কারো আত্মহত্যার খবর পেলে আমরা বলি, ‘আরে, ওকে তো সেদিনও দেখলাম কত হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছ্বল। ওর জীবনে আত্মহত্যা করার মত কী এমন ঘটলো!’ এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল। আমরা কেবল একজন ব্যক্তির মুখের হাসিই দেখি, কিন্তু সেই হাসির পেছনে কোন গভীর বিষাদের ছায়া লুকিয়ে আছে কিনা তা আমরা দেখতে পাই না, দেখার চেষ্টাও করি না।
একটা সময় ছিল যখন মানুষের মনের রোগকে খুব একটা পাত্তা দেয়া হতো না। কারও মানসিক সমস্যার কথা শুনলে লোকে হেসেই উড়িয়ে দিত। আর কেউ সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হয়েছে, এমন কথা রটে গেলে তো কথাই নেই। সবাই ধরে নিত লোকটি নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু আজ, ২০১৭ সালের এই দিনে এসে মানসিক সমস্যাগুলো আর হেলাফেলার বিষয় নয়। কেবল মাত্র মানসিক সমস্যার কারণে যে ইতি ঘটছে কত সম্ভাবনার, এবং সম্ভাবনাময় জীবনেরও, তার কোন ইয়ত্তা নেই। আর তাই সময় এসেছে মানসিক সমস্যাগুলোকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে, সেগুলোর সমাধান খোঁজার। তবে সমাধান খোঁজার আগে যেটি জরুরি তা হলো, সমস্যা আদৌ আছে কিনা, আর তা থাকলে কী কারণে সমস্যাটি হচ্ছে তা উদ্ঘাটন করা।
একজন মানুষের হরেক রকম মানসিক সমস্যা থাকতে পারে। তবে আজকাল আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি শুনে থাকি তা হলো ডিপ্রেশান বা মানসিক অবসাদ। প্রায়ই আমরা আমাদের আশেপাশের অনেককে বলতে শুনি, তাদের নাকি ডিপ্রেসড লাগছে। এবং তাদেরকে সেই ডিপ্রেশান কাটিয়ে ওঠার জন্য নিজেদের মত করে বিভিন্ন সমাধানও খুঁজতে দেখা যায়। কিন্তু তাদের কী পরিণতি হয় যারা জানেই না যে তারা ডিপ্রেশনে ভুগছে? এমন লোকের সংখ্যাই আমাদের সমাজে বেশি। মনের কোণে প্রচন্ড অবসাদ বা ডিপ্রেশন ঘাপটি মেরে থাকলেও, সে খবর জানে না অধিকাংশ মানুষ। তারা এই ডিপ্রেশন নিয়েই দিব্যি দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়, এবং এগিয়ে যেতে থাকে ভয়ংকর কোন পরিণতির দিকে। এমনকি কখনো কখনো সেই পরিণতি আত্মহননের মত সর্বনাশীও হতে পারে। কিন্তু এমন পরিস্থিতি খুব সহজেই এড়ানো সম্ভব, যদি আগে থেকেই আমাদের জানা থাকে যে কোন লক্ষণগুলো থেকে বোঝা যাবে আমরা ডিপ্রেসড বা অবসাদগ্রস্ত কিনা। চলুন তবে জেনে নিই সেই লক্ষণগুলোর ব্যাপারে।
১। দার্শনিক চিন্তাভাবনা: অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যেই দার্শনিক চিন্তাভাবনা বেশি দেখা যায়। যেকোন ব্যাপারেই তারা তাদের দার্শনিক অভিমত টেনে আনে। মূর্ত জিনিসের বিমূর্ত উপমা, কিংবা বিমূর্ত জিনিসের মূর্ত দৃষ্টান্ত দেখানোয় তাদের তুলনা নেই। সহজসরল পথে না হেঁটে তাদেরকে ঘোরপ্যাঁচওয়ালা রাস্তায় হাঁটতে দেখা যায়। যেমন কোন বিপদে পড়লে সাধারণ মানুষের যেখানে প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়, 'আমার সাথেই কি এটা হওয়ার ছিল!', সেখানে অবসাদগ্রস্ত মানুষেরা বলে, 'আমার সাথে তো এমনই হয়!' এই ধরণের মানুষের মধ্যে রোমান্টিসিজমও দেখা যায় খুব বেশি পরিমাণে। তাদের সাথে দুদন্ড কথা বললে মনে হতেই পারে, জীবনটা বুঝি নিছকই জীবন নয়, কোন উপন্যাসের কাহিনী, কিংবা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য।
২। অজুহাত খোঁজাঃ অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিরা অজুহাত খুঁজতে, এবং খুঁজে না পেলে মনগড়া অজুহাত তৈরীতে ওস্তাদ। এবং এসব অজুহাত দেখিয়ে তারা যে কেবল তাদের আশেপাশের মানুষগুলোকেই তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে তা নয়। তারা নিজেদেরও বঞ্চিত করে নিজেদের নানাবিধ আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন থেকে। এবং এর ফলে তারা আগের থেকে আরও বেশি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যেমন কোন ব্যক্তির হয়ত বন্ধুদের সাথে লাঞ্চ করতে যাওয়ার কথা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে সে প্ল্যানটি বাতিল করল। এবং পরবর্তীতে সে কেন এমনটা করল, এবং না জানি তার বন্ধুরা কত মজা করছে - এসব চিন্তাভাবনা করে সে মানসিকভাবে আরও বেশি ভেঙে পড়ল।
৩। উদাসীনতা: এ ধরণের ব্যক্তিদেরকে সংজ্ঞায়িত করতে ইংরেজিতে একটি যথোপযুক্ত শব্দ রয়েছে - indifferent. যেকোন ক্ষেত্রেই এ ধরণের ব্যক্তিরা বড় বেশি indifferent বা উদাসীন। তাদের আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, এসব ব্যাপারে তারা বরাবরই অনেক বেশি উদাসীন থাকে, এবং নিজেদেরকে একটি সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যে গুটিয়ে নিতেই পছন্দ করে। তাছাড়া যেকোন ব্যাপারে সাধারণ আর দশটা মানুষের যেরকম প্রতিক্রিয়া হয়, তাদের প্রতিক্রিয়া তার থেকে ভিন্নতরও হয়। যেমন একটি সিনেমা দেখে হয়ত সবাই বাহবা দিচ্ছে। কিন্তু একজন অবসাদগ্রস্ত মানুষকে যখন সিনেমাটি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলো, সে তখন সিনেমাটির খুঁটিনাটি নানা ভুলভ্রান্তি তুলে ধরতে শুরু করলো। এ ধরণের মানুষ আসলে অনেক বেশি নেতিবাচক ও হতাশাবাদী।
৪। শারীরিক সমস্যা: অবসাদগ্রস্ত মানুষদেরকে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কথাও বলতে শোনা যায়। যেমন বুকে ব্যথা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, মাথা ব্যথা, দাঁত শিরিশির করা, হাত-পা অকারণে ঘামতে থাকা ইত্যাদি। এগুলোকে সাধারণ কোন রোগ ভাবলে ভুল হবে। কেননা অধিকাংশ অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিই যেসব রোগের কথা বলে, আদতে তাদের তেমন কিছুই হয় না, বরং এগুলো হয় তাদের মনগড়া।
৫। কোন কিছুর ব্যাপারে অবসেশন: অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিরা খুব সহজেই যেকোন ব্যাপারে অবসেসড হয়ে পড়তে পারে। যেমন একজন ব্যক্তি হয়ত সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মেঝেতে একটি টিকটিকি পড়ে থাকতে দেখল। সে যদি সাধারণ কেউ হয়, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্য নানা কাজের চাপে তার এ কথা বেমালুম ভুলে যাওয়ার কথা। কিন্তু একজন অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি কোন কিছুই এত সহজে ভুলে যায় না। একবার তার মাথায় কোন একটি বিষয় গেঁথে গেলে, সে সারাদিন সেটি নিয়েই পড়ে থাকে। যেমন একজন অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তির মাথার মধ্যে হয়ত সারাদিন ওই মৃত টিকটিকিটির কথাই ঘুরপাক খেতে থাকবে। এবং এ ধরণের ব্যক্তিরা নিজের সমালোচনার ব্যাপারেও অনেক বেশি স্পর্শকাতর হয়। অতি সামান্য কোন সমালোচনাকেও তারা অনেক বেশি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে, এবং দীর্ঘ সময় ধরে তারা মনের মধ্যে সেটি নিয়েই নাড়াচাড়া করতে থাকে।
৬। অগোছালো অবস্থা: অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিদের মনের মধ্যে সারাক্ষণ চিন্তার ঝড় বয়ে গেলে কি হবে, নিজেদের বাহ্যিক অবস্থার ব্যাপারে তারা একদমই সচেতন থাকে না। মোদ্দা কথা হলো, তারা আত্মকেন্দ্রিক হলেও আত্মসচেতন নয়। যেমন বাসা থেকে বেরনোর সময় তারা শার্টের উপরের বোতামটা লাগাতে বা চুল আঁচড়াতে ভুলে যায়। ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে না। অফিসে তাদের ডেস্কে কাগজপত্র ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় থাকে। এর কারণ হলো অন্যমনস্কতা। অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিরা সারাদিন নিজেদের মনের মধ্যে নানাবিধ চিন্তায় এতটাই ডুবে থাকে যে, পারিপার্শ্বিক বিষয়াবলির ব্যাপারে তাদের কোন হুঁশই থাকে না।
৭। কর্মক্ষমতা হ্রাস: অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কাজের আগ্রহ মরে যায়। কোন কাজই তারা আর আগের মত উৎসাহ নিয়ে সম্পন্ন করতে পারে না। ফলে তাদের যতটুকু কাজ করার কথা, সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য তারা কখনোই পূরণ করতে পারে না। এটি একটি দুষ্টচক্রের মত। অবসাদগ্রস্ততার কারণে তারা কাজ ঠিকমত করতে পারে না ঠিকই, কিন্তু এই না পারাটা নিয়ে সবসময় তারা দুশ্চিন্তা ও হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকে, যা তাদেরকে আরও বেশি অবসাদগ্রস্ত করে ফেলে। আর এর ফলে পরবর্তী সময়ে কোন কাজে তাদের পারফরম্যান্স আরও বেশি খারাপ হয়। এতে তারা আরও বেশি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এবং এভাবেই চলতে থাকে।
৮। নিজেকে সুখী প্রমাণের চেষ্টা: একজন অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তির মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর স্বভাব এটিই। অর্থাৎ সমাজের আর সবার সামনে নিজেকে খুব হাসিখুশি ও সুখী প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা। ভিতরে ভিতরে হয়ত তারা গুমরে মরছে, কিন্তু নিজেদের প্রকৃত অভিব্যক্তি তারা কখনোই মানুষের সামনে আনে না। বরং যখনই তারা অবসাদ অনুভব করে, তখন তারা আরও বেশি করে হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠে। এবং কোন বিষয়কেই তারা গুরুত্বের সাথে নেয় না, বরং হেসেই উড়িয়ে দেয়। এভাবে তারা সমাজের সকলের সামনে নিজের একটি হাসিখুশি, ডোন্ট কেয়ার ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এই যে সবসময় তাদের মধ্যে নিজের সাথে লুকোচুরি খেলার প্রবণতা, তাতে তারা প্রথম প্রথম সাফল্য পেলেও, একটা পর্যায়ে সেটি তাদের নিজেদের কাছেই অসহনীয় হয়ে পড়ে। আর তখন তারা আত্মহত্যার মত কঠিন কোন সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধাবোধ করে না।
অধিকাংশ সময়ই কোন ব্যক্তির আত্মহত্যার খবর পেলে আমরা বলি, 'আরে, ওকে তো সেদিনও দেখলাম কত হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছ্বল। ওর জীবনে আত্মহত্যা করার মত কী এমন ঘটল!' এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল। আমরা কেবল একজন ব্যক্তির মুখের হাসিই দেখি, কিন্তু সেই হাসির পেছনে কোন গভীর বিষাদের ছায়া লুকিয়ে আছে কিনা তা আমরা দেখতে পাই না, দেখার চেষ্টাও করি না।