এত মানুষকে যদি চাঁদে দেখা যেতে থাকে, তাহলে চাঁদে তো ট্রাফিক জ্যাম লেগে যাওয়ার কথা। দেওয়ানবাগীকে যদি ২০০৮ সাল থেকেই দেখা যেতে থাকে, তাইলে সাঈদী, আজহারিদের দেখা গেল কিভাবে? চাঁদের মধ্যে কি তাহলে সাঈদী, দেওয়ানবাগী, আজহারিরা ভাগাভাগি করে থাকেন? একেক পূর্ণিমাতে একেকজন দেখা দেন?

আজ সকালে মারা গেছেন দেওয়ানবাগী পীর সাহেব 'মাহবুব এ খোদা'। ৭০ বছর বয়সে ২৮শে ডিসেম্বর, সোমবার সকালে রাজধানীর আরামবাগে দেওয়ানবাগ শরীফে সকালে নিজ বাসায় হার্ট এটাক করেন তিনি। তখন উত্তরার একটা হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই পীরের অলৌকিক ক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে তার ভক্তরা দাবি করেন , ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসের পূর্নিমার চাঁদের মাঝে দেওয়ানবাগী পীরের ছবি দেখা গিয়েছিল।

শুধু ওই একবার নয়, এরপর থেকে প্রতি পূর্ণিমাতেই চাঁদের মাঝে দেওয়ানবাগীর ছবি দেখা যায় বলে তার ভক্তরা দাবি করেন। ২০০৮ সালের ১২ই অক্তোবর এর একটি প্রেস রিলিজে দেওয়ানবাগীর অফিস থেকে জানানো হয়, পূর্ণিমার চাঁদে বাবা দেওয়ানবাগীর ছবি প্রথমে দেখতে পান বাসাবো-সবুজবাগ এলাকার কয়েকজন যুবক। তারপর মোবাইলের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন জায়গায় খবরটা ছড়িয়ে দেন (তখন ফেসবুক এর যাত্রা কেবল শুরু হয়েছে, ইউজার ছিল অনেক কম)। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও তখন পূর্ণিমার চাঁদে দেওয়ানবাগী হুজুরের ছবি দেখা যেতে থাকে। এই ছবি দেখে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জনগন আনন্দ মিছিল বের করে। মসজিদে মসজিদে মাইকে করে জানানো হয় এই অলৌকিক ঘটনা।

এই সেই বিজ্ঞপ্তি

শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত মালয়েশিয়া ইংল্যান্ড আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও চাঁদের বুকে দেওয়ানবাগীর এই ছবি দেখতে থাকেন তার ভক্তরা। 'পূর্ণিমার চাঁদে বাবা দেওয়ানবাগী' নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে দাবী করা হয়েছে-

''পৃথিবী সৃষ্টির পর আজ পর্যন্ত কোন নবী রাসূল অলি আল্লাহর চেহারা মোবারক পূর্নিমার চাঁদে দেখা গেছে, এমন কোন ঘটনা ঘটে নাই। সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান আল্লাহর আকারের ১২০০০ পৃষ্ঠার "তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী" লিখার পর, দয়াময় মহান আল্লাহ দয়াকরে তার পুরস্কার হিসেবে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলার নুরানিময় চেহারা মোবারক পূর্নিমার চাঁদে দেখিয়ে যাচ্ছেন।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি

সেদিন ছিল ২০০৮ সালের ১০ই অক্টোবর । রাত ঠিক এগারোটায় আকাশের চাঁদে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলার পবিত্র নুরানিময় চেহারা মোবারকের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি দেখা শুরু হয় । তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা দেখা যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ আশেকে রাসূল এবং আশেকা রাসূলগন ১২ বছর যাবৎ আকাশের চাঁদে সূফী সম্রাটের চেহারা মোবারক দেখে তাদের প্রান শীতল করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি আশেকে রাসুল গন প্রতি মাসে শুকরিয়া হিসেবে আল্লাহর দরবারে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করে যাচ্ছেন। শুধু তাই না, তারা এই চাঁদ মোবারকের চেহারা মোবারকে মানত করে হাজার হাজার সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন। আসুন আমরা সবাই মিলে পূর্নিমার চাদের চেহারা মোবারক ধ্যান করে, যার যা সমস্যার জন্য মানত করি এবং আল্লাতে পৌছার রাস্তা তৈরী তৈরি করি। আমিন। ''

এই অলৌকিক ঘটনা উদযাপন করার জন্য প্রতি পূর্ণিমা রাতেই মতিঝিলের দেওয়ানবাগ শরীফে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

তবে মাঝে মাঝে পূর্ণিমার চাঁদের বুকে অন্যান্য জনপ্রিয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের চেহারা দেখার কথাও দাবি করেন তাদের ভক্তরা। গতকাল, ২৮শে ডিসেম্বর মিজানুর রহমান আজহারির কিছু ভক্ত দাবি করেছিলেন, তারা পুর্ণিমার চাঁদের বুকে আজহারি হুজুরকে দেখতে পাচ্ছেন। গত ফেব্রুয়ারি এবং এপ্রিলেও একই দাবি উঠেছিল।২০১৩ সালের মার্চ মাসে দেলোয়ার হোসেইন সাঈদীর একদল ভক্ত দাবি করেছিলেন, তার পুর্ণিমার চাঁদের মধ্যে সাঈদীর ছবি দেখতে পেয়েছেন।

ফটোশপে এডিট করা সাঈদীর ছবি

এত মানুষকে যদি চাঁদে দেখা যেতে থাকে, তাহলে চাঁদে তো ট্রাফিক জ্যাম লেগে যাওয়ার কথা। দেওয়ানবাগীকে যদি ২০০৮ সাল থেকেই দেখা যেতে থাকে, তাইলে সাঈদী, আজহারিদের দেখা গেল কিভাবে? চাঁদের মধ্যে কি তাহলে সাঈদী, দেওয়ানবাগী, আজহারিরা ভাগাভাগি করে থাকেন? একেক পূর্ণিমাতে একেকজন দেখা দেন?

সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা:

১। ভক্তগন রাজনৈতিক বা অন্য কোন সুবিধা আদায়ের জন্য মিথ্যা বলছেন। চাঁদে কাউকেই দেখেন নাই তারা।

২। ভক্তদের চোখে হ্যালুসিনেশন হয়েছিল, তাই তারা চাঁদের মধ্যে কাংখিত ব্যক্তির ছবি দেখেছেন। মানুষের চোখে হ্যালুসিনেশন হতে পারে, কিন্তু ক্যামেরার হ্যালুসিনেশন হয়না। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে এক্সাক্টলি বোঝা যাবে, সেখানে কারো ছবি দেখা যাচ্ছে কিনা।

মিজানুর রহমান আজহারীকেও চাঁদে নিয়ে গেছে তার ভক্তরা

৩। ছবিতেও যখন দেখা গেল, মানুষের মুখের আকৃতির কিছু নাই, তখন ভক্তগন ফটোশপ ( বা অন্য কোনো এডিটিং সফটওয়ার )দিয়ে দেওয়ানবাগী, সাঈদী বা আজহারির ছবি এডিট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সার্কুলেট করে দিয়েছে ।

৪। প্যারাইডোলিয়া নামে একটা মানসিক রোগ/ ফেনোমেনন আছে। এই ক্ষেত্রে মানুষ পরিচিত জিনিসের প্যাটার্ন খোজে । দুইটা ডট পাশাপাশি থাকলে মানুষের ব্রেন এটাকে চোখ এর সাথে তুলনা করে। এইরকমভাবে চাঁদের আকাবাকা দাগকেও অনেকে চরকা কাটা বুড়ি , ঝলসানো রুটি থেকে শুরু করে অনেক প্রিয় মানুষের মুখ হিসেবে কল্পনা করেন। চাঁদের মধ্যে এভাবেই দেওয়ানবাগী, সাঈদী, আজহারির মুখের সাথে মিল দেখতে পারেন কেউ কেউ। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো ছবিগুলো নিঃসন্দেহে এডিটেড।

রেফারেন্স-

  1. যমুনা টিভি
  2. বিডি জার্নাল
  3. সাপ্তাহিক দেওয়ানবাগ
  4. সামহোয়্যারইন ব্লগ
  5. দ্য উইকলি দেওয়ানবাগ,
  6. পূর্ণিমার চাঁদে বাবা দেওয়ানবাগী ফেসবুক পেজ
  7. প্যারাডোলিয়া সম্পর্কে আরো জানতে ক্লিক করুন এখানে
  8. আজহারি হুজুরের চাঁদে দেখতে পাওয়ার খবর এখানে

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা