রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের মহানায়ক তিনি। অথচ তার খেলার কথা ছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার হয়ে! এমনকি বার্সেলোনার হয়ে প্রি সিজনেও অংশগ্রহণ নিয়েছিলেন। তাহলে শেষ পর্যন্ত কি এমন হলো যার কারণে বার্সেলোনা হারিয়েছিলো এই গ্রেটকে?

ফুটবলের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ প্লেয়ারদের নাম নিতে চাইলে, যে প্লেয়ারটির নাম সবার উপরের সারিতে থাকবে তিনি হলেন দা গ্রেট আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। রিয়াল মাদ্রিদকে সবচেয়ে বড় ইউরোপিয়ান ক্লাবে পরিনত করার নায়ক ছিলেন তিনি। ডি স্টেফানো মাদ্রিদের হয়ে না খেললে, আজ হয়তো মাদ্রিদের ইতিহাস অন্যরকমই হতো।

কিন্তু এটা কি জানতেন আপনি, ডি স্টেফানোর আসলে রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার হয়ে খেলার কথা ছিলো, এমনকি বার্সেলোনার হয়ে প্রি সিজন ম্যাচেও অংশগ্রহণ নিয়েছিলেন তিনি। তাহলে শেষপর্যন্ত কী এমন ঘটেছিল, যার কারনে বার্সেলোনা হারিয়েছিলো এই গ্রেটকে? কী এমন ভুল করেছিলো বার্সেলোনা বোর্ড? সেই নাটকীয় ট্রান্সফার এর পুরো ঘটনাটা জানতে হলে পুরো লেখাটা পড়ুন ।

প্রথমে ডি স্টেফানোর মাহাত্ম্য নিয়ে একটু বলি। ফুটবলের ইতিহাসে মাত্র একজন ব্যক্তিকে সুপার ব্যালন ডি-অর সম্মানে ভূষিত করা হয়, আর তিনি হলেন ডি স্টেফানো। তিনি মাদ্রিদে আসার আগে শেষ ২৪ বছরে মাদ্রিদ মাত্র ২ বার লীগ জিতে, অতঃপর ডি স্টেফানো মাদ্রিদে এসে ১১ বছরে মাদ্রিদ কে ৮ বার লীগ জেতান এবং ইতিহাসের একমাত্র দল হিসেবে টানা ৫ টি চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতান। তার মাধ্যমেই ইউরোপিয়ান জায়ান্ট হিসেবে মাদ্রিদের উত্থান হয়, রিয়াল মাদ্রিদ কে তিনি নিয়ে যান সর্বোচ্চ উচ্চতায়।

কিন্তু এইসব কিছু তার করার কথা ছিল বার্সেলোনার জার্সি গায়ে দিয়ে, বার্সেলোনার জন্য। একদম শুরু থেকে শুরু করছি। ডি স্টেফানো তখন আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভার প্লেটের হয়ে খেলতেন, রিভার প্লেটের হয় মাঠ মাতিয়ে পাড়ি জমান কলম্বিয়ান ক্লাব মিলিওনারিওসে। সেখানে একের পর এক অনবদ্য পারফরম্যান্স দিয়ে ইউরোপের সব বড় ক্লাবের নজরে চলে আসেন। 

আলফ্রেডো ডি স্টেফানো

কিন্তু সমস্যা হলো কলম্বিয়ান লীগ তখন ফিফা নিবন্ধিত ছিলো না , তাই সেই লীগের কোনো প্লেয়ারকে যদি কোনো ফিফা নিবন্ধিত লীগের দল কিনতে চায় তাহলে ফিফা নিবন্ধিত থার্ড পার্টি অথবা প্লেয়ারের পূর্বের দলের সাথে বসে তিন পক্ষ মিলে ডিল করতে হবে। অর্থাৎ ট্রান্সফারের কাগজে ফিফা নিবন্ধিত দল দেখাতে হবে।

তখন ট্রান্সফারের জন্য তার পূর্বের ক্লাব রিভার প্লেটকে তার অর্ধেক মালিকানা দিয়ে ট্রান্সফারের দায়িত্ব দেওয়া হলো। সেজন্য সর্বপ্রথম অফারটি এলো বার্সেলোনার কাছ থেকে, বার্সেলোনার অফারে রিভারপ্লেট রাজি হয়ে ডিল ক্লোজ করে ফেললো। কিন্তু ডিলের কাগজে একটা টার্ম জুড়ে দেয় যা বার্সেলোনার বোর্ড ততটা গুরুত্ব দেয় নি, সেটি হলো তার বর্তমান ক্লাব মিলিওনারিয়েস যদি পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট না হয় তবে তারা ডিল ক্যান্সেল করে দিতে পারবে।

অর্থাৎ অফিসিয়াল ক্লাব রিভারপ্লেট এর সাথে ডিল ক্লোজ হয়ে গেলেও তার আনঅফিসিয়াল বর্তমান ক্লাবের সাথে টাকার ব্যাপারে বার্সার ডিল সাকসেসফুল হওয়া তখনো বাকি। তখনকার দিনে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলো থার্ড পার্টি দিয়ে এরকম ডিল করে ছোট দলগুলোকে ঠকিয়ে প্লেয়ার নিয়ে যেতো, যার কারনে মিলিওনারিওস চালাকি করে রিভারপ্লেট কে বলে চুক্তিতে এই টার্মটা জুড়ে দিয়েছিলো। 

কিন্তু বার্সা সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে মিলিওনারিওসকে ছোট ক্লাব মনে করে এত অল্প টাকা প্রস্তাব করে বসে যা ছিলো সেই ক্লাব এবং ডি স্টেফানোর জন্য রীতিমতো অসম্মানজনক। তার উপর তারা বিড করতে নিয়ে গিয়েছিলো মিলিওনারিওসের লোকাল রাইভাল ক্লাবের হবু ডিরেক্টর জুয়ান বুস্কেট কে, যার কারনে মিলিওনারিওস আরো বেশি অপমানিত বোধ করে। বার্সা মুলত অফিসিয়াল কাগজের সেই ক্লজটাকে আমলে না নিয়ে এদেরকে ছোটোখাটো ক্লাব মনে করে এমন বোকামী করে বসে, মনে করেছিল অফিসিয়ালি ডিল হয়ে গেছে, এদেরকে আবার এতো টাকা দেওয়ার কি দরকার। কিন্তু বার্সার এই অপমানের জন্য মিলিওনারিওস এমন ভাবে বেকে বসে যে একপর্যায়ে তারা ডি স্টেফানোকে বার্সার কাছে বিক্রি করতেই অস্বীকৃতি জানায়।

তখন প্রেক্ষাপটে আসে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সার এই ভুলের সুযোগ নেয় তারা। মিলিওনারিওস কে উপযুক্ত দাম দিয়ে তাদেরকে রাজি করিয়ে নেন সাবেক রিয়াল প্রেসিডেন্ট সান্তিয়াগো বার্নাব্যু। এবার অফিসিয়ালি ডিল কমপ্লিট করতে যান রিভারপ্লেটের কাছে। কিন্তু রিভারপ্লেট বলে, আমরা বার্সেলোনার সাথে ডিল করে ফেলছি, আমাদের শেয়ার বার্সেলোনার হাতে চলে গেছে।

এবার কাহিনী তে এলো নতুন টুইস্ট। বার্সেলোনা রিভারপ্লেট এর অংশের শেয়ার কিনে নিলেও ট্রান্সফার পেপারের ওই একটা টার্ম পুরো ট্রান্সফার কে আটকে দেয়। মিলিওনারিওস কোনোভাবেই স্টেফানো কে বার্সায় যেতে দেবে না। আর বার্সাও শেয়ার ফেরত দেবে না কারন এতে স্টেফানো চলে যাবেন রিয়াল মাদ্রিদের হাতে। এতো নাটকের মধ্যে ডি স্টেফানো বার্সার হয়ে প্রি সিজনে যোগ দিলেন, কিন্তু মিলিওনারিওস এর অনুমতি ছাড়া অফিসিয়াল কোনো ম্যাচ খেলতে পারবেন না।

রিয়ালের জার্সিতে আলফ্রেডো ডি স্টেফানো

শেষপর্যন্ত কোনো সুরাহা না পাওয়ায় ফিফা পর্যন্ত বিষয়টা গেলো। স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন এবং ফিফা এই তিনপক্ষকে নিয়ে বসলো। বার্সেলোনা-রিভার প্লেটের ট্রান্সফার পেপারের এই টার্মের কারনে কোনো নির্দিষ্ট সমাধানে আসা গেলো না কারন কোনো পক্ষই কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নয়। বার্সা শেয়ার ফেরত দেবে না আর মিলিওনারিওস ও বার্সার হয়ে ডি স্টেফানোকে খেলতে দেবে না। তখন কোনো উপায় না পেয়ে ফিফা বাধ্য হয়ে রায় দিলো ডি স্টেফানো বার্সেলোনা এবং রিয়াল মাদ্রিদ উভয় দলের হয়ে ফুটবল খেলবেন, এক সিজনে বার্সায় তো আরেকসিজন রিয়ালে এরকম ভাবে খেলে যাবেন।

কিন্তু বার্সেলোনা এই রায় মেনে নিতে পারে নি। তারা রিয়ালের হয়ে খেলো কোনো খেলোয়াড় কে তাদের দলে নিবে না। তারা মনে করে তাদের সাথে অন্যায় হয়েছে। কেউ কেউ বোর্ড আর প্রেসিডেন্ট কে দোষ দেয় এই ব্যার্থতার জন্য । এর ফলে রাগে দুঃখে অপমানিত বোধ করে বার্সার প্রেসিডেন্ট মার্টি কারেটো রিজাইন করতে বাধ্য হন। অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত নেয় ডি স্টেফানোর শেয়ার মাদ্রিদের কাছে বিক্রি করার যাতে করে পার্মানেন্টলি তাকে ছেড়ে দিতে । আর এভাবেই তাদের হারাতে হয় শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলারকে। আর এই এক ট্রান্সফারে রিয়ালের মাদ্রিদের ইতিহাস বদলে যায়।

বোর্ডের আনপ্রফেশনাল ব্যবহার আর নিছক বোকামির কারনে সেদিন বার্সাকে অনেক বড় কিছু হারাতে হয়েছিল, যার আফসোস প্রতিটি কিউলের মনে হয়তো আজো আছে। সেদিন যদি বার্সা মিলিওনারিওস কে ছোট না করে পর্যাপ্ত টাকাটা দিয়ে দিতো তাহলে ইতিহাসটা আজ অন্যরকম ভাবে হয়তো লেখা হতো। 

ডি স্টেফানো তার প্রথম এল ক্লাসিকোতে বার্সেলোনার বিপক্ষে ৪ গোল করেছিলেন এবং এরই মাধ্যমে স্পেনের মাঠিতে উত্থান হয় এক লিজেন্ডের, যিনি পরবর্তীতে সাদা জার্সি পরে পুরো ইউরোপে রাজত্ব করেন!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা