খবরের কাগজ বিক্রেতা দিল আফরোজ খুকি ও একটি মন ভালো করে দেয়া গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
স্বামী মারা যাওয়ার পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্ত সততা বিসর্জন দেননি। ভিক্ষা না করে খুকি নেমে এলেন রাস্তায়, শুরু করলেন পেপার বিক্রি করা। সারাদিনে যা কামাই হয়, তার বেশিরভাগ তিনি বিলিয়ে দেন এতিমখানায়, মসজিদে, মন্দিরে...
'জীবন'কে আমার মাঝেমধ্যে খুব বৈষম্যের এক বিষয় মনে হয়। 'ফেয়ার প্লে' কনসেপ্ট এখানে নেই। সাম্য এখানে নেই। যা আছে তা গভীর বিষাদ, বৈষম্য আর শেষপর্যন্ত লড়াই। তীব্র সে লড়াই হতে পারে ক্ষমতার, হতে পারে জনপ্রিয়তার, হতে পারে বেঁচে থাকারও। যেমন রাজশাহী শহরে গত চল্লিশ বছর ধরে পায়ে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করছেন এক মানুষ। তিনি কারো দয়াদাক্ষিণ্য চান না। নিজে কাজ করে খেতে চান। মানসিক ভারসাম্যহীন এই মানুষটি রাজশাহীর একমাত্র মহিলা হকারও।
তার নাম দিল আফরোজ খুকি। আপনি যদি রাজশাহী শহরে যান, সেখানের নিউমার্কেটের কোনো চায়ের দোকানে সকালবেলা বসে চা খেতে খেতে হয়তো তাকে দেখতেও পেতে পারেন। আলুথালু চুল, হতদরিদ্র মুখ আর বিবর্ণ পোশাকে একরাশ পত্রিকা আঁকড়ে ধরে যিনি হাসতে হাসতে আসছেন। বিক্ষিপ্ত পা চলছে, চোখের দৃষ্টিও বিভ্রান্ত। তবে মনের লক্ষ্য ঠিকই স্থির। পেপার বিক্রি করতে হবে। টাকা রোজগার করতে হবে।
খুকির জীবন গল্পটা বেশ বিষন্ন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় সত্তর বছরের এক বৃদ্ধের সাথে। বিয়ের এক মাস পরেই সেই স্বামী মারা যান। 'বিয়ে' কী বুঝতে না বুঝতেই খুকি হয়ে যান বিধবা। স্বামীর পরিবারের মানুষজন একরকম ছুঁড়েই ফেলে দেয় তাকে। আসেন বাবার বাড়িতে। সেখানেও জায়গা হয় না। সেখান থেকেও প্রত্যাখাত হন তিনি। মানসিক ধাক্কা খান। যে ধাক্কা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি আর।
কী করবেন? কোথায় যাবেন? কী খাবেন? ১৯৮০ সাল তখন। হঠাৎ করেই রাস্তায় কুড়িয়ে পান এক লোকের মানিব্যাগ। সেই মানিব্যাগ, মানিব্যাগের মালিকের কাছে ফিরিয়ে গিয়ে পান ১৫০ টাকা। সেই টাকাকেই মূলধন করেন তিনি। পেপার কিনে বিক্রি করা শুরু করেন রাজশাহী শহরে। এই পেশায় এসে প্রথম প্রথম সমস্যা হলো কিছু। অনেকেই তার কাছ থেকে পেপার কিনতেন না৷ মানসিক ভারসাম্যহীন এক মানুষের কাছ থেকে পেপার কিনলে কী সমস্যা, তা আমাদের জানা নেই। তবে এটাও ঠিক, শুরুরদিকে পেপার বিক্রি করতে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি তাকে। আস্তে আস্তে তার বিক্রি বাড়ে। দুইবেলা দুমুঠো খেয়েপড়ে বেঁচে থাকবার অবলম্বন তৈরী হয়। বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জমিতে ঘর উঠিয়ে রাত সেখানেই কাটান তিনি। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়েন পেপার নিয়ে। পেপার বিক্রির জন্যে।
খুকির প্রত্যেকদিনের ইনকাম তিনশো টাকা। সেই টাকা দিয়ে তিনি কী করেন, জানেন? শুনলে চমকে উঠবেন নিশ্চিত। এই তিনশো টাকার মধ্যে চল্লিশ টাকা খাবার-দাবারের পেছনে খরচ করেন তিনি প্রতিদিন। একশো টাকা দেন একটা এতিমখানায়। পঞ্চাশ টাকা দেন মসজিদ আর মন্দিরে। দশ টাকা দেন কিছু ভিক্ষুককে। আর একশো টাকা জমা রাখেন ব্যাঙ্কে। স্বপ্ন দেখেন, একদিন অনেক টাকা জমলে হজ্বে যাবেন। এখন পর্যন্ত তার দেয়া টাকা দিয়ে ছয়টি সেলাই মেশিন কেনা হয়েছে গরীব মেয়েদের জন্যে। বিধবা তিন হিন্দু মহিলাকে গরু কিনে দিয়েছেন তিনি। যাতে করে এই মহিলারা গরুর দুধ বেচে সংসার চালাতে পারে। কি, একটু চমকে গেলেন না? নিজে খেয়ে না খেয়ে মানুষকে সাহায্য করছেন, এও কী সম্ভব? হ্যাঁ, এটাও সম্ভব। যেটাই করেছেন খুকি। করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়তই।
খুকিকে মাঝেমধ্যেই স্থানীয় নেশাখোরদের সহিংসতার শিকার হতে হয়। মাঝেমধ্যেই তাকে মেরেধরে তার টাকা কেড়ে নেয় এই সন্ত্রাসীরা। তবু খুকির হাসি মলিন হয় না একটুও। সে তার মত করেই বেঁচে থাকে। নিজের লড়াই নিয়েই সে মেতে থাকে সারাদিন। দেশ টিভির সাথে সাক্ষাৎকার দেখছিলাম খুকির। হাসতে হাসতে সে বলছে-
কী হবে সাক্ষাৎকার দিয়ে? কেউ তো আমাকে কোনো সাহায্য করবেনা। কেউ তো আমাকে কোনো সাহায্য করেনা।
যদিও মুখে হাসি ছিলো, সে হাসিতে কোথায় যেন ঝুলে ছিলো বিষন্নতা। চোখের তারায় যেন লেপ্টে ছিলো বিষাদ। আসলে খুকির করা এ প্রশ্নের তো কোনো উত্তর নেই আমাদের কাছে। হয়তো সমাজের কোনো বিত্তবান মানুষ এসে এক খুকির দায়িত্ব নিলেন, কিন্তু এরকম আরো কত যে খুকি ছড়িয়ে আছে আশেপাশে, কে রাখে তার খোজ! সরকার তাদের জন্যে কিছু করছে কী না, তাও জানতে ইচ্ছে করে। খুকি তো এ দেশেরই নাগরিক। এরকম অজস্র খুকিকে নিয়ে সরকারের কি পরিকল্পনা? কেউ কী জানেন?
দিনশেষে কী এটাই জীবন? হয়তো এটাই জীবন। গভীর বিষাদ আর লড়াইয়ের জীবন। হেরে হেরে মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত 'সব ঠিক হয়ে যাবে' বলার নামই জীবন।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন