এই শহরে যে আমরা বেঁচে আছি, সেটাই তো মিরাকল!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের একটা নিরীক্ষায় ফলাফল এসেছে, ঢাকা শহরের শতকরা ৭১ ভাগ মানুষ মানসিক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। কোন না কোন শারীরিক সমস্যায় ভুগছে এই শহরের শতকরা ৬৮ জন মানুষ। প্রথম আলোতে এই প্রতিবেদনটা প্রকাশের পর থেকেই চারপাশে একধরণের হাহাকার দেখতে পাচ্ছি। যেন সমীক্ষার এই ফলাফল প্রকাশ হবার আগে কেউ মানসিক বিষাদে ভুগছিলো না, যেন প্রথম আলো সেটা নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পরেই এই শহরের শতকরা ৬৮ জন মানুষ অসুস্থ হয়ে গেছে! এর আগে সব ঠিক ছিল, সবাই সুস্থ ছিল!
ঢাকা শহরটা বসবাসের অযোগ্য আজ হয়ে ওঠেনি, আরও দশ-পনেরো বছর আগেই এটা সভ্য মানুষের বাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে। নেহায়েত আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলেই পড়ে আছি এই মরার শহরে। পড়ালেখা বলুন কিংবা চাকরি- জীবনের প্রয়োজনেই ঢাকায় থাকি আমরা, নইলে কি আর এই শহরের জনসংখ্যা আড়াই কোটি হয়?
চারপাশে শুধু হতাশ মানুষের মেলা। কেউ জীবন নিয়ে হতাশ, কেউ সম্পর্ক নিয়ে হতাশ, কেউবা ক্যারিয়ার, ভবিষ্যত- হতাশ হবার মতো কারণের অভাব নেই। যানজটে পড়ে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি কর্মঘন্টা, অফিস শেষে বাসায় ফেরার জন্যে গণপরিবহনে নেই ওঠার মতো অবস্থা; নারীদের জন্যে তো সেটা কয়েকগুণ বেশি ভয়াবহ! মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভারের জন্যে কয়েকটা বছর অসীম যন্ত্রণা ভোগ করেছেন সেখানকার মানুষজন, মেট্রোরেলের জন্যে সেই যন্ত্রণাটাই দশগুণ বেড়ে যোগ হয়েছে মিরপুরবাসীর কপালে! এরপরেও আমরা মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বলি, ভালো আছি তো!
দুট সিটি করপোরেশন, কেউই শহরের ন্যূনতম নাগরিক সেবা দিতে পারছে না। ওয়াসার কাজ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা, তারা রাস্তা খোঁড়ার মিশনে ব্যস্ত। ট্রাফিকব্যবস্থা কাজ করছে না। বায়ুদূষণের উৎস বন্ধ করা যাচ্ছে না, ঢাকা ঢেকে যাচ্ছে দূষণের চাদরে। বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ স্রোতের মতো আসছেই, কিন্ত বিকল্প বাসস্থান তৈরি হচ্ছে না, অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত রাস্তায় নামছে ফিটনেসবিহীন গণপরিবহন, চালকের বেপরোয়া গতিতে লাশ হয়ে যাচ্ছি আমরা। শাস্তি দিতে গেলে তারা আবার গাড়ি বন্ধ করে জনজীবন করে তুলছে দুর্বিষহ। এরপরেও ঢাকা শহরে লোকে শান্তিতে থাকবে কি করে?
আমাদের হতাশা বাড়ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। প্রিয়জনদের আত্মহত্যার খবর আসছে, বুকে পাথর চেপে আমরা সহ্য করে নিচ্ছি, নিজেদের পরিণত করছি অনুভূতিহীন জমাট মাংসপিণ্ডে। ধর্ষণের খবর আসছে, আমরা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। হতাশা চেপে রাখতে না পেরে ক্রমশ বিকৃতমনস্ক হয়ে পড়ছে একদল মানুষ। তারা নিজেদের ক্ষোভ মেটানোর জন্যে বেছে নিচ্ছে নিরীহ কোন নাগরিককে। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্যে তথ্য নিতে এসে তাই গুজবের বলি হয়ে লাশে পরিণত হচ্ছেন একজন মা!
অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে প্রতিনিয়ত। অল্প কিছু লোক সব সম্পত্তির মালিক হয়ে যাচ্ছে, তাদের ব্যাংক-ব্যালেন্স ফুলেফেঁপে উঠছে। বাজারে আগুন, একটা জিনিসে হাত দেয়ার জো নেই মধ্যবিত্তের- সেটা হোক খাবার অথবা পরনের কাপড়। পেঁয়াজের জন্যে দাঁড়াতে হচ্ছে টিসিবির ট্রাকের লাইনে, সেখানেও ধাক্কাধাক্কি! নিম্ন আয়ের মানুষের কথা আর নাই-বা বলি, তারা যে কি করে বেঁচে আছে এই শহরে, সেই অবর্ণনীয় গল্পগুলো তাদের মুখ থেকেই শোনা ভালো।
একেক বছর একেকটা মহামারী আসে, কখনও চিকুনগুনিয়া, কখনওবা ডেঙ্গু। এসব যাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল, তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়, প্রাণ যায় আমাদের। বায়ুদূষণের মতো বিশাল একটা সমস্যা নিয়ে কারো কোন বিকার নেই, যেন এটা কোন ব্যাপারই না! অথচ সমীক্ষার ফলাফল বলছে, ঢাকা শহরের মানুষের শারীরিক সমস্যা আর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণই এই বায়ু দূষণ। এত অনিয়মের শহরে এরপরেও আমরা কি করে ভালো থাকি, বলুন তো?
এর মধ্যে মন্ত্রীরা বুক ফুলিয়ে বলেন, ঢাকা নাকি লন্ডন-সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে, আকাশ থেকে ঢাকাকে দেখত্ব প্যারিস-নিউইয়র্কের মতো লাগে! সেটা লাগতেই পারে, কিন্ত আমরা তো আকাশে থাকি না, মর্ত্যে আমাদের বসবাস, আমাদের সমস্যা, আমাদের কষ্টের কথা কি আর আকাশে থাকা নেতারা বুঝবেন? এই শহরে মানসিক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত মানুষের হার যে নব্বই ছোঁয়নি, সেটাই তো বরং আশ্চর্য্যের!