আমাদের কাছে পাহাড়, নদী, সমুদ্র কোনো বাছবিছার নেই। সু্যোগ পেলেই নোংরা করে ফেলি সব। অঞ্চল আলাদা হতে পারে, আমাদের অভ্যাস আলাদা হয় না।

আমি কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। পুরো পথ জুড়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে পানির খালি বোতল। চূড়ায় উঠার পর ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিয়ে মানুষ খাবার টাবার খায়। সেখানেও চিপসের প্যাকেট, বিস্কুটের প্যাকেট, সিগারেটের প্যাকেট, পানির বোতল এদিক ওদিক ছড়িয়ে রাখা। এগুলো আমরাই করি। ঘুরাঘুরি শেষ করে এই আমরাই আবার এডিট করে নিজের প্রোফাইলে ছবি দিয়ে পর্যটন স্পটগুলোর গুণকীর্তন করি৷ কিন্তু, আমরা এটা খেয়াল রাখি না যে, আমরা যে কাজ করে আসলাম, যেভাবে ময়লাগুলো ফেলে আসলাম সেটা দেখে আমাদের পরের ট্যুরিস্টরা কেমন অনুভব করবে? কোনো বিদেশী মেহমান এসে যদি এই অবস্থা দেখে তাহলে কেমন ধারণা নিয়ে যাবে দেশটা সম্পর্কে? 

হিউম্যান সাইকোলজি এমন যেখানে ময়লা থাকে সেখানে তারা আরো বেশি নোংরা করে। কোনো পরিষ্কার বাথরুমে গিয়ে আমরা ঠিকই হাগু টাগু করার পর ঠিকমতো পানি ঢেলে আসি। আর যে বাথরুম নোংরা সেখানে গিয়ে নিজের প্রয়োজন সারার পর ফিরে আসি আলগোছে। ময়লা আরো ময়লা হয়। আমরা যখন কোনো ট্যুরিস্ট স্পটে গিয়ে ময়লা দেখি, তখন সেটাকে পরিষ্কার রাখার বদলে নিজেরা আরো কিছু ময়লা ফেলে জায়গাটাকে আরেকটু নোংরা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখি। আমরা কখনোই নিঃস্বার্থ হতে পারলাম না। ঘুরলাম, আনন্দ করলাম, নিজে উপভোগ করলাম, ফিরে আসলাম, ছবি আপলোড দিয়ে নাইস পিক কমেন্ট পেয়ে উল্লসিত হলাম কিন্তু ভেবে দেখলাম না যে জায়গাটার কি অবস্থা করে এসেছি। আজ থেকে পাঁচ বছর বাদে এই সুন্দর জায়গাগুলো হারাবে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। কেউ আর হয়ত যেতেই চাইবে না পরিবেশ নোংরা হয়ে যাওয়ার ফলে৷  

বাংলাদেশের প্রায় সব পর্যটন স্পটের একই অবস্থা। ডাবের খোসা, চিপসের প্যাকেট, ময়লা, আবর্জনা, খাবারের পোটলা যা যা আছে সব যেখানে সেখানে ফেলে আসে ট্যুরিস্টরা। যারা এই কাজ করে তারা মঙ্গলগ্রহের প্রাণী না, তারা এই বাংলাদেশেরই কৃতি সন্তান সবাই৷ একটা দেশের ট্যুরিজমের মূল আকর্ষণ তো এই স্পটগুলোই। এগুলোও যদি আমরা নষ্ট করি এভাবে তাহলে আর আমাদের দেখানোর থাকে টা কি?

এমনিতেও আমাদের দেশের ট্যুরিজমের অনেক কিছুই ঠিক নেই। একটা ভাল ওয়েবসাইট নেই যেখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য মিলবে। যাতায়াত ব্যবস্থাও অনেক কম্পলিকেটেড। তার ওপর ট্যুরিস্ট দেখলেই ওয়ানটাইম ব্যবসা করার ঝোঁক তো লোকাল ব্যবসায়ীদের আছে। দুই টাকার ভাড়া রাখবে ছয় টাকা৷ তিন টাকার খাবারের দাম হয়ে যাবে নয় টাকা। আর ট্যুরিস্টদের কাছে সত্য গোপন করে মিথ্যা বলার অভ্যাস তো আছেই।

এতো কিছুর পরেও মানুষ যে ঘুরতে যায় এটাই তো অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু, এখন যে হারে পর্যটন স্পটগুলো ময়লার স্তুপে পরিণত হচ্ছে তাতে করে মানুষ আকাঙ্ক্ষিত জায়গাগুলোতে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়ত হারিয়ে ফেলবে। কার দায় পড়েছে, টাকা খরচ করে ময়লার ভাগাড় দেখতে যাওয়ার? ফেসবুকে ট্রাভেল নিয়ে গ্রুপগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, কিভাবে একটা সুন্দর জায়গাকে মানু্ষ ময়লা টয়লা ফেলে নোংরা করে ফেলেছে সেই ছবি। ফেসবুক থেকে জনপ্রিয় হওয়া একটা পর্যটন আকর্ষণের নাম খৈয়াছড়া ঝর্ণা। এখন এই জায়গাটার কি অবস্থা সেটা নিয়েই লিখেছেন, মইনুল হোসাইন তপু, ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশ গ্রুপে।  

তিনি লিখেছেন, "যে খৈয়াছড়া আমরা আরো সাত আট বছর আগে দেখেছি, সেই খৈয়াছড়া আর এখনকার খৈয়াছড়া আকাশ পাতাল তফাৎ। এমনকি ১৪-১৫ সালের দিকে যখন এ ঝর্ণা পপুলার হয় তখনও অনেক সুন্দর ছিলো। ছড়ার পানিগুলো কি স্বচ্ছ ছিলো,ঝর্ণার পানি সন্দেহ ছাড়া পান করা যেত। আমরা আসলে সেই খৈয়াছড়াকে ধ্বংস করে ফেলেছি। বানিয়েছি ময়লা আবর্জনার ভাগাড়।"

এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবসে তিনি এবং তাদের একটি টিম 'সোনালী স্বপ্ন' গিয়েছেন ঝর্ণা পরিষ্কার করতে। গিয়ে দেখেন ঝর্ণার চারধার কি অবস্থা করে রেখেছে মানুষগুলো। তিনি লিখেছেন,

"শুধু ঝর্ণার পাদদেশ থেকে দুই বস্তা পানির বোতল পেয়েছি।আরো এক বস্তা চিপসের প্যাকেট,কলার খোঁসা,বিরিয়ানির প্যাকেট,প্লাস্টিক এবং নানাবিধ বর্জ্য পেয়েছি। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, ঝর্ণার পাদদেশ থেকে পাঁচটি প্যান্ট ও থ্রি কোয়ার্টার,অসংখ্য আন্ডারওয়ার,গেঞ্জি আরো অনেক জিনিস পেয়েছি যেগুলো লিখতে রুচিতে বাঁধছে। দুই গ্রুপের মাঝে দুটা মারামারি দেখলাম এক ঘন্টায়। ঝর্ণায় মেয়েরা যে গোসল করছে ক্লোজ এঙ্গেল থেকে ছবি তুলছিল একজন। এটা দেখে ওদের গ্রুপে যারা ছিল,তারা ওকে মার দেয়। ছবি ডিলিট করায়।"

এই হলো আমাদের পর্যটন স্পটগুলোর অবস্থা। আমাদের কাছে পাহাড়, নদী, সমুদ্র কোনো বাছবিছার নেই। সু্যোগ পেলেই আমরা নোংরা করে ফেলি সব। ঢাকা থেকে চাঁদপুর, বরিশাল, মনপুরা, পটুয়াখালির লঞ্চগুলোতে যাওয়ার সু্যোগ হয়েছে কয়েকবার। অঞ্চল আলাদা হতে পারে, অভ্যাস না। মাঝ নদীতে লঞ্চের উপর থেকে যেভাবে মানুষ খাবারের বর্জ্য ফেলে, বোতল ফেলে, বিবিধ ময়লা ফেলে- অবিশ্বাস্য একেবারে!  

এই মানসিকতা না বদলালে, আমাদের পর্যটন একটুও আগাবে না। যে তরুণরা দেশের ট্যুরিজম পালটে দিয়েছে গত কয়েকবছরে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এখন তারাই ঝুঁকছে পাশের দেশগুলোর দিকে। তারা এখন প্রেফার করে একটু বেশি টাকা জমিয়ে বাইরে গিয়ে ঘুরে আসতে। এই চেঞ্জগুলো কেনো হচ্ছে আপনাকে সেটা বুঝতে হবে। শুধু মাইক পেলে, টকশোতে গিয়ে বাংলাদেশ পর্যটনে অমিত সম্ভাবনার দেশ, বাংলাদেশ সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা দেশ এসব গতবাঁধা মন ভোলানো কথা বললেই পর্যটনের উপকার হয় না। কাজ করতে হয়, সত্যিকারের কাজ। 

আমাদের দেশে পর্যটনের জীবন চক্র খুব সহজ। কেউ একজন খোঁজ পেলো, তারপর মানুষ জানলো। সেখানে ঘুরতে যাওয়া ট্রেন্ড হয়ে গেলো, তারপর শুরু হয় সেটাকে ময়লার ভাগার বানানো। তারপর আবার নতুন কোনো জায়গাকে নষ্ট করার উৎসব শুরু হয়। এভাবে আমরাই কি আমাদের ট্যুরিস্ট স্পটগুলো নষ্ট করে ফেলছি কিনা? মনের ময়লা সাফ না হলে, কোনো ময়লা পুরোপুরি সাফ করা যায় না। যারা ঘুরতে যান, তারা মনটাকেও ব্রাশ করে নিয়েন একটু। তাহলে অন্তত যদি একটু বিবেকটা কাজ করে... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা