যদিও অপর্যাপ্ত, তারপরেও ঢাকার বুকে বেশ কিছু লাইব্রেরি আছে যেখানে আপনি ইচ্ছেমত বই পড়তে পারবেন। এমন কয়েকটি জায়গার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে এই লেখায়।

এক সময় আমার ধারণা ছিল দেশে প্রচুর পরিমাণে লাইব্রেরি করে দিলেই হয়তো বই-পড়ার অভ্যাসটা বাড়বে। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি থাকলে সেখানকার তরুণ-যুবকেরা বই পড়তে শুরু করবে। ব্যপারটা আসলে সত্যি নয়। প্রথমত, কোন সমাজেই (উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে) খুব বেশি মানুষ বই পড়ে না। দ্বিতীয়ত, যারা বই পড়ে তাদের সকলেই 'পাঠক' নয়, এদের বেশিরভাগ বই পড়ে সস্তা বিনোদন লাভের আশায়। 

একটা সাধারণ মানের সিনেমা বা নাটক থেকে যে বিনোদন আমরা পাই, সাধারণ মানের একটা উপন্যাস বা থ্রিলার থেকেও অনেকটা সে ধরণের বিনোদনই আমরা পাই। তবে অবশ্যই বই থেকে পাওয়া বিনোদন, টেলিভিশন-সিনেমার বিনোদনের থেকে অনেক উন্নত মানের। কারণ 'সস্তা উপন্যাস' বলি বা থ্রিলার বলি, বই পড়লে যেহেতু কল্পনার ব্যাপারটা কাজ করে, সেটা মস্তিষ্কের দারুণ উন্নতি ঘটায়। তাই বিনোদনের জন্য বই পড়াটাও প্রশংসনীয় ব্যাপার।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ আমাদের দেশে অন্য যে কারো থেকে 'বই পড়া' নিয়ে বেশি কাজ করেছেন, এখনো করছেন। তাঁর মতে কোন দেশে সত্যিকার পাঠক থাকে খুব বেশি হলে ৫-৭ শতাংশ। তাঁর বই পড়া আন্দোলন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রমের পুরোটাই এই ৫-৭ শতাংশ মানুষকে পর্যাপ্ত ম্যাটেরিয়াল পৌছে দেয়ার জন্য। কাজেই এলাকায় এলাকায় লাইব্রেরি গড়ে তুললেই যে সকলে পাঠক হয়ে যাবে, ব্যাপারটা এমন নয়।

তবে পর্যাপ্ত লাইব্রেরি বা পড়ার সুযোগ থাকলে,যারা সত্যিকারের পাঠক- তাদের ভীষণ উপকার হবে। হয়তো পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে ঐ ৫-৭ শতাংশের মধ্যে থাকা একটি কিশোর বই পড়তে পারছেনা, ফলে ধীরে ধীরে তার আগ্রহটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এক সময় বলা যেত, বই পড়ার সুযোগ নেই, লাইব্রেরি নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন কিন্তু এমনটা বলার উপায় নেই। কেউ যদি বই পড়তে চায় তার জন্য সুযোগের অভাব নেই। শুধু সেগুলো খুঁজে নিতে হবে। 

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র

দেশে, বিশেষ করে ঢাকায় বেশ অনেক গুলো ভালো ভালো বইয়ের দোকান গড়ে উঠেছে। অস্বীকার করছি না যে বইয়ের দাম বেশি অনেক ক্ষেত্রেই, কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা শত শত রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ-ডিনার করা একটা জেনারেশন টাকার অভাবে বই কিনতে পারে না- এটা আমি বিশ্বাস করি না। বই কেনার দরকার নেই। বই না কিনেও বই পড়া যায়। আর এর জন্যই লাইব্রেরি দরকার।

যদিও অপর্যাপ্ত, তারপরেও ঢাকার বুকে বেশ কিছু লাইব্রেরি আছে যেখানে আপনি ইচ্ছেমত বই পড়তে পারবেন। এমন কয়েকটি জায়গার কথা উল্লেখ করছি। প্রথমেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরির কথা উল্লেখ করতে হয়। শুধুমাত্র এই একটি কাজের জন্য আবদুল্লাহ আবু সাঈদ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে, দেশের অধিকাংশ স্থানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি যায়, চাইলেই সেখানে সদস্য হয়ে আপনি এক-দুই সপ্তাহের জন্য বই বাড়িতে নিয়ে পড়তে পারবেন।

যারা ঢাকায় থাকেন, তাদের জন্য সুযোগ আছে সরাসরি বাংলামটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ার। লাইব্রেরি বিকাল ৪ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটি। লাইব্রেরিতে গিয়ে আপনি বই পড়তে পারবেন, এর জন্য সদস্য হতে হবে না। তবে বাড়িতে বই নিতে চাইলে সদস্য হওয়া লাগবে। ৩০০/৬০০/১২০০ টাকা জামানত দিয়ে সদস্য হওয়া যায়। যত টাকা দিয়ে সদস্য হবেন ঐ দামের মধ্যে সর্বোচ্চ দুটি বই নিতে পারবেন দুই সপ্তাহের জন্য।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের 'বই বিক্রয় কেন্দ্র' থেকে বই কিনতেও পারবেন, লাইব্রেরি সদস্য হলে অতিরিক্ত ৫% কমিশন পাবেন। ধানমন্ডি ৮ নম্বর ব্রিজের পাশে, রবীন্দ্র সরোবরের ঠিক সামনে (আগে যেখানে ঢাকা আর্ট গ্যালারী ছিল) রয়েছে- জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠ-এর লাইব্রেরি। এটির সুবিধা হল, এটি সপ্তাহের ৭ দিনই খোলা থাকে সকাল ৯ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত। তবে অসুবিধা হল এখান থেকে বই বাড়িতে নেয়া যায়না, এখানে বসেই পড়তে হয় এবং তার জন্য সদস্য হতে হয়। তবে সদস্য হতে কোন ফি লাগে না। এক কপি পাসপোর্ট সাইজ এবং এক কপি স্ট্যাম্প সাইজের ছবি আর যেকোন একটি আইডি-র (এনআইডি, পাসপোর্ট, লাইসেন্স) ফটোকপি নিয়ে ওখানে গেলে সাথে সাথে আপনার মেম্বারশিপ হয়ে যাবে এবং লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারবেন। সব থেকে বড় কথা এদের সংগ্রহটা বেশ ভালো, বেশ দুর্লভ কিছু বই এখানে পাওয়া যাবে।

পাবলিক লাইব্রেরী

পাবলিক লাইব্রেরিতে যদিও সবাই যায় বিসিএস এর পড়া পড়তে, তারপরেও সেখানে 'আউট বই' পড়তেও আপনি যেতে পারবেন। তবে তার জন্য মাটিতে বসে পড়তে হতে পারে,কারণ ওখানে জায়গা পাওয়াটা 'মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়'। ওখানে মোটামুটি ধরণের কালেকশন আছে। পাবলিক লাইব্রেরিতেও মেম্বার হয়ে বই ধার নেয়া যায়। জামানত হিসেবে দিতে হয় ৫০০ টাকা। এখানে মেম্বার হতে ছবি, আইডি'র কপির সাথে সাথে অথোরাইজড সিগনেচার (ছাত্র হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান/বিভাগীয় প্রধানের, অন্যান্য ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলর/চেয়ারম্যানের) দরকার হয়। 

ফুলার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরিতে ইংরেজি বই এর কালেকশন ভালো। ওখানে গিয়ে বসে বসে পড়তে পারবেন, এর জন্য মেম্বার হতে হবেনা, গেলেই হবে। এখানেও মেম্বার হয়ে বই ধার নেয়া যায়, স্বাভাবিকভাবেই এখানে মেম্বারশিপ ফি একটু বেশি। চানখারপুলে অমর একুশে হলের পাশে 'এশিয়াটিক সোসাইটি'র লাইব্রেরিটাও বেশ সমৃদ্ধ। সেখান থেকে বই কেনাও যায়। সদস্যও হওয়া যায়, তবে বিস্তারিত পদ্ধতি আমার জানা নেই। আগারগাঁও-এ জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রেও আপনি সদস্য হতে পারবেন, এর জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সিগনেচার দরকার হবে।

আরেকটা জায়গা আছে গুলিস্তানে। গোলাপ শাহ মাজারের ঠিক পাশে তাকালেই দেখবেন 'গ্রন্থ ভবন' নামে একটা বিল্ডিং আছে যেটাকে দেখে মনে হয় মার্কেট (একবার এক লোক ভিতরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "ভাই জুতার দোকান গুলো কোন তলায়?") কিন্তু আসলে ওটা মার্কেট নয়। ঐ ভবনের ৫ (অথবা ৭, এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না) তলায় বেশ দারুণ একখানা লাইব্রেরি আছে। সেখানে গিয়েও আপনি পড়তে পারবেন, তবে 'খুব সম্ভবত' সদস্য হওয়ার ব্যবস্থা নেই। 

দীপনপুর

মিরপুরের 'আলোঘর লাইব্রেরী'-তে প্রায় ৭,০০০ বই আছে আলোঘর লাইব্রেরীতে। সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। যে কেউ সদস্য হতে পারবে। বাসায় বই নিয়ে পড়ার জন্য কোন সিকিউরিটি মানি রাখতে হয় না বা বই প্রতি কোন ভাড়া নেই। কোন মাসিক বা বাৎসরিক চাঁদা নেই। শুধু সদস্য হওয়ার সময় এককালীন ২৫ টাকা দিতে হয়। একসাথে প্রায় ৬০ জন পাঠক আলোঘর লাইব্রেরীতে বসে বই পড়তে পারেন। আলোঘর ছুটির দিনসহ সপ্তাহের সাতদিনই খোলা থাকে। রামকৃষ্ণ মিশনে চমৎকার একটা লাইব্রেরি আছে। অনেক দুর্লভ ধর্মীয় ও দর্শনের বই সেখানে পাওয়া যায়। এখানেও সদস্য হবার ব্যবস্থা নেই, সরাসরি এখানে এসে, এখানে বসেই পড়তে পারবেন। এছাড়া কাটাবনে নতুন বই-এর দোকান 'দীপনপুর' এ বসার অতি দারুণ ব্যবস্থা আছে, আপনি চাইলে বসে পড়তে পারবেন।

এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় ছোটখাটো বেশ কিছু লাইব্রেরি আছে, যা এই লেখায় আলোচিত হয়নি। সকলেই পাঠক না, কেউ কেউ পাঠক। যারা পাঠক, তাদের বলে দিতে হয়না,বা কারো বলার অপেক্ষায় তাঁরা বসেও থাকেনা, নিজেরাই উপায় খুঁজে নেয়। তারপরও যে সামান্য তথ্যগুলো আমি জানি সেগুলো সত্যিকারের পাঠকদের জন্য লেখা হলো। কারো উপকার হলে ভালো, উপকার না হলেও ক্ষতি নেই। যে লাইব্রেরিগুলোর কথা উল্লেখ করা হলো, প্রায় সবগুলোতেই আমার সদস্যপদ আছে, তারপরও বই না কিনে থাকাটা মুশকিল হয়ে যায়। এ অন্য রোগ। তবে গুরু মুজতবা আলীর কথা সবসময়ই আমি মানি, 'বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।'


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা