সুশান্ত বেঁচে থাকতে এই 'ভালোবাসা' কোথায় ছিল?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সুশান্তের প্রতি তথাকথিত 'ভালোবাসা' দেখাতে গিয়ে যারা আইএমডিবিতে দিল বেচারাকে টেন রেটিং দিয়ে আসছে, এরাই দেখুন গিয়ে এক বছর আগে সুশান্ত আর ডিজনিকে গালি দিয়েছিল ক্ল্যাসিক একটা সিনেমার রিমেক করছে বলে!
সুশান্ত সিং রাজপুতের জীবনের শেষ সিনেমা দিল বেচারা মুক্তি পেয়েছে দুইদিন হয়ে গেল। সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল মাতামাতি চলছে সিনেমাটা নিয়ে, ঝড় বয়ে যাচ্ছে আইএমডিবিতে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এই মুভি ডাটাবেজে দলে দলে ইউজাররা গিয়ে দিল বেচারাকে টেন স্টার রেটিং দিয়ে আসছেন, আইএমডিবিতে সর্বাধিক রেটিং পাওয়া সিনেমার তালিকায় শশাঙ্ক রিডাম্পশানকে পেছনে ফেলে এক নম্বরে উঠে এসেছে দিল বেচারা; সুশান্ত সিং রাজপুত বেঁচে থাকলে এই দৃশ্য দেখেই হয়তো একবার আত্মহত্যা করার কথা ভাবতেন- মেজাজ খারাপ করেই কথাটা বলতে বাধ্য হচ্ছি।
ডিজনি হটস্টার আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে এই সিনেমাটা নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল। কাস্টিং হিসেবে সুশান্ত আর সাঞ্জানার নামও তখনই ঘোষণা করা হয়েছিল। সুশান্তের ক্যারিয়ারে তখন বাজে সময় যাচ্ছে, টানা কয়েকটা সিনেমা ফ্লপ হয়েছে, রাইজিং স্টার থেকে ভার্ডিক্টটা নামছে নিচের দিকে। ইন্ডাস্ট্রিতে তখনও নিজের জায়গা পাকা করার জন্য লড়তে হচ্ছিল তাকে। সেই সময়ে ডিজনির পোস্টে, এবং ফেসবুকে সুশান্তের শেয়ার করা দিল বেচারার এনাউন্সিং পোস্টে গালি আর সমালোচনার মেলা বসেছিল। কমন একটা অভিযোগ ছিল, কেন ফল্ট ইন আওয়ার স্টার্সের মতো ক্ল্যাসিক একটা সিনেমা নিয়ে এমন তামাশা করা হচ্ছে?
হ্যাঁ, দিল বেচারা সিনেমাটা হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা ফল্ট ইন আওয়ার স্টার্সের অফিসিয়াল রিমেক। টিনএজ প্রেমের গল্প নিয়ে জন গ্রীন লিখেছিলেন দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টার্স। সাড়া জাগানো এই উপন্যাসটাকে সিনেমায় রূপ দিয়েছিলেন জশ বুন, নামটা ছড়িয়েছিল লোকের মুখে মুখে। বক্স অফিসে ব্লকবাস্টার হিট হয়েছিল সেই সিনেমা, শেইলিন উডলি এবং আনসেল ইলগর্টের জুটিটাকে লুফে নিয়েছিল দর্শক। এই সিনেমার অজস্র ভক্ত আছে বিশ্বজুড়ে, রোমান্টিক সিনেমার তালিকা করতে বসলে অনেকেই দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস-কে ওপরের দিকেই রাখেন।
আর কোনো ভাষায় সিনেমাটার অ্যাডাপশন হয়নি, হিন্দিতে হয়েছে। অন্য কোন সময় হলে এটা নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হতো না। বরং দর্শক-সমালোচকদের বড় একটা অংশ দিল বেচারার খুঁত খুঁজে বের করার চেষ্টা করতো, অরিজিনাল ভার্সনের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবচ্ছেদ করা হতো ইচ্ছেমতো, ট্রল বানানো হতো নোংরাভাবে, হাসিঠাট্টার পাত্র হতেন নায়িক-নায়িকা বা নির্মাতা সবাই। এখন সবাই সবকিছু ওভারলুক করে যাচ্ছে, সুশান্তের জন্য। মরে গিয়ে এই একটা উপকার করে গেছেন তিনি 'দিল বেচারা' সিনেমাটার জন্য, সন্দেহ নেই।
মুক্তির একদিনের মধ্যে আইএমডিবিতে দিল বেচারার একাউন্টে পঞ্চাশ হাজার ভোট পড়েছে, হিন্দি সিনেমার জন্যে যে সংখ্যাটা গোটা লাইফটাইমে অর্জন করাটাও একটা বড় ব্যাপার! সুশান্তের প্রতি তথাকথিত 'ভালোবাসা' প্রদর্শন করতে গিয়ে যারা আইএমডিবিতে দিল বেচারাকে টেন রেটিং দিয়ে আসছে, এরাই কিন্ত সুশান্ত বেঁচে থাকা অবস্থায় দিল বেচারা মুক্তি পেলে সিনেমাটাকে ধুয়ে কিচ্ছু রাখতো না। এরাই তখন এক রেটিং পয়েন্ট দিতো একই সিনেমার নামে। দিল বেচারার এই রেটিং পাবার পেছনের কারণটা পরিচালকের মুন্সীয়ানা বা অভিনেতাদের ক্যারিশমা নয়, শুধু এবং শুধুমাত্র সুশান্তের মৃত্যু।
সুশান্তের অকালপ্রয়াণের সঙ্গে অনেকেই নেপোটিজমকে মিলিয়ে করণ জোহর, সালমান খানদের মতো তারকাদের গালিগালাজ করেছেন, তাদের জন্য নাকি আউটসাইডাররা বলিউডে কাজ পায় না, এরা শুধু স্টারকিডদের ব্রেক দেয়, এদের জন্য সুশান্তের মতো মেধাবী আর্টিস্টরা একঘরে হয়ে পড়ে থাকে, কাজ পায় না, ইত্যাদি ইত্যাদি। তো মহামান্য সমালোচকগণ, দিল বেচারার বেলায় আপনারা যেটা করছেন, সেটা নেপোটিজম না? গড়পড়তা মানের একটা মুভিকে আপনারা আইএমডিবিতে ৯.৮ রেটিং এনে দিয়েছেন, এটা অবিচার না? দিল বেচারা ভালো সিনেমা হতে পারে, কারো কাছে অসাধারণ লাগতেই পারে, তাই বলে এটা তো শশাঙ্ক রিডাম্পশান বা ফরেস্ট গাম্পের চেয়ে ভালো সিনেমা না। এই আহ্লাদটা না করলে কি আপনাদের চলতো না?
সুশান্তের মৃত্যুর পরে অনেকেরই চেহারা চেনা হয়েছে। এই একটা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনেককেই আখের গোছাতে দেখেছি, নিজের পায়াভারী করতে দেখেছি। শীর্ষ এক অভিনেত্রী তো কয়েকটা ভ্লগও বানিয়ে ফেলেছেন, পাঁচ মিনিটের ভিডিওতে সুশান্ত জায়গা পেয়েছেন ত্রিশ সেকেন্ড, বাকী সময় জুড়ে সেই অভিনেত্রী নিজের অপছন্দের লোকেদের গালিগালাজ করেছেন। দিল বেচারার একেকটা গান মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়েছে, ট্রেলার তো লাইক পাবার রেকর্ড করেছে ইউটিউবে, অথচ এই সুশান্তই বেঁচে থাকতে সবার কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, আমার সিনেমা দেখুন, আমাকে সাপোর্ট করুন, নইলে আমি হারিয়ে যাব। সুশান্ত হারিয়ে গেছেন, এখন এরা এসেছে দল বেঁধে তামাশা করতে!
এই দর্শকেরা সোনচিড়িয়ার মতো দুর্দান্ত সিনেমাকে ফ্লপ বানিয়েছে, দিল্লি বা কলকাতার মতো বড় বড় শহরে, ছয়শো থেকে এক হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার মাল্টিপ্লেক্স হলে দুই-চারজন করে দর্শক ছিল সোনচিড়িয়ার। আজ সেই দর্শকই অনলাইনে পিটিশন করে, ইভেন্ট খোলে, সুশান্তের শেষ সিনেমাটা তারা অনলাইনে দেখতে চায় না, সিনেমা হলে গিয়ে দেখতে চায়! এরা ছয় মাসের বাচ্চা তৈমুরকে স্টার বানায়, অনন্যা পাণ্ডে বা জাহ্নবী কাপুরদেরকে সিনেমায় আসার আগেই ইন্সটাগ্রামে মিলিয়ন ফলোয়ারের মালিক বানিয়ে দেয়, আর তারপর বলে, নেপোটিজম বলিউডটাকে খেয়ে নিলো রে! এদের চেয়ে বড় হিপোক্রেট গোয়েবলসও ছিল না!
খারাপ লাগছে শুধু এটা ভাবতেই- আমাদের জাগতিক ভালোবাসার সিংহভাগই মৃত মানুষদের জন্য বরাদ্দ থাকে, মানুষগুলো জীবিত থাকতে আমরা ভালোবাসার প্রকাশটা করে উঠতে পারি না, বা করি না। কাজেই ব্যাপারটাকে ভালোবাসার চেয়ে বেশি ভান বলেই মনে হয় আমার কাছে। কাই পো ছে, ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বক্সী বা সোনচিড়িয়ার মতো দারুণ সব সিনেমার খোঁজ না রাখা লোকজন যখন শুধুমাত্র হুজুগের বশে 'দিল বেচারা'কে আইএমডিবির টপ রেটেড সিনেমা বানিয়ে ফেলে, তখন সুশান্তকে বলতে ইচ্ছে করে, "আপনি মরে গিয়ে ভালোই হয়েছে, ভালোবাসার নামে এই সার্কাস, এই তামাশা অন্তত দেখতে হচ্ছে না আপনাকে!"
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন