‘দিল বেচারা’ দিয়ে সুশান্ত বরাবরের মতোই জীবনকে যাপন করার শিক্ষা দিয়ে গেলেন। যে শিক্ষা তিনি নিজেই কাজে লাগাতে পারেননি তার জীবনে। এটাই শেষ, এখানেই থামছে সুশান্তের অধ্যায়...
সুশান্ত চলে যাবার পর থেকেই দর্শকরা সুশান্তের শেষ সিনেমাটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। সুশান্তের সরল হাসি, সুশান্তের ডায়লগ, সুশান্তের অভিনয় দেখার শেষ সুযোগ কে ই বা হাতছাড়া করতে চাইবে। সুশান্ত যদি দেখতে পেতো তাহলে দেখতো তার জন্য দর্শকরা ভালোবাসা নিংড়ে দিয়েছে। সর্বস্তরের মানুষ সুশান্ত সিং রাজপুতের জন্য হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিয়েছে। তাই তো ‘দিল বেচারা’র ট্রেইলার রিলিজ পাবার পরে সকল ইউটিউব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ৮ কোটি বারেরও বেশি দেখা হয়েছে ট্রেইলারটি, ১ কোটিরও বেশি লাইক।
ইন্ডিয়ান কোন সিনেমার ক্ষেত্রে এরকম ভালোবাসা পেয়েছে খুব কম সিনেমাই। সবারই তুমুল আগ্রহ ছিল সিনেমাটি দেখার। তাই সুশান্ত ও সুশান্তের দর্শকদের প্রতি সম্মান রেখে ডিজনি হটস্টার তাদের সকল সাবস্ক্রাইবার ও ননসাবস্ক্রাইবারদের জন্য এই সিনেমাটি ফ্রি তে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। গতকাল মুক্তি পেল সুশান্তের শেষ সিনেমা ‘দিল বেচারা’। সিনেমা হলে মুক্তি পেলে কান্নার রোল উঠতো এই সিনেমা দেখে। কিন্তু কিছু কান্না থাকে না একদম আপন, নিজে আলাদা হয়ে কাঁদতে হয়। এই সিনেমার জন্য কান্না অনেকটা সেরকমই।
তাই অনলাইনে রিলিজ পেয়ে আমাদের আলাদা হয়ে কাঁদার সুযোগ করে দিল বেচারা। এই কান্না সুশান্তকে হারানোর জন্য যতটা তার চেয়েও বেশি হয়তো নিজের জীবনকে যাপন করে যাবার শিক্ষা দেয়া ম্যানির জন্য। ম্যানি যদি সুশান্তের খবর পেতো তাহলে ঠিকই বলে উঠতো- দিল বেচারা।
'কখন জন্ম নেবো, মরবো কখন এটা আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। কিন্তু কীভাবে বাঁচবো সেটার সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি'- দিল বেচারা’র গল্পটা এই দর্শনের। এখানে আমরা কিজি আর ম্যানির হাত ধরে জীবনকে যাপন করতে শিখি। কিজির ক্যান্সার হবে এটা কিজির সিদ্ধান্ত ছিল না। কিজির নাকের সামনে চব্বিশ ঘণ্টা অক্সিজেন নল লাগিয়ে রাখতে হবে এটাও কিজির সিদ্ধান্ত ছিল না। কিন্তু এগুলোর কারণে কিজি প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে কল্পনা করেছে। যেন সে অপেক্ষা করছে অনাগত মৃত্যুর জন্য।
কিন্তু মৃত্যু আসার আগে মৃত হয়ে যাওয়া কিজিকে বাঁচানো প্রয়োজন ছিল। এই বাঁচানো মৃত্যু থেকে বাঁচানো নয় বরং মৃত্যুর আগে মরে যাওয়া থেকে বাঁচানো। সে বাঁচানোর দায়িত্বটাই নেয় ম্যানি। ক্যান্সার তাকেও কাবু করে ফেলেছিল একসময় কিন্তু সে ফাইট ব্যাক করেছে এবং এখন জীবনকে পরিপূর্ণভাবে যাপন করতে চায়। কিজির নিঃসঙ্গতা, হতাশা ম্যানিকেও আলোড়িত করে। সে চায় কিজি এভাবে ধুঁকে ধুঁকে না মরুক। যে ক’টা দিন বাঁচবে, বাঁচার মতোই বাঁচুক। তাই সে প্রতিনিয়ত কিজিকে জীবনের মানে খুঁজতে শেখায়, আনন্দ পেতে শেখায়। কিজিও যেন ধীরে ধীরে টের পায় তাকে বাঁচতে হবে। বাঁচার মতো করেই বাঁচতে হবে।
এই গল্পটা কিজির। তার নামটা তার মতোই অদ্ভুত। রামগরুড়ের ছানার মতো হাসতে যে তার মানা। অথচ গোমড়ামুখো চেহারার পেছনে এক পৃথিবী হাসি লুকোনো তার। বিরক্তি ভরা চোখ সুযোগ পেলে বিস্ময়ে ছানাবড়াও হয়। তার কত শখ, আহ্লাদ, ইচ্ছে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে সে মৃত্যুভয়ে। কিজির অনেক ইচ্ছে প্যারিস যাবার। কিন্তু সে জানে এই শখ কখনোই পূরণ হবার নয়। কারণ শখ পূরণের যে চেষ্টা সে চেষ্টাটুকু করারও সাধ্য নেই তার, এটাই সে মনে করে।
কিন্তু তার জীবন পুরো পাল্টে গেল যখন এমানুয়েল রাজপাল জুনিয়র অর্থাৎ ম্যানি তার জীবনে এলো। কিজির স্বপ্নগুলো যেন প্রাণ পেলো ম্যানির হাত ধরে। সাঞ্জানা সাঙ্ঘি তার অভিষেক সিনেমাতেই কিজির ভূমিকায় ভীষণ সাবলীল আর অনবদ্য অভিনয় করে দেখালেন। যে নেপোটিজমের কথা শুনে এখন আমরা নাক সিটকাচ্ছি, অনন্যা-জাহ্নবীদের বাতিলের খাতায় ফেলে দিচ্ছি। এই নিন এখনই আপনার সুযোগ সাঞ্জানাকে সামনে তুলে আনার। সাঞ্জানাকে পছন্দ করুন, সাপোর্ট দিন, ওর কাজ পেতে কোন সমস্যাই হবে না। কিন্তু আমরাই যদি সাঞ্জানাকে ভুলে যাই তাহলে সাঞ্জানাও যে সুশান্ত হবে না তার গ্যারান্টি কই?
এই গল্পটা ম্যানির। অস্টোসারকোমাও যাকে কাবু করতে পারে নি। যে জীবনকে যাপন করে যেতে চায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। খোশমেজাজি, সদালাপী ও পাগলাটে এই ছেলেটির সাথে দেখা হয়ে যায় কিজির। কিজিকে দেখেই ম্যানি ঠিক করে যে এই মেয়েটার মুখে হাসি ফোটাতে হবে, জীবনকে যাপন করা শেখাতে হবে। ম্যানি নিজে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে এসেছে বলেই হয়তো কিজির হতাশাগ্রস্থ চেহারার পেছনের হাসিখুশি কিজিকে দেখতে পারে। তাই সে কিজির সকল ইচ্ছে, সকল শখ পূরণ করতে চায়। কারণ, দিনশেষে সবই ‘সেরি’ হয়ে যায়। জীবন যতই বাঁধা আনুক সামনে, তার মোকাবেলা করে দিনশেষে ‘সব ঠিক আছে’ বলাটাই আনন্দ।
ম্যানি ভূমিকায় সুশান্তকে আসলে অভিনয় করতে হয় নি। সুশান্ত নিজেই যেন ছিলেন ম্যানি হয়ে। এই হাসি, এই দর্শন, এই জীবন সবই সুশান্তের নিজস্ব যেন। নিজের ভূমিকায় নিজে অভিনয় করে গিয়েছেন সুশান্ত। জীবনকে যাপন করার তরিকা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। সুশান্তের অভিনয়ের পাশাপাশি তার ফিজিক্যাল ট্রান্সফরমেশনও চোখে পড়ার মতো। কেউ যদি সুশান্তকে না চেনা কোন দর্শককে এই সিনেমা দেখিয়ে তার প্রথম সিনেমা কাই পো ছে দেখায় তাহলে সে বুঝতেই পারবে না যে দুই সিনেমার মাঝখানে প্রায় ৭ বছরের পার্থক্য। ঠিক যেন একজন কলেজ স্টুডেন্টের মতোই হালকা, স্লিম বডি শেপে নিজেকে নিয়ে এসেছিলেন সুশান্ত। সদ্য টিনেজ পার হওয়া এক যুবক যেন তিনি। এধরণের ডেডিকেশনই তাকে আলাদা করেছিল বাকি সবার থেকে।
এই সিনেমাটা এ আর রহমানেরও। তার মিউজিক পুষিয়ে দিয়েছে সবটুকুই। আমি এবারও এ আর রহমানকে আন্ডার এস্টিমেট করার ভুল করেছি। ভেবেছিলাম যে সুশান্তের শেষ সিনেমা হিসেবে আরও ভালো মিউজিক দিতে পারতেন রহমান। কিন্তু সিনেমায় যেভাবে গান আর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে নিজেই নাকে খত দিলাম। আরও গ্রো করবে এই গানগুলো, বিশেষ করে 'ম্যায় তুমহারা' গানটা তাড়া করবে অনেকদিন, অনেক বছর।
‘দিল বেচারা’ দিয়ে সুশান্ত বরাবরের মতোই জীবনকে যাপন করার শিক্ষা দিয়ে গেলেন। যে শিক্ষা তিনি নিজেই কাজে লাগাতে পারেন নি তার জীবনে। কিন্তু সুশান্ত হয়তো ম্যানির মতো বলতেই পারে- যতটুকু বেঁচেছি নিজের মতো করে বেঁচেছি। সুশান্তকে আর দেখা হবে না পর্দায়। তার অভিনয়, ডেডিকেশন আর মুগ্ধ করবে না; তার নাচ-স্টাইল আর বারবার দেখা হবে না; তার জীবন দর্শন-আকাশ প্রেম দেখে মুগ্ধ হওয়া হবে না।
এটাই শেষ, এখানেই থামছে সুশান্তের অধ্যায়। কিন্তু আমাদের মনে সুশান্ত আসন গেড়ে বসে থাকবেন আজীবন। কখনো ফিরে আসবেন ইশান হয়ে, কখনো ব্যোমকেশ বক্সী, কখনো বা মহেন্দ্র সিং ধোনি হয়ে আবার কখনো পাগলাটে ম্যানি। সুশান্ত থাকবেন আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম তারা হয়ে, যার দিকে তাকিয়ে ‘কউন তুঝে’ গান কানে লাগিয়ে বলে উঠবো মাঝে মাঝেই- Seri Sushant!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন