, বলছে আপনার জন্যে এনেছি, কেউ কচি লাউ নিয়ে এসেছে, আমি পছন্দ করি জেনে।
দেশের বাইরে কয়েকদিন থাকলেই আমি ছটফট করতে শুরু করি, এসব ঘটনা আমার মনে পড়ে খুব। নিজের অভিনয়ের ব্যপারে আমার মনে হয় আমি এখনও শিখছি। অভিনয়ের সাগরের সামনে আমি সৈকতে দাঁড়িয়ে নুড়ি কুড়িয়ে নিচ্ছি মাত্র। আমাদের জুনিয়র ছেলেমেয়েদের অনেকেও এখন অনেককিছু শিখে অভিনয়ে আসছে, অভিনয় সম্পর্কে ওরা জানে অনেকটা। আমাদের সময়ে তো এমন সুযোগই ছিল না।"
পাঁচশোর বেশী নাটকে অভিনয় করেছেন এই মানুষটা, মা কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠের চরিত্রে তাঁর অভিনয় মনে গেঁথে আছে আমাদের সমসাময়িক দর্শকদের। নব্বইয়ের দশক থেকে যারা বাংলা নাটক দেখেন, তাদের কাছে অতি পরিচিত একটা মুখ দিলারা জামান, খুব পছন্দের একজন মানুষও। অভিনয়টা যার কাছে পেশার চেয়ে বড় নেশা, সবচেয়ে ভালোবাসার জায়গা, সবচেয়ে আপনও।
ফিচার্ড ইমেজ কৃতজ্ঞতা- আইস টুডে ম্যাগাজিন